শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১০:১৬ অপরাহ্ন

কুমিল্লার ‘শিদল শুটকির গ্রাম’ খ্যাত পেন্নাই

বাসস:
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০২১

ঘরের ভেতরে মাচায় সারি সারি হাঁড়ি। হাঁড়িগুলোতে মাছের পেটের তেল মেখে এবং শুকানো মাছে তেল মিশিয়ে হাঁড়িতে রেখে দেওয়া হয়েছে। দুই মাস পর তা শিদল শুটকি পরিণত হচ্ছে। কুমিল্লার দাউদকান্দির ‘শিদল শুটকির গ্রাম’ খ্যাত পেন্নাই। যে গ্রামের বাতাসেও শিদল শুটকির ঘ্রাণ। এখানকার বেশ কয়েকটি পরিবার সিদল শুটকি ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। পৌষ থেকে জ্যৈষ্ঠ এ তিন মাস শিদল শুটকি ব্যবসায়ীদের স্বর্ণকাল। বাজার কিংবা হাওর থেকে কাঁচা মাছ কিনে মাছের পেটের তেল হাঁড়িতে মেখে এবং শুকানো মাছে মিশিয়ে হাঁড়িতে রেখে দেন। দুই মাস পর তা শিদলে পরিণত হয়। এসব শিদল শুটকি বিক্রি করেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী, চাঁদপুরের মতলব, কচুয়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবাসহ দেশের বিভিন্ন আড়তে।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পেন্নাই গ্রামের বাসিন্দা মো. খোরশেদ আলম। তিনি শিদলের কারিগর। তাঁর দাদা অছুম উদ্দিন ব্যাপারীও ছিলেন শিদল ব্যবসায়ী। তিনি একবার প্রচুর পুঁটি মাছ কিনে আনেন। বাজার থেকে হাঁড়ি এনে মাছের পেটের তেল হাঁড়িতে মেখে এবং শুকানো মাছে মিশিয়ে হাঁড়িতে রেখে দেন। দুই মাস পর তা শিদলে পরিণত হয়। সেই শিদল নিয়ে যেতেন স্থানীয় বাজারে। এসব মাছ থেকে তীব্র একটা গন্ধ ছড়ায়। শুরুর দিকে তেমন বিক্রি হতো না। তবে ধীরে ধীরে তা জনপ্রিয়তা পায়। অছুম উদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে আবদুল খালেক শিদল তৈরি ও বিক্রির এ ধারা অব্যাহত রাখেন। খোরশেদ আলম বাসসকে বলেন, ১৯৯৭ সালের কথা। তখন তিনি সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। একদিন হঠাৎ তাঁর বাবা আবদুল খালেক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই আবদুর রশিদ ও ছোট ভাই মোর্শেদ আলম লেখাপড়া করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আর খোরশেদ আলম তাঁর বাপ-দাদার শিদলের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ধীরে ধীরে শিদলের শুঁটকি তৈরির ঝানু কারিগর হয়ে ওঠেন। খোরশেদ আলম ছাড়াও একই গ্রামের ২০টি পরিবার শুঁটকির ব্যবসায় যুক্ত। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পৌষ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত এ শিদল তৈরি করা হয়। তবে শিদল বিক্রি হয় সারা বছরই। শীতের তিন মাস তুলনামূলকভাবে শিদলের চাহিদা কম থাকে। সিলেট সদর, সৈয়দপুর সদর, গোপালগঞ্জ সদর, পটুয়াখালী সদর, সাতক্ষীরা সদর, ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে রোদে শুকানো পুঁটি মাছ এবং পুঁটি মাছের পেটির তেল কেনা হয়। সেগুলো আবার রোদে শুকিয়ে পেট কেটে, ছোট-বড় বাছাই করে পরিমাণমতো পানি দিয়ে ভিজিয়ে হাঁড়ির ভেতরে রাখা হয়। শুকনো মাছগুলো হাঁড়িতে রাখার সময় হাঁড়ির ভেতরে এবং মাছগুলোতে মাছের তেল মাখানো হয়। এরপর দুই মাস হাঁড়ির ভেতরে রেখে দেওয়া হয়। প্রতিটি হাঁড়িতে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি শুকনো মাছ রাখা হয়। বিক্রির সময় প্রতি হাঁড়িতে ৩৫ থেকে ৪২ কেজি শিদল পাওয়া যায়। প্রতি কেজি শিদল তৈরি করতে চলতি বছরে খরচ হচ্ছে ১৮০ থেকে ৫৫০ টাকা এবং বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ৬০০ টাকায়।
খোরশেদ আলম বলেন, তিনি চলতি বছরের পৌষ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত ১২০০ হাঁড়ি শিদল তৈরি করবেন। গত বছর তিনি ১ হাজার ৭০০ হাঁড়ি শিদল তৈরি করেছিলেন। শিদলের শুঁটকি দিয়ে বিভিন্ন রকমের ভর্তা তৈরি করা হয়। তা ছাড়া লতা কিংবা ঝিঙে দিয়ে শিদলের তরকারি রান্না করা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী, চাঁদপুরের মতলব ও কচুয়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবাসহ আশপাশের উপজেলার ব্যবসায়ীরা পেন্নাই গ্রামে এসে শিদল কিনে নিয়ে যান। পেন্নাই গ্রামের বাসিন্দা হাসান হায়দার, মো. ইউনুস ও নুরুজ্জামান বলেন, অতীতে বর্ষা মৌসুমে দাউদকান্দি উপজেলার খাল, বিল ও নদীতে প্রচুর পুঁটি মাছ পাওয়া যেত। এসব মাছ স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ শেষে অনেক মাছ পচে নষ্ট হতো। অনেকে অবশিষ্ট মাছগুলো রোদে শুঁকিয়ে শিদলসহ রকমারি শুঁটকি তৈরি করতেন। বর্তমানে খাল-বিল-নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় এ এলাকায় পুঁটি মাছ তেমন পাওয়া যায় না। এখন দূর থেকে শুকানো পুঁটি মাছ কিনে এনে শিদল শুঁটকি তৈরি করা হয়। কারণ অন্যান্য শুঁটকির চেয়ে শিদল শুঁটকির আলাদা একটা ঘ্রাণ থাকে। খাওয়ার সময় সে ঘ্রাণটা পাওয়া যায়। এ শুঁটকি খেলে মুখে রুচি বাড়ে। শিদল শুঁটকি কিনতে আসা ব্যবসায়ী কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার আড্ডা গ্রামের নুরুদ্দিন বলেন, তাঁদের দোকানে প্রতি মাসে দেড় হাজার কেজি পর্যন্ত শুঁটকি বিক্রি করা যায়। ক্রেতাদের মধ্যে শতকরা ৯০ জন শিদল কেনেন। এ এলাকায় পেন্নাই গ্রামেই উন্নত মানের শিদল তৈরি হয়।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com