পুঁজিবাজারে ঋণ নিয়ে অনেকেই বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু শেয়ারের মূল্য পড়ে যাওয়ায় তা বিক্রি করে ঋণ সমন্বয় করতে পারছেন না। অন্যদিকে চক্রবৃদ্ধি সুদের জালে পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। অনেকের সমুদয় শেয়ার বিক্রি করেও পুঞ্জীভূত ঋণ সমন্বয় হচ্ছে না। এমনি পরিস্থিতিতে উচ্চ সুদের কবল থেকে বিনিয়োগকারীদের রক্ষা করতে এবার মার্জিন ঋণের সুদহার বেঁধে দিলো পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এখন থেকে কোনো প্রতিষ্ঠানই বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ১২ শতাংশের বেশি সুদ আদায় করতে পারবে না। এতে বছরের শুরুতেই স্বস্তিতে ফিরে পাবেন ঋণের জালে আটকে পড়া বিনিয়োগকারীরা।
এ বিষয়ে শেয়ার বাজার বিশ্লেষক আকতার হোসেন সান্নামাত গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বিএসইসির এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এতদিন মার্জিন ঋণের সুদহারের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত ছিল না। একেক মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউজ ভিন্ন ভিন্ন সুদহার আরোপ করত বিনিয়োগকারীদের ওপর। কেউ ১৪ শতাংশ, কেউ ১৫ শতাংশ আবার কেউ বা ১৬ শতাংশ সুদ আরোপ করত। অনেকেই মার্জিন ঋণ নিয়ে বর্তমান বাজার দরের চেয়ে বেশি দামে শেয়ার কিনেছিলেন। কিন্তু শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়ায় তারা তা বিক্রি করতে পারছেন না। এ দিকে ঋণের সুদহার বাড়তেই থাকে। একপর্যায়ে সমুদয় শেয়ার বিক্রি করেও মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউজের ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এ কারণে সুদহার বেঁধে দেয়ায় বিনিয়োগকারীরা অনেকটা এখন স্বস্তিতে থাকতে পারবেন।
আকতার হোসেন সান্নামাত বলেন, তবে কম সুদে ঋণ দেয়ার সক্ষমতা অর্জনের জন্য ব্রোকারেজ হাউজ বা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোকে তৈরি করতে হবে। এ জন্য বিএসইসিকেই উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, বড় বড় মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজ ব্যাংকের ঋণ ঠিকমতো পরিশোধ করায় তাদের ক্ষেত্রে ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদহার কার্যকর করেছে। অর্থাৎ তারা ব্যাংক থেকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিনিয়োগ করতে পারছে। তাদের জন্য বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী ১২ শতাংশ সুদহার কার্যকর করা সহজ হবে। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিয়েছে আর্থিকভাবে দুর্বল মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজের জন্য। তার জানা মতে, অনেক ব্রোকারেজ হাউজ বা মার্চেন্ট ব্যাংক বিনিয়োগকারীদেরকে ঋণ দেয়ার জন্য সিঙ্গেল ডিজিটে অর্থাৎ ৯ শতাংশ সুদে তহবিল সংগ্রহ করতে পারছে না। এর অন্যতম কারণ হলো তারা আগে ব্যাংক থেকে বেশি সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু বাজার পতনের কারণে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করতে পারেননি। এতে মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউজগুলো বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারেনি। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের সাথে সম্পর্ক অবনতি হতে। কারণ তারা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে না পারায় ব্যাংকের ঋণও পরিশোধ করতে পারেনি। ব্যাংকের কাছে অনেকেই খেলাপি হয়ে পড়েছে। কেউ ঋণ নবায়ন করেছেন। ব্যাংকের সাথে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাওয়ায় ব্যাংকও তাদেরকে আর কম সুদে ঋণ দিচ্ছে না। তারা এখনো ব্যাংক থেকে বেশি সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। এখন বেশি সুদে ঋণ নিয়ে কম সুদে তারা কিভাবে বিনিয়োগ করবে।
এ জন্য বিএসইসিকে এ বিষয়ে সব প্রতিষ্ঠানকে অভিন্ন সুদে ঋণ পেতে উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় কম সুদে ঋণ পাওয়ার আসায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা ছুটবেন আর্থিকভাবে সবল বড় বড় ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের দিকে। এ জন্য সিঙ্গেল ডিজিটে বা ৯ শতাংশ সুদে সব ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ পায় সে বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই বাজারে সবাই কম সুদে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করতে পারবে।
এ বিষয়ে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন মার্চেন্ট ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছায়েদুর রহমান নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আগে ঋণের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছিল না। এর ফলে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ভিন্ন হারে সুদ আরোপ করতে মার্চেন্ট ঋণের ক্ষেত্রে। এখন বিইসইসি সুদহার বেঁধে দেয়ায় অভিন্ন হারে বিনিয়োগকারীরা ঋণ নিরতে পারবেন। এটি মার্চেন্ট ঋণ সুবিধা গ্রহণকারীদের জন্য স্বস্তিদায়ক হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। প্রসঙ্গত, ব্যাংকের এক অঙ্কের সুদহার গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে। শুধু ক্রেডিট কার্ড ছাড়া প্রায় সব ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকের ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর হলেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের সুদহার এখনো ১৬ শতাংশ রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে মার্চেন্ট ঋণ ব্যবহারকারী বিনিয়োগকারীরা সুদহার কমনোর জন্য দাবি জানিয়ে আসছিল। গতকাল তা বাস্তবায়ন করল বিএসইসি।
বিএসইসি জানিয়েছে, এখন থেকে শেয়ারবাজারের ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো গ্রাহকের কাছ থেকে ঋণের বিপরীতে ১২ শতাংশের বেশি সুদ নিতে পারবে না। সাধারণত ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা ধার এনে তা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মার্জিন ঋণ হিসেবে বিতরণ করে থাকে। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলছে, ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো যে সুদে টাকা ধার নেবে, তার সাথে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ বাড়তি সুদ যোগ করতে পারবে মার্জিন ঋণের ক্ষেত্রে। তবে মার্জিন ঋণের এ সুদহার কোনোভাবেই ১২ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।