সব মানুষেরই কমবেশি দোষ আছে। দোষ ও গুণের সমন্বয়ে মানুষ। কিন্তু মানুষের অভ্যাস হলো সদা অন্যায় খোঁজ করে। নিজের দোষের ব্যাপারে সে অন্ধ। যারা প্রকৃত মুমিন তারা নিজের দোষ দেখে অন্যের দোষ দেখার চেয়ে বেশি।
দোষ জানার উপায় : নিজের দোষ জানতে হলে শত্রুর কাছ থেকে জানতে হবে। কবির ভাষায়-‘আপনার দোষ যদি, চাহ জানিবার, অরাতির কাছে পাবে, সন্ধ্যান তাহার’। শত্রু সদা দোষ খোঁজ করে, বন্ধু কোনো দিন বন্ধুর দোষ দেখে না। শত্রু দোষ খোঁজে দুর্বল করার জন্য, সংশোধন করার জন্য নয়। প্রকৃত বন্ধু সেই যে সংশোধন করার জন্য দোষ খোঁজে। মহানবী সা: বলেছেন, ‘এক মুমিন অপর মুমিনের আয়না। আয়নার মাধ্যমে যেমন নিজের চেহারার দাগ বা ময়লা দেখা যায়, তদ্রুপ মুমিন তার মুমিন ভাইয়ের দোষ দেখে। আয়নায় চেহারায় দাগ দেখলে ব্যক্তি যেমন তা দূর করে। মুমিন তার মুমিন ভাইয়ের মধ্যে দোষ দেখলে তা সংশোধন করে দেয়। শরিয়তের নির্দেশ হলো- কারো মধ্যে দোষ দেখলে তাকে একান্তে ডেকে তার দোষ সংশোধন করার পরামর্শ দেয়া, অন্যের কাছে তার দোষ না বলা।
মুমিন নিজের দোষ খোঁজে : নিজের দোষ নিজের সামনে হাজির করার মাধ্যমে মুমিন স্বীয় দোষ জানতে পারে। অতঃপর সে দোষ থেকে দূরে থাকে। খাদেমে রাসূল সা: হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘আমি একদা ওমর রা:-এর সাথে বের হলাম। পথিমধ্যে তিনি একটি বাগানে প্রবেশ করলেন। এমতাবস্থায় আমার ও তার মধ্যে বাগানের একটি দেয়াল আড়াল হলো। আমি তাকে বলতে শুনলাম, তিনি নিজেকে সম্বোধন করে বলছেন, ওমর ইবনুল খাত্তাব! আমিরুল মুমিনিন সাবাস! সাবাস! আল্লাহর শপথ! হে ইবনুল খাত্তাব! অবশ্যই তোমাকে আল্লাহর ভয়ে ভীত হতে হবে। অন্যথায় তিনি তোমাকে শাস্তি দেবেন’ (মুওয়াত্তামালেক হাদিস নং-৩৬৩৮, আল-বিদয়াহ ৭/১৩৫)। হজরত ওসমান রা: যখন নিজের দোষ ধরার জন্য প্রয়োজন অনুভব করতেন তখন আত্ম-সমালোচনা করতেন। আত্ম-সমালোচনা আমাদের পার্থিব জীবনে দায়িত্বশীলতা সৃষ্টি করে, পরকালীন জবাবদিহিতার চিন্তা বৃদ্ধি করে এবং বিবেককে শাণিত করে। করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভে সাহায্য করে। সর্বোপরি জীবনের উচ্চতম লক্ষ্যকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে প্রহরীর কাজ করে। আত্ম-সমালোচনা, অন্যের ত্রুটি ধরার আগে নিজের ত্রুটি ধরার শিক্ষা দেয়। অন্যের দোষ ধরার আগে নিজের মধ্যে বিদ্যমান দোষ দূর করতে উদ্বুদ্ধ করে। এর দ্বারা ব্যক্তি নিজেকে যেমন সংশোধন করে নেয়ার চেষ্টা চালাতে পারে, তেমনি অন্যের মাঝে ভুল দেখতে পেলে ভালোবাসা ও স্নেহের সাথে তাকেও শুধরে দেয়ার চেষ্টা করতে পারে। অন্যের দোষ খোঁজা নাজায়েজ : আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। নিশ্চয় কতক ধারণা গুনাহ এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারো পশ্চাতে নিন্দা না করে’ (সূরা হুজরাত-১২)। মহানবী সা: বলেছেন, ‘মুসলমানদের গিবত করো না এবং তাদের দোষ অনুসন্ধান করো না। কেননা, যে ব্যক্তি মুসলমানের দোষ অনুসন্ধান করে আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন। আল্লাহ যার দোষ খোঁজ করেন, তাকে নিজ গৃহেও লাঞ্ছিত করে দেন’ (তাফসিরে কুরতুবি, পৃষ্ঠা-২৩১)। রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেন, ‘তোমরা ধারণা করা থেকে বেঁচে থাকো, কেননা ধারণা খুবই মন্দ কথা। তোমরা অন্যের দোষ খোঁজ করো না, গোয়েন্দাগিরি করো না, হিংসা করো না, বিদ্বেষ পোষণ করো না। পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও’ (বুখারি, কুরতুবি পৃষ্ঠা-২২৯)। রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেন, ‘বাদশাহ যদি প্রজাদের দোষ খোঁজ করে তবে তাদেরকে ধ্বংস করে’ (আবু দাউদ, হাদিস নং-৪৮৮৯)। হজরত জায়েদ ইবনে আসলাম বলেন, একদা রাতে হজরত ওমর রা: ও হজরত আবদুর রহমান রা: বের হলেন। তারা দেখতে পান, একটি গৃহে আলো দেখা যায়। তারা প্রবেশের অনুমতি চাইলে অনুমতি দেয়া হয়। অতঃপর, তারা দেখতে পান, একজন পুরুষ এবং একজন নারী গান গাচ্ছে । পুরুষের হাতে একটি পেয়ালা। হজরত ওমর রা: বলেন, ‘তুমি এরূপ করছ? ‘লোকটি বলল, আপনি এরূপ করছেন, হে আমিরুল মুমিনিন! ওমর রা: আবার জিজ্ঞেস করলেন ‘এ মহিলাটি কে’? লোকটি বলল, আমার স্ত্রী। তারপর ওমর রা: জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কিসের পেয়ালা’? লোকটি বলল- পানির। হজরত ওমর রা: মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি গান গাইছিলে’? মহিলাটি তিনটি কবিতা আবৃত্তি করল। তারপর লোকটি বলল, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘দোষ খোঁজ করো না’। হজরত ওমর রা: বললেন, ‘তুমি সত্য বলেছ’। হজরত ওমর রা: নিজের ভুল বুঝতে পেরে চুপ হয়ে যান। গোপনে অথবা নিদ্রার ভান করে কারো কথাবার্তা শোনা বৈধ নয়। তবে যদি ক্ষতির আশঙ্কা থাকে কিংবা নিজের অথবা অন্য মুসলমানদের হিফাজতের উদ্দেশ্যে থাকে, তবে ক্ষতিকারীর গোপন ষড়যন্ত্র ও দুরভিসন্ধি খোঁজ করা জায়েজ’ (বয়ানুল কুরআন)। লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী