শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৬ পূর্বাহ্ন

পরচর্চা : মারাত্মক গুনাহ

সালমা বিনতে শামছ :
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২০

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। মহান আল্লাহর নির্দেশিত ইবাদত- সাওম, সালাত, জাকাত, হজই কেবল ইসলাম নয়। জীবনের প্রতিটি ধাপেই ইসলাম তার সুমহান সৌন্দর্য নিয়ে বিস্তৃত। আমরা ইসলামের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য সম্পর্কে সঠিকভাবে জানি না বলে অজান্তে অনেক বড় বড় গুনাহ করে ফেলি। আমাদের মানবজীবনে চলার পথের কমন একটি বৈশিষ্ট্য হলো পরচর্চা, পরনিন্দা তথা গিবত। এটি একটি মারাত্মক নিন্দনীয় কাজ এবং কবিরা গুনাহ। গিবত করা এবং তা শ্রবণ করা দুটোই গুনাহের কাজ। গিবত বলতে সাধারণত বুঝায়- ‘কারো কোনো ত্রুটি সম্পর্কে তার অগোচরে কারো সাথে সমালোচনা করা। আর যার ত্রুটি বাস্তবতায় নেই, কিন্তু অন্যের কাছে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করা হয়, তাকে বোহতান’ তথা মিথ্যা অপবাদ বলে।
এ সম্পর্কে মহানবী সা:-এর বাণী সংবলিত হাদিস গ্রন্থে রয়েছে- হজরত আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত, একদা রাসূল সা: বললেন, তোমরা কি জানো গিবত কাকে বলে? লোকেরা বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক জানেন। তিনি বললেন, তোমার ভাই যা অপছন্দ করে, তাই তার পশ্চাতে আলোচনা করা। বলা হলো, আমি যা বলি, তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তাহলে আপনার রায় কী- তিনি বললেন, তুমি যা (সমালোচনা করে) বললে, তা যদি তার মধ্যে থাকে তাহলে তার গিবত করলে। আর তুমি যা বললে, তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তাহলে তাকে অপবাদ দিলে। (মুসলিম ২৫৮৯) মানুষ খুব সহজেই অন্য মানুষের অগোচরে তাকে নিয়ে নানা কটু কথা বলতে পারে, যদিও সেসব কথার সত্যতা রয়েছে তবুও পশ্চাতে এসব কিছু বলা দোষণীয়। আমরা আমাদের জিহ্বাকে সংযত করতে পারি না বলে ক্রমাগত গুনাহের বোঝা ভারী করি, একজন সত্যিকারের মুসলিমের প্রধান শক্তি হলো সে তার বাকশক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। আর এই বাকশক্তি তথা জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে ব্যক্তি পরনিন্দা, গিবত থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে।
যেখানে পবিত্র কুরআনের মহান আল্ল‍াহ তায়ালা সরাসরি গিবত থেকে দূরে থাকতে বলেছেন সেখানে মানুষের পেছনে বিন্দু পরিমাণ নিন্দা করার কোনো অবকাশ নেই। আল্ল‍াহ পাক ইরশাদ করেন, ‘তোমরা একে অন্যের পশ্চাতে নিন্দা (গিবত) করো না।’ (সূরা হুজরাত আয়াত-১২)
আমরা মানুষরা সহজেই অন্য মানুষের প্রশংসা করতে পারি না, ব্যক্তি উত্তম কোনো কথা বা কাজ করলে আমরা তা প্রচার-প্রসারে সম্পূর্ণ বেখবর থাকি। পক্ষান্তরে ব্যক্তি কোনো মন্দকাজ করলে সেই স্থলে চুপ থাকার বদলে মন্দ কথা ও কাজ পাঁচ কান করার জন্য অস্থির হয়ে যাই। ‘যে ব্যক্তি আল্ল‍াহ ও কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন উত্তম কথা বলে নয়তো বা চুপ থাকে।’ (সহিহ বুখারি : ৬০১৮) একজন প্রকৃত মুসলিম কখনো অন্য মুসলিমকে তার কথা দ্বারা আঘাত করে না।
হজরত আবু মুসা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্ল‍াহ সা:-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল সা: সর্বোত্তম মুসলিম কে? তিনি বললেন, ‘যার জিহ্বা এবং হাত থেকে মুসলিমরা নিরাপদ থাকে।’ (বুখারি হাদিস-১১, মুসলিম হাদিস-৪২)
নিজের ভাইয়ের গোশত ভক্ষণের সাথে গিবতের ভয়াবহতা তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভ্রাতার গোশত ভক্ষণ করতে চাইবে? বস্তুত তোমরা তো এটাকে ঘৃণাই করো। তোমরা আল্ল‍াহকে ভয় করো। আল্লাহ তাওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।’ অর্থাৎ গিবত করা মানে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার শামিল। (সূরা হুজরাত আয়াত-১২)
‘নবীজী সা: বলেন, মেরাজের সময় আমি কিছু লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম, যাদের ছিল তামার নখ। সেই নখ দিয়ে তারা নিজেদের চেহারা এবং বুক ক্ষতবিক্ষত করছিল। আমি বললাম, ‘জিবরাইল! এরা কারা? উত্তরে তিনি বললেন, যারা (দুনিয়াতে) মানুষের গোশত খেত (গিবত করত) এবং মানুষের সম্মানহানি করত।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস-৪৮৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস-১৩৩৪০) গিবত করা হয় মূলত নিজের জিহ্বাকে সংযত না করার ফলে। আমরা অনেক সময় বুঝে না বুঝে বা শুনা কথা নিয়ে মন্দ ধারণা ভেতরে পোষণ করে অন্য মানুষ সম্পর্কে গিবত করে যাই। বলতে অবশ্যই দ্বিধা নেই, গিবত চর্চাটা অপেক্ষাকৃত নারীদের ক্ষেত্রেই বেশিই হয়, পুরুষ যে পিছিয়ে রয়েছে তাও কিন্তু নয়। কয়েকজন মানুষ একত্রিত হলেই আমরা বেশির ভাগ অন্যের দোষ-ক্রটি চর্চা করতে থাকি, অথচ কোনো কোনো স্থলে আলোচনার সেই দোষটা অন্যের চেয়ে নিজের যে বেশি তা আমরা খেয়ালই করি না। আল্ল‍াহ পাক আল কুরআনে গিবত, পরনিন্দাকারী সম্পর্কে বলেন, ‘দুর্ভোগ প্রত্যেক ওই ব্যক্তির, যে পেছনে ও সামনে মানুষের নিন্দা করে বা দোষ বলে বেড়ায়।’ (সূরা হুমাজাহ : আয়াত-১)
‘নবীজী সা: বলেন, ‘পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস-১০৫; শুআবুল ঈমান, বায়হাকি, হাদিস-১০৫৯০) আমরা যা কিছু করি বা বলি না কেন, সবই মহান আল্ল‍াহ তায়ালা দেখেন এবং শুনেন, আর তাই অযথা অন্যের কর্ম নিয়ে আলোচনা করার জন্য মহান আল্ল‍াহ কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।
অন্যের দোষ বলা যাবে শুধু সেই ক্ষেত্রে যেখানে অত্যাচার হয়, আর সেই অত্যাচার, নির্যাতন নিরসনে। অর্থাৎ কাজী বা বিচারকের কাছে গিয়ে বলা- অমুক মন্দ ব্যক্তি আমার এই ক্ষতি করেছে বা আমার ওপর অত্যাচার করেছে। আর এহেন সমাধানকল্পে অন্যের দোষ প্রকাশে অনুমতি রয়েছে। তা ব্যতীত কোনো ব্যক্তির আড়ালে তার মন্দ দিক নিয়ে সমালোচনা করা থেকে আল্লাহ আমাদের হিফাজত করুক। আমরা আমাদের জবানের নিয়ন্ত্রণ করে ইহকাল এবং পরকালে শুদ্ধ একটি জীবন ও সমাজ বিনির্মাণ করতে পারি সেই প্রত্যাশা। জাজাকাল্ল‍াহ খায়রান। লেখক: শিক্ষার্থী




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com