দেশে পুরনো ল্যাপটপ আমদানি নিষিদ্ধ হলেও প্রযুক্তি পণ্যের বাজারেই মিলছে এসব। সাধারণ থেকে শুরু করে নামি-দামি ব্র্যান্ড, এমনকি কম কনফিগারেশন থেকে শুরু করে কোর আই-সেভেন ল্যাপটপও পাওয়া যাচ্ছে। রিফার্বিশ বা পুরনো এসব ল্যাপটপের বাজার এখন বেশ জমজমাট। এই বাজার থেকেই কেনা ল্যাপটপে চাহিদা মিটছে ক্রেতাদের। বাজারে নতুন ল্যাপটপের (সাশ্রয়ী দামের) সংকট থাকায় কম দামের মধ্যে পুরনো ল্যাপটপের প্রতি ঝুঁকছেন ক্রেতারা।
করোনাকাল দীর্ঘায়িত হওয়ায় ল্যাপটপের সংকটও সহসাই কাটছে না। নতুন বছরের প্রথম কোয়ার্টার নাগাদ সংকট কাটতে পারে। বিষয়টি বুঝতে পেরেই পুরনো ল্যাপটপের বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। এরইমধ্যে দাম বেড়েছে পুরনো ল্যাপটপেরও। ব্র্যান্ড ও মডেল ভেদে প্রতিটি ল্যাপটপের দাম বেড়েছে ৭-৮ হাজার টাকা। সাধারণ মানের প্রতিটি ল্যাপটপে অন্তত ৫ হাজার টাকা দাম বেড়েছে আগের থেকে। গত ২৩ নভেম্বর রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের (ইসিএস কম্পিউটার সিটি) কয়েকটি তলা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। এটি প্রযুক্তি পণ্যের বাজার হলেও এই মার্কেটে খুব নীরবে গড়ে উঠেছে পুরনো ল্যাপটপের বাজার। মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের ১০ ও ১১ তলায় পুরনো ল্যাপটপের একাধিক দোকান রয়েছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেলো, পুরনো ল্যাপটপের দোকান বলে খ্যাত দুই-তিনটি ছাড়া বেশির ভাগ শো-রুম বা দোকানের তাক খালি। কয়েকটি দোকানে শূন্য তাক দেখা গেছে। যেগুলোতে পণ্য আছে, তাও পর্যাপ্ত নয়, খালি খালি দেখাচ্ছে। করোনার প্রাদুর্ভাবের আগে বিভিন্ন সময়ে এই মার্কেটে গিয়ে দেখা গেছে, দোকানগুলোতে প্রচুর ভিড় লেগেই থাকতো। সেলফগুলোতে গাদাগাদি করে ল্যাপটপ রাখা হতো। করোনার এই সময়ে দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র। পুরো মার্কেটজুড়ে নতুন ল্যাপটপের তীব্র সংকট চলছে। ফলে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এখন পুরনো ল্যাপটপের বাজারেও সংকট দেখা দিয়েছে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাকালে লকডাউনের পরে যখন মার্কেট খোলে, সে সময় নতুন ল্যাপটপ প্রচুর বিক্রি হয়। পুরনো ল্যাপটপের চাহিদাও সে সময়ে ছিল আকাশচুম্বি। দাম স্বাভাবিক সময়ের মতোই ছিল। নতুন ল্যাপটপের সংকট শুরু হলে পুরনো ল্যাপটপের চাহিদাও বাড়তে থাকে। যদিও দেশ-বিদেশে লকডাউনের কারণে সরবরাহ কমে যায়। ফলে পুরনো ল্যাপটপের দাম বাড়তে থাকে। বর্তমানে প্রতিটি ল্যাপটপ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৭-৮ হাজার টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে ক্রেতা কম থাকলে দামও কমে। এক প্রশ্নের জবাবে নাম ও পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, বর্তমানে পুরনো ল্যাপটপের সংকট যেমন আছে, পাশাপাশি দামও তুলনামূলক বেশি। ফলে বিক্রি কমেছে আগের চেয়ে। ক্রেতাদের মানসিকতাÍ ‘বেশি দাম দিয়ে কিনতে হলে আরও কিছু টাকা যোগ করে নতুন ল্যাপটপই কিনবো। ‘
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান কম্পিউটার সিটি সেন্টারে গড়ে উঠেছে অন্তত ২০টি পুরনো ল্যাপটপ বিক্রির দোকান। এলিফ্যান্ট রোডের অন্যান্য মার্কেটেও মিলবে পুরনো ল্যাপটপের দোকান।
প্রসঙ্গত, আমদানি নীতি ২০১৮-২০২১ এ যে ২১টি ক্যাটাগরির পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে রিকন্ডিশনড অফিস ইক্যুইপমেন্ট (ফটোকপিয়ার, টাইপরাইটার, টেলেক্স, ফোন, ফ্যাক্স, পুরনো কম্পিউটার ও কম্পিউটার সামগ্রী ও পুরনো ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী)। একনেক বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৮-২০২১ তিন বছর মেয়াদি আমদানি নীতি উপস্থাপন করা হলে, তা পর্যালোচনা শেষে অনুমোদন দেওয়া হয়। তারপরও আমদানি হচ্ছে পুরনো ল্যাপটপ।
জানা যায়, পুরেনো ল্যাপটপ বিক্রেতারা ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, ব্রাজিল, মেক্সিকো, দুবাই ও সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসব (স্বল্প ব্যবহৃত বা বিভিন্ন প্রকল্পে স্বল্প সময়ে ব্যবহার করা) ল্যাপটপ সংগ্রহ করেন। কখনও সরাসরি, কখনও দুবাই বা সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন এজেন্টদের মাধ্যমে তারা ল্যাপটপ সংগ্রহ করেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, দুবাই বা সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন প্ল্যান্টে এসব ল্যাপটপ সংস্কার করে বাংলাদেশের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। ব্যবসায়ীরা জানান, লকডাউনের পর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক না হওয়ায় এই মার্কেটে পুরনো ল্যাপটপের সরবরাহ কমে গেছে। পণ্য সংকটের কারণে দামও বেড়ে গেছে। তারা জানান, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পুরনো ল্যাপটপ সংগ্রহের পর মেরামত শেষে বিক্রি উপযোগী করে মার্কেটে আনা হচ্ছে। বিক্রিও হচ্ছে। আরও জানা গেলো, এই মার্কেটে পুরনো ও নষ্ট ল্যাপটপের মেরামতের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। ব্যবহারকারীরা ঘরে পড়ে থাকা ল্যাপটপ মেরামত করতে নিয়ে আসছেন।
বিক্রেতারা জানান, নতুন ল্যাপটপের অর্ধেক দামেরও কমে এই মার্কেটে ল্যাপটপ বিক্রি হয়। প্রায় সব ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ পাওয়া যাবে এই মার্কেটে। এমনকি অ্যাপলের ম্যাকবুক, আইপ্যাড পাওয়া যাচ্ছে। তবে বিক্রির শীর্ষে আছে এইচপি, ডেল ইত্যাদি ব্র্যান্ড।
২৩ নভেম্বর দুপুরে মার্কেটের ৯ ও ১০ তলা ঘুরে দেখা গেছে,বিভিন্ন দোকানের তাকে শোভা পাচ্ছে পুরনো ল্যাপটপ। ঝকঝকে তকতকে হওয়ায় বোঝার উপায় নেই যে, এসব ল্যাপটপ পুরনো। তবে পুরনো ল্যাপটপের জন্য বিখ্যাত এমএম ট্রেডিংয়ের তাকগুলো খালি পড়ে আছে। অবশ্য ফরাজী টেকনোলজির তাক ভর্তি পুরনো ল্যাপটপে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে জানা যায়, তারা মার্কেটে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছেন। ল্যাপটপ গ্যালারি, ল্যাপটপ ওয়ার্ল্ড, এস কম্প্টিউটার্স, সি টি ল্যাব, বিডিটেক, রিয়েল টেকনোলজিতে কম-বেশি ল্যাপটপ চোখে পড়েছে।
প্রযুক্তি ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে প্রতি মাসে নতুন ল্যাপটপ বিক্রি হয় ২২ থেকে ২৬ হাজার। করোনার আগে যা মাসে ১০-১২ হাজারে নেমে গিয়েছিল। অপরদিকে করোনার আক্রমণের আগে দেশে পুরনো ল্যাপটপ বিক্রি হতো প্রতি মাসে দুই হাজারের বেশি। বর্তমানে তা তিন থেকে সাড়ে তিন হাজারে গিয়ে পৌঁছেছে। কখনও কখনও এই সংখ্যা আরও বেশি হয় বলে জানা গেছে।
মাল্টিপ্ল্যান কম্পিউটার সিটি সেন্টারের মহাসচিব সুব্রত সরকার এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মার্কেটে পুরনো ল্যাপটপ বিক্রি আমরা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু সময় অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। পুরনো ল্যাপটপ এখন ক্রেতাদের চাহিদা মেটাচ্ছে। অনেকের সামর্থ্য নেই নতুন ল্যাপটপ কেনার, কিন্তু এই মার্কেট সেসব ক্রেতার পাশে দাঁড়িয়েছে। নতুন ল্যাপটপের পাশাপাশি পুরনো ল্যাপটপ দিয়েও ক্রেতাদের প্রয়োজন মেটাচ্ছে এই মার্কেট। এখানে কেউ যদি পুরনো ল্যাপটপ এক্সচেঞ্জ (পুরনো ল্যাপটপ বদলে কিছু টাকা দিয়ে নতুন ল্যাপটপ নেওয়া) করতে চান, তা সব সময় উন্মুক্ত। সেটার অনুমতি সব সময়ই আছে। সেটার অনুমতি আমরা দিয়েছি। দেশে করোনা সংকট কেটে গেলে হয়তো আবারও পুরনো ল্যাপটপ বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে।’