পরশ্রীকাতরতা- এ শব্দটির সাথে আমাদের সবারই পরিচয় খুব ভালোভাবেই আছে। বিশেষ করে আমাদের চার পাশের মানুষজন, যারা আমাদের সমমানের তাদের সাথেই আমাদের ঈর্ষা তথা হিংসার ব্যাপারগুলো ঘটে। নিজের অজান্তেই ঈর্ষার আগুনে দগ্ধ হতে থাকি আমরা। কিন্তু এই নীরব ঘাতক আমাদের আত্মিক প্রশান্তি কেড়ে নিচ্ছে সে ব্যাপারে আমরা খুবই অসচেতন। যা আদতে আমাদের দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে তাল মেলাতে গিয়ে টালমাটাল আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন। যুগ সমাজ তথা চার পাশের সব কিছুকেই দোষ দেই অস্থিতিশীল পরিবার ও সমাজ সৃষ্টির জন্য। কিন্তু ব্যক্তি আমি কি ঠিক আছি? আমি কি আমার ভেতরকার রিপুগুলো নিয়ে সচেতন? আমাদের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার প্রবণতাকে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বর্ণিত করেছেন এভাবে, ‘তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা যতক্ষণ না তোমরা কবরে উপনীত হও’ (সূরা আত তাকাসুর ১-২)।
হিংসা ও ঈর্ষার মতো মন্দ রিপুগুলো এভাবেই আমাদের আত্মাকে দখল করে ফেলছে। অথচ হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা হিংসা থেকে দূরে থাকো। কেননা হিংসা মানুষের উত্তম কাজগুলোকে এভাবে ধ্বংস করে দেয়, যেমন আগুন শুকনো কাঠকে ছাই করে ফেলে’(আবু দাউদ)।
যদি নেকিই ধ্বংস হয়ে যায় অন্যের অর্জনের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে, তাহলে সত্যিকার অর্থে একজন মুমিন তথা মুসলিম হিসেবে আমাদের অর্জন কি কিছু রইল? এ ছাড়া আমরা জানি মুমিন পরস্পর এক অঙ্গের মতো এবং এমনটি ভাবা উচিত। তাহলে আমরা কেন অন্য ভাই-বোনের সম্পদ সন্তান-সন্ততি এবং সাফল্যে ঈর্ষা করব। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন সে জন্য কি তারা তাদের হিংসা করে’ (সূরা নিসা : ৫৪)?
তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করে কাউকে কোনো নেয়ামত দান করেছেন তাতে আমরা অসন্তুষ্ট হচ্ছি। আল্লাহর ফায়সালাকে মানতে কষ্ট হচ্ছে।
এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে আমরা অনৈতিক কার্যকলাপে যুক্ত হয়ে যাই। যার অধিকাংশই হয়ে থাকে তাল মিলানোর সংস্কৃতিতে নিজের অবস্থান দৃঢ় করার জন্য। ফলে নিজেরা প্রেসারে থাকি ও আপনজনদের প্রেসার দিই তাল মেলাতে। যা সবসময় সাধ্যের ভেতরে থাকে না। এতে করে সম্পর্কগুলো দেয়া নেয়া নির্ভর হয়ে যায়, অর্থ-বিত্ত যার মূল ভিত্তি। যে মানবিক গুণগুলো পারিবারিক ভিত্তি সেগুলো হারিয়ে যায় ধীরে ধীরে। ফলে দিনশেষে ভাঙনের শব্দ শোনা যায়। কিন্তু আমাদের এই চাওয়ার কোনো শেষ হয় না। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আদম সন্তানের যদি স্বর্ণে পরিপূর্ণ একটি উপত্যকা থাকে। তবে সে তাতেই সন্তুষ্ট হবে না বরং দু’টি উপত্যকা কামনা করবে। তার মুখ মাটি ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ভর্তি করা সম্ভব নয়’ (বুখারি : ৬৪৩৯, ৬৪৪০)।
প্রকৃতপক্ষে আমাদের যা কিছু আছে তার সবই সৃষ্টিকর্তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমাদের নিয়ে নিশ্চয়ই স্রষ্টার একটি সুপরিকল্পিত প্লান আছে। তাই যা কিছু নিয়ামত তিনি দিয়েছেন তার কৃতজ্ঞতা পোষণ করি। নিজের চেয়ে নিচের দিকে যাদের অবস্থান তাদের সাথে নিজেদের তুলনা করি। হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা নিজেদের চেয়ে নিম্নমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দিকে তাকাও এবং তোমাদের চেয়ে উচ্চমর্যাদাশীলদের দিকে তাকিও না। তোমাদের পর আল্লাহর দেয়া অনুগ্রহকে নিকৃষ্ট মনে না করার জন্য এটিই উৎকৃষ্ট পন্থা’ (বুখারি ও মুসলিম)।
এটি সত্য যে, পরশ্রীকাতরতা ব্যাপারটা খুবই সহজাত। নফস আমাদের অনুমতি ছাড়াই প্রলুব্ধ করে তোলে খুব সূক্ষ্মভাবে। কিন্তু এটিও আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়; যদি আমরা সচেতন হই। যখনই মনে এমন কোনো অনুভূতি আসবে তখনই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের ভাই অথবা বোনের জন্য বারাকার দোয়া করার চেষ্টা করি। কারণ যখনই আমরা বারাকার দোয়া করব, ফেরেশতারাও একই জিনিস আমাদের জন্য দোয়া করতে থাকবেন। এতে করে আমাদের নেকিও হিংসার জন্য ধ্বংস হলো না, আবার ভালো জিনিসটাও আমাদের জন্য হয়তো আল্লাহ কবুল করে নিলেন। সুতরাং প্রকৃত বিবেকবান কি কখনো তার ভাই-বোনদের হিংসা করতে পারে?