করোনা মহামারির কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সময়টাও ভালো যাচ্ছে না। পরিবেশ পরিস্থিতি কিছুই মানুষের অনুকূলে নেই। বিদায়ী বছরকে দেশের বিনোদন দুনিয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর বছর হিসেবে মনে করা হলেও মার্চে শুরু হওয়া করোনার তা-বে সবকিছুই উলট পালট হয়ে যায়। গোটা বছরটাই নানা ঘটনায় উত্তাল ছিল শোবিজ দুনিয়া। বর্ষপুঞ্জি থেকে বিদায় নিয়েছে সেই বিষেভরা ২০২০। এসেছে আরেকটি নতুন বছর। কিন্তু পুরানো বছরটিকে স্মৃতির পাতা থেকে কখনোই মুছে ফেলা যাবে না।
কারণ, উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে গত বছর নির্মিত ও মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে সবচেয়ে কম। ঢাকাই সিনেমার মন্দা দশা নতুন কিছু নয়, তবে ২০২০ সালের মতো এতটা নাজুক অবস্থায় কখনোই পড়েনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। বিভিন্ন কারণে ২০২০ সালে আশাবাদী ছিল ঢাকাই সিনেমার ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু বছর শেষে ঝুঁলিতে যুক্ত হয় শুধুই হতাশা। করোনার ডামাডালে পুরো ইন্ডাস্ট্রি থমকে যায়। গত বছর ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে মুক্তি পেয়েছে সাত্র ২৬টি সিনেমা। পরিচালক সমিতিতে নতুন ছবির নিবন্ধনও ছিল রেকর্ড পরিমান কম। তবু নতুন বছরে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা সবার।
গত বছরই নানা অনৈতিক কর্মকা-ের অভিযোগ তুলে অভিনেতা ও শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিশা সওদাগর এবং সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানকে বয়কটের ডাক দেয় চলচ্চিত্রের ১৮টি সংগঠন। এ নিয়ে কাঁদা ছুড়াছুড়ি হয়েছে বহু। শেষমেশ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ জানিয়ে জায়েদ খানই বরং প্রযোজক সমিতির কমিটি বিলুপ্ত করে দেন। তাতেও থামেনি জায়েদ-মিশাকে বয়কটের ডাক। তাদের ইস্তফা চেয়ে ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে পোস্টারও সাটানো হয়েছে। সেই বিতর্ক এখনো চলছে।
গত বছরই প্রথমবারের মতো চিত্রনায়ক শাকিব খানের ছবি মুক্তি পায় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। নাম ‘নবাব এল.এল.বি’। সেখানেও দুই দফায় বড় দুই বিতর্কের সৃষ্টি হয়। প্রথমত, অনলাইনে মুক্তি দেয়া হয় ‘নবাব এল.এল.বি’র অর্ধেক অংশ। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় দর্শকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং ছবির পরিচালক অনন্য মামুনের নামে মামলা করারও হুমকি দেন। এ ঘটনায় ছবির দুই প্রধান চরিত্র শাকিব খান এবং মাহিয়া মাহিও নিন্দা জানান। তারা এটিকে দর্শকের সঙ্গে প্রতারণা বলে উল্লেখ করেন।
দ্বিতীয় বিতর্কটি ছড়ায় ছবির একটি দৃশ্যের সংলাপকে ঘিরে। যেখানে অংশ নেন চিত্রনায়িকা অর্চিতা স্পর্শিয়া ও অভিনেতা শাহীন মৃধা। এখানে স্পর্শিয়া ধর্ষিতা নারী এবং শাহীন মৃধা পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করেন। অভিযোগ, ওই দৃশ্যের সংলাপে পুলিশকে হেয় করা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে পরিচালক এবং ওই দুই অভিনেতার নামে মামলাও করেন। সেই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে পরিচালক অনন্য মামুন ও অভিনেতা শাহীন মৃধা বর্তমানে জেলে রয়েছেন। মামলার এজারের অভিনেত্রী স্পর্শিয়ার নাম থাকলেও বিশেষ কারণে পরে তাকে বাদ দেয়া হয়।
গত বছর বন্ধ হয়েছে দেশের বেশ কিছু সিনেমা হল। ভেঙে ফেলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর তৈরি বিএফডিসির ৩,৪ নাম্বার ফ্লোর। লকডাউন কাটিয়ে আলোচনায় ছিল এফডিসির সংগঠনদের কাদা ছোড়াছুড়ি। ডুবে যাওয়া এ সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে টেনে তুলতে দরকার ভালো মানের সিনেমা। ঢাকা টাইমসের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে এমনটাই জানিয়েছিলেন প্রবীণ অভিনেতা প্রবীর মিত্র। তিনি বলেছিলেন, ‘এফডিসি এখন ভূতের বাড়ি। এখানে কাজ নেই। কাজের চেয়ে অকাজের লোকই বেশি। এফডিসির বিভিন্ন সংগঠের নানা কোন্দলই বলে দেয় সেখানে কাজের লোকের বড়ই অভাব।’
২০২০ সালে ছোটপর্দায় নাটকের তালিকাও ছিল সীমিত। করোনার কারণে টিভি চ্যানেলগুলো ছিল নাটক খরায়। লকডাউনে কাজহীন হয়ে ঘরবন্দি ছিলেন নাটক সংশ্লিষ্টরা। শুটিং বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল টেলিভিশনের সব সংগঠন। সেই নির্দেশ অগ্রাহ্য করে গত ১০ মে শুটিংয়ে অংশ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন জনপ্রিয় অভিনেতা জাহিদ হাসান। অভিযোগ উঠেছিল ছোটপর্দার আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিমের বিরুদ্ধেও। গত মে মাসের মাঝামাঝি একটি বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়ে তিনি সমালোচিত হন। অভিনয় শিল্পী সংগঠনের সভাপতি হয়ে তিনি কীভাবে আইন অমান্য করলেন- এই প্রশ্ন ওঠে বার বার!
বিদায়ী বছরেরই প্রেম-বিয়েকে কেন্দ্র করে একাধিক বার সমালোচনার মুখে পড়েন মডেল-অভিনেত্রী রাফিয়াথ রশীদ মিথিলা। সোশ্যাল মিডিয়ায় ফাঁস হয় তার কিছু আপত্তিকর স্থিরচিত্র। সেগুলোও চরম বিতর্কের জন্ম দেয়। গত বছর ওয়েব সিরিজের নামে অশ্লীল কনটেন্টও ছিল আলোচিত একটি বিষয়। এছাড়া চ ল চৌধুরী এবং শাওনে গাওয়া ‘জল ভর জল ভর রাধে’ গানটির পরিবেশনও ছিল উল্লেখ করার মতো আলোচিত ও সমালোচিত ঘটনা।
রেকর্ড সংখ্যক গুণিজনের মৃত্যু: গত বছরই বাংলার বিনোদন জগত থেকে হারিয়ে গেছে রেকর্ড সংখ্যক গুণিজন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ও সুপরিচিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। তিনি গত ২০ জুন মারা যান। ৯ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন বরেণ্য সংগীতব্যক্তিত্ব আলাউদ্দীন আলী। গত ২৪ মার্চ মারা গেছেন ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ খ্যাত প্রযোজক-পরিচালক মতিউর রহমান পানু। ক্যানসারের সঙ্গে চার বছরের লড়াই শেষে চির বিদায় নিয়েছেন অভিনেতা, নির্দেশক আলী যাকের। গত ৬ জুলাই বিদায় নেন সংগীতের নক্ষত্র এন্ড্রু কিশোর।
কিডনি ও চোখের সমস্যা নিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান অভিনেত্রী মিনু মমতাজ। গত ১৪ সেপ্টেম্বর করোনায় মারা যান নন্দিত অভিনেতা সাদেক বাচ্চু। বছরের শেষ দিকে এসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বাংলাদেশের পথনাটকের অন্যতম পুরোধা নাট্যজন মান্নান হিরা। ক্যানসারে মারা যান বরেণ্য অভিনেতা আব্দুল কাদের। এছাড়া হারানোর তালিকায় আরো রয়েছেন সুরকার সেলিম আশরাফ, অভিনেতা কেএস ফিরোজ, মহিউদ্দিন বাহার, অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী আহমেদ লীনা, ম াভিনেত্রী-নির্দেশক ইশরাত নিশাত, অভিনেতা সেলিম আহমেদ, সংগীতশিল্পী জবা চৌধুরী, চলচ্চিত্র প্রযোজক কেএম জাহাঙ্গীর খান, চলচ্চিত্র পরিচালক মহিউদ্দিন ফারুক প্রমুখ।
সংসার ভেঙেছে যেসব তারকাদের: গত বছরই দীর্ঘ নয় বছরের সংসার জীবনের ইতি টানেন ছোটপর্দার তারকা অভিনেতা জিয়াউল ফারুক অপূর্ব। দ্বিতীয় স্ত্রী নাজিয়া হাসান অদিতির সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় তার। গত বছরের জানুয়ারি বিচ্ছেদ ঘটে জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা শাবনূরের। নিজেদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় স্বামী অনিককে ডির্ভোস দেন তিনি। লকডাউন উপেক্ষা করে গত ১০ মার্চ হুট করে ৩ টাকার দেনমহরে নাট্যনির্মাতা কামরুজ্জামান রনিকে বিয়ে করেন আলোচিত-সমালোচিত চিত্রনায়িকা পরীমনি। কিন্তু তিন টাকার বিয়ে তিন মাসও যায়নি। বিয়ের কয়েকদিন পরই আলাদা থাকা শুরু হয় তাদের। অবশেষে প্রকাশ্যে আসে তাদের বিচ্ছেদের খবরও।
এক সময়ের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা মুনমুনের সংসার ভাঙে গত বছর। বিচ্ছেদ আগে হলেও প্রকাশ্যে আসে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। ২০০৯ সালে মোশাররফ হোসেন নামে এক অভিনেতাকে বিয়ে করেছিলেন মুনমুন। সালমান ও যশ নামে দুই সন্তান রয়েছে তাদের। বিয়ের এক বছর নয় মাস পর ভেঙে গেছে ছোটপর্দার অভিনেত্রী শবনম ফারিয়ার সংসার। এছাড়া ভাঙনের মুখে রয়েছে চিত্রনায়িকা তমা মির্জার সংসার। স্বামী হিশাম চিশতির থেকে তিনি আলাদা থাকছেন। পাল্টা পাল্টি মামলাও করেছেন। এ জুটির সংসার ভাঙার মধ্য দিয়েই হয়তো নতুন বছরে শুরু হতে পারে নতুন ভাঙা-গড়ার খেলা।