মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৩৫ পূর্বাহ্ন

তাকওয়া শ্রেষ্ঠ পাথেয়

ড. মো: আবদুল কাদের:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২১

পরকালীন জীবনে মুক্তি ও সফলতা নির্ভর করে তাকওয়া অবলম্বনের ওপর। সুন্দর ও পরিপাটি জীবন গঠনে তাকওয়ার ভূমিকা অপরিসীম। তাকওয়া অবলম্বনকারীকে মুত্তাকি বলা হয়। আল কুরআনে হিদায়াত লাভের পূর্বশর্ত হিসেবে তাকওয়ার উল্লেখ রয়েছে। এটি প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সর্বাবস্থায় আল্লাহর বিধিনিষেধ অনুসরণের নামান্তর।
তাকওয়া আরবি পরিভাষা, যার অর্থ বেঁচে থাকা, আত্মরক্ষা করা, তা থেকে দূরে থাকা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, অবস্থায় আল্লাহর স্মরণ প্রভৃতি। আল্লাহর ভয় অন্তরে লালন করার মাধ্যমে যাবতীয় অন্যায়, অপরাধ ও আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ, কথা ও চিন্তা-ভাবনা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার নাম তাকওয়া। উবাই ইবনে কাব রা: তাকওয়ার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, হে ওমর রা:! পাহাড়ের দুই ধারে কাঁটাবন, মাঝখানে সরু পথ। এমতাবস্থায় কিভাবে চলতে হবে? তিনি বলেন, গায়ে যেন কাঁটা না লাগে, সাবধানে পথ অতিক্রম করতে হবে। উবাই ইবনে কাব রা: বললেন, এটাই তাকাওয়া। তাকওয়ার সম্পর্ক অন্তরের সাথে, বাহ্যিক কোনো বেশভূষার সাথে নয়। রাসূল সা:কে তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তিনবার স্বীয় অঙ্গুলি দ্বারা বুকের বাম পাশে ইশারা করেছেন।
সালাফগণের দৃষ্টিতে তাকওয়া : তালক ইবনে হাবীব বলেন, ‘তাকওয়ার অর্থ : আল্লাহর নির্দেশ মতো তুমি তাঁর আনুগত্য করো ও তাঁর সাওয়াবের আশা রাখো এবং তাঁর নির্দেশ মতো তাঁর নাফরমানি ত্যাগ করো ও তাঁর শাস্তিকে ভয় করো। এ ছাড়া আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বলেন : তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য করা, তাঁর নাফরমানি না করা, আল্লাহকে স্মরণ করা, তাঁকে না ভোলা, তাঁর শোকর আদায় করা তাঁর কুফরি না করা।’
তাকওয়া যাবতীয় কল্যাণের আঁধার। মহান আল্লাহর কাছে সাদা-কালো ধনী-দরিদ্র আরব-অনারব প্রাচ্য-পাশ্চাত্য এর ভিত্তিতে মর্যাদার মূল্যায়ন হবে না; বরং মূল্যায়নের ভিত্তি হলো একমাত্র তাকওয়া। আল্লাহ বলেন ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে যারা তাকওয়ার অধিকারী তারাই আল্লাহর কাছে বেশি সম্মানিত’ (সূরা আল-হুজরাত : ১৩)।
তাকওয়া এমন অনিবার্য অনুষঙ্গ যে, পূর্ববর্তী সব উম্মতকে তা গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমাদের আগে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমি নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আর যদি কুফরি করো তাহলে আসমানসমূহে যা আছে এবং যা আছে জমিনে সব আল্লাহরই। আর আল্লাহ অভাবহীন, প্রশংসিত’ (সূরা আন নিসা : ১৩১)।
শুধু তাই নয়, আমাদের সালাফগণ তাদের চিঠি-পত্র, বয়ান-বক্তৃতা ও মৃত্যুর সময় তাকওয়ার অসিয়ত করতেন। ওমর ইবনে আবদুল আজীজ তার ছেলে আবদুল্লাহকে লিখেন : ‘অতঃপর আমি তোমাকে আল্লাহর তাকওয়া অর্জন করার অসিয়ত করছি, যার সাথে তোমাকে অবশ্যই সাক্ষাৎ করতে হবে, তিনি ছাড়া তোমার কোনো আশ্রয় নেই, তিনিই দুনিয়া-আখিরাতের মালিক।’
তাকওয়ার স্তর : তাকওয়ার তিনটি স্তর আছে। এক. শিরক থেকে মুক্ত হয়ে চিরস্থায়ী শাস্তি থেকে বেঁচে থাকা। দুই. যা করলে পাপ হয় অথবা ছেড়ে দিলে পাপ হয় এমন সব কিছু থেকে দূরে থাকা। তিন. নিজের অন্তরকে সত্য-সঠিক তথা আল্লাহ তায়ালা থেকে ফিরিয়ে রাখে এমন কিছু থেকে পূতপবিত্র থাকা এবং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহমুখী হওয়া।
ইমাম আল-গাজ্জালী রহ: তাকওয়ার চারটি স্তর বর্ণনা করেছেন। এক. শরিয়তে যেসব বস্তুকে হারাম করা হয়েছে, আল্লাহর ভয়ে সেসব বস্তু থেকে বিরত থাকা। যেমন, মদ্যপান, ব্যভিচার, জুয়াখেলা ও সুদ প্রভৃতি হারাম কাজ থেকে আত্মরক্ষা করা। একে বলা হয় মুমিন-মুত্তাকি। দুই. হারাম বস্তুসমূহ হতে বিরত থাকার পর সন্দেহয্ক্তু হালাল বস্তুসমূহ হতেও দূরে থাকা। এ শ্রেণীর মুত্তাকিকে বলা হয় সালিহ। তিন. সব হারাম বস্তু ও সন্দেহয্ক্তু হালাল বস্তুসমূহ হতে দূরে থাকার পর আল্লাহর ভয়ে অনেক সন্দেহবিহীন হালাল বস্তুও পরিত্যাগ করে, এ শ্রেণীকে মুত্তাকি বলা হয়।
চার. তিন শ্রেণীর তাকওয়া আয়ত্ত করার পর এমন সব হালাল বস্তু পরিত্যাগ করা যা ইবাদতে কোনোরূপ সহায়তা করে না। এ শ্রেণীর মুত্তাকিকে বলা হয় ‘সিদ্দীক’। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তাদেরই সাথে আছেন যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মপরায়ণ’ (সূরা নাহল : ১২৮)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ মুত্তাকিদের অভিভাবক-বন্ধু’ (জাসিয়া : ১৯)।
সব আমলের প্রাণ হলো তাকওয়া। বিশেষ করে ইবাদত হিসেবে যা কিছু করা হয় তা আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় হওয়ার জন্য তাকওয়া আবশ্যক। ‘আল্লাহ শুধু মুত্তাকীদের কোরবানিই গ্রহণ করে থাকেন’ (মায়িদাহ : ২৭)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না এগুলোর (কোরবানির পশুর) গোশত এবং রক্ত, বরং তাঁর কাছে পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া-মনের একাগ্রতা’ (হাজ : ৩৭)।
যে যত বেশি তাকওয়ার অধিকারী হবে সে জাগতিক জীবনে সমাজে তত বেশি মর্যাদা ও সম্মানের যোগ্য হবে এবং পরকালে আল্লাহর কাছে বেশি সম্মানিত হবে’ (হুজরাত : ১৩)। ‘আর কে কত বেশি মুত্তাকি তা নিয়ে আত্মপ্রশংসা করার কোনো সুযোগ নেই। কেননা আল্লাহই ভালো জানেন কে কত বেশি মুত্তাকি’ (নাজম : ৩২)। এছাড়া হাদিসে এসেছে, রাসূল সা:কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন ব্যক্তি সবচেয়ে সম্মানিত-মর্যাদাবান? তিনি বললেন, তাদের মধ্যে যে বেশি তাকওয়ার অধিকারী আল্লাহর কাছে সেই বেশি সম্মানিত…।’ দুনিয়ার জীবনে পারস্পরিক সুসম্পর্ক ও সৌহার্দ্য বজায় রাখতেও তাকওয়ার ভূমিকা অপরিসীম। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তাকওয়া অবলম্বন করো এবং নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন করো এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো, যদি তোমরা মুমিন হও’ (আনফাল : ১)। এ আয়াতে মহান আল্লাহ তাকওয়া অবলম্বন, নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রাখা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করাকে ঈমানের অপরিহার্য অংশ ও অবিচ্ছেদ্য দাবি বলে নির্ধারণ করেছেন।
অতএব, আজকের এই পাপ-পঙ্কিলতাপূর্ণ পৃথিবী, যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাপাচার, অনাচার, শিরক, কুফর, বিদআত, দুর্নীতি, ঘুষ আর সুদের বেড়াজাল রয়েছে। এসব থেকে একজন মুমিনকে আত্মরক্ষা করে সাবধানে জীবনের পথ অতিক্রম করতে হলে তাকওয়াকে গলার হার বানিয়ে পথ চলতে সচেষ্ট হওয়া আবশ্যক। লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com