সরকারকর্তৃক কম চাল সংগ্রহ ও যথাসময়ে আমদানি ব্যর্থতা, প্রয়োজনীয় বাজার হস্তক্ষেপের অভাব, মিলারদের দৌরাত্ম্য এবং ধানের জমি ও উৎপাদন তথ্যের অসামঞ্জস্যতায় চালের দাম বেড়েছে। আলু ও পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধিতেও রয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের মজুদদারি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) এক গবেষণায় এসব বলা হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাজধানীর বিএআরসির মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশ চাল, আলু ও পেঁয়াজের প্রাপ্যতা ও দামের অস্থিরতা: একটি আন্তপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা প্রতিবেদন-২০২০’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।
ধান-চালবিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে নওগাঁ, শেরপুর, কুমিল্লা ও ঢাকা জেলা; আলুর ক্ষেত্রে মুন্সিগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর ও ঢাকা জেলা এবং পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ফরিদপুর, পাবনা, নাটোর ও ঢাকা জেলা নির্বাচন করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘সরকারের গুদামে পর্যাপ্ত চাল না থাকায় মিলাররা সুযোগ নিয়েছে। বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এই নবান্নেও চালের দাম অনেক বেশি। আমরা চিন্তা করছি, আগামী বোরোতে সংগ্রহ বাড়াব। সরকারের গুদামে চাল না থাকলে কোনোভাবেই দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’
তিনি বলেন, ‘গত বোরোর সময় ৩৬ টাকা দরে চাল কিনতে চেয়েছিলাম। সেভাবে কিনতে পারিনি। কারণ বাজারে দাম বেশি ছিল। আগের আমনে গরীব চাষীদের কাছ থেকে ৬ লাখ টন আমন কেনা হয়েছিল। তখন লটারির মাধ্যমে আমরা ধান কিনেছি। এবার এক টনও কিনতে পারিনি। ৩৬ টাকা দামে কোনো চাষী আমন দেয়নি। এবার আমাদের আমনের দাম ছিল মণপ্রতি ১ হাজার ৪০ টাকা। ময়েশ্চারের ঝামেলা এড়াতে চাষীরা আমাদের না দিয়ে ভালো দামে বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে।’
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘প্রতি বছর ২০-২৪ লাখ নতুন মুখ (জনসংখ্যা বাড়ছে) আসছে। কিন্তু জমির পরিমাণ কমছে ক্রমশ। সব ফসলই তো ধানি জমিতে জায়গা করে নিচ্ছে। এর মধ্যে ধানের উৎপাদন বাড়াতে হবে। চেষ্টা করছি উৎপাদন বাড়াতে। বর্তমানে ব্রি-২৭ ধানের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়াতে হবে। বিনা-১৬ ভালো একটা ভ্যারাইটি। বিনা-১৬ ধানটিকে ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে দ্রুত মাঠে নিয়ে যেতে হবে।’
আলু ও পেঁয়াজের দামের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এবার ১০ লাখ টন আলু উৎপাদন কম হয়েছে। চাপ পড়েছে করোনাকালে ত্রাণে আলু বিতরণ ব্যাপকভাবে করায়। তাছাড়া টিসিবির স্টোরেজেও আলু রাখার জায়গা নাই। আমাদের ৯-১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। এর বেশিরভাগই ভারত থেকে আসে। গত দুই বছর ধরে তারা আমাদের না জানিয়েই রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের আগে থেকে জানালে আমরা বিকল্প ব্যবস্থা নিতাম। পেঁয়াজের নতুন জাত বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করলেও পর্যাপ্ত বীজ পাওয়া যাচ্ছে না। সামার অনিয়নের জাত আসলেও পর্যাপ্ত পরিমাণ উঁচু জমি নাই। আমাদের দেশি ভ্যারাইটিগুলোর মানোন্নয়ন করতে হবে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদন করতে হলে উঁচু জমি লাগবে।’ গবেষণার সংক্ষিপ্ত ফলাফল উপস্থাপন করেন ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের (ইউজিভি) ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম।
চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণ উপস্থাপন করেন কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের এসএসও আব্দুস সালাম, আলুর মূল্য বৃদ্ধির কারণ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক শেখ আব্দুস সবুর, পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির কারণ উপস্থাপন করেন কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রধান আব্দুর রশীদ। গবেষণা কাজটি মূলত ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (এফজিডি) ও কী ইনফরমেন্ট ইন্টারভিউ (কেআইআই) এর মাধ্যমে প্রাথমিক ও বিভিন্ন উৎস থেকে মাধ্যমিক তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।
সরকারের ‘ব্যর্থতায়’ বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম: বাজারে চাল, পেঁয়াজ ও আলুর মতো নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার জন্য ব্যবসায়ীদের ‘সিন্ডিকেট’ এবং তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)। মঙ্গলবার ঢাকার ফার্মগেইটে বিএআরসি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে প্রতিবেদন উপস্থাপন করে রাষ্ট্রীয় এই গবেষণা সংস্থা। তাদের প্রতিবেদনে উৎপাদন তথ্যের অসামঞ্জস্যতা মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।
বিএআরসির গবেষণা দলের সমন্বয়ক ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন।
প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গত বছর বোরোর সময়ে ৩৬ টাকা দরে চাল কিনতে চেয়েছিলাম। বাজারে দাম বেশি ছিল। মূলত আগের আমনে গরিব চাষিদের কাছ থেকে ৬ লাখ টন আমন কেনা হয়েছিল। এবার এক টনও কিনতে পারিনি। ৩৬ টাকা দামে কোনো চাষি আমন দেয়নি। এবার আমাদের আমনের দাম ছিল ১ হাজার ৪০ টাকা মণপ্রতি। কিন্তু ময়েশ্চারের ঝামেলা এড়াতে চাষিরা ভালো দামে বাজারে চাল বিক্রি করে দিয়েছে।
মিলার ও পাইকাররা বাজার পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে বলে স্বীকার করেন খাদ্যমন্ত্রী। বলেন, সরকারের কাছে পর্যাপ্ত চাল না থাকায় মিলাররা সুযোগ নিয়েছে। বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আমরা চিন্তা করছি, আগামী বোরোতে সংগ্রহ বাড়াব। সরকারের গুদামে চাল না থাকলে কোনোভাবেই দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
আমদানি উন্মুক্ত করে এর সমাধানের পথ খোঁজার কথা বলেছেন রাজ্জাক। তিনি বলেন, চাল আমদানির উপর ট্যাক্স কমিয়ে ২৫ শতাংশ করেছে। কিন্তু আমদানিকারকরা বলছে, আমদানিতে এ ট্যাক্সে যে দাম পড়ে, সে দামে বাজার দরের সাথে বিক্রি করলে তাদের পোষাবে না। তারা ১০ শতাংশ করার দাবি জানাচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় চাল, আলু ও পেঁয়াজ ইত্যাদির দাম বৃদ্ধির কারণ উদঘাটনের জন্য বিএআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের নিয়ে গত বছরের ১২ নভেম্বর বিএআরসি কাউন্সিল মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সে সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনটি ‘স্টাডি টিম’ গঠন করা হয়। গবেষণা কাজটি মূলত ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (এফজিডি) এবং কি ইনফরমেন্ট ইন্টারভিউর (কেআইআই) মাধ্যমে প্রাথমিক ও বিভিন্ন উৎস থেকে মাধ্যমিক তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।
ধান-চাল বিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে নওগাঁ, শেরপুর, কুমিল্লা ও ঢাকা জেলা; আলুর ক্ষেত্রে মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর ও ঢাকা জেলা এবং পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ফরিদপুর, পাবনা, নাটোর ও ঢাকা জেলা নির্বাচন করা হয়। গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর কাউন্সিলে আয়োজিত এক কর্মশালায় স্বতন্ত্র তিনটি খসড়া প্রতিবেদন উপস্থাপিত হয়। কর্মশালার সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন মঙ্গলবার প্রকাশিত হল।