সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৪৯ অপরাহ্ন

ভাষার মাস শুরু হলো আজ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০২১

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’Í রক্তে রাঙানো সেই ফেব্রুয়ারি মাস, ভাষা আন্দোলনের মাস শুরু হলো আজ সোমবার। এ দিন থেকে ধ্বনিত হবে সেই অমর সংগীতের অমিয় বাণী। বাঙালি জাতি পুরো মাসজুড়ে ভালোবাসা জানাবে ভাষার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁদের।
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দান। কবি ফররুখ আহমদ গানে গানে বলেছেন- ‘ও আমার মাতৃভাষা বাংলাভাষা/খোদার সেরা দান/বিশ্বভাষার সবই তোমার/রূপ যে অনির্বাণ।’
প্রত্যেক জাতিরই কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্য আছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের যে এক বৈশিষ্ট্যম-িত করেছেন, তা হল আমাদের নিখাদ মাতৃভাষা প্রীতি। ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দেয়া, এভাবে রক্ত দিয়ে ভাষার প্রেমকে কালজয়ী করা যেন মাতৃপ্রেমেরই জ্বলন্ত প্রকাশ। মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে- আমি কোনো নবীই এমন পাঠাইনি, যে তাঁর জাতির মাতৃভাষায় আমার বাণী তাদের কাছে পৌঁছায়নি, যাতে করে সে তাদের কাছে আমার আয়াতগুলো পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে পারে (সূরা ইবরাহিম, আয়াত নং-৪)। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের অর্জন যে বিশ্বের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন এটি আজ আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। জাতিসংঘের অন্যতম অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কো আমাদের ভাষা আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর সব দেশেই উদযাপিত হচ্ছে মাতৃভাষা দিবস। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ফেব্রুয়ারি ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষকাল। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দুর্বার আন্দোলনে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। তারই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরে নয় মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
বস্তুত ফেব্রুয়ারি মাস একদিকে শোকাবহ হলেও অন্যদিকে আছে এর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কারণ পৃথিবীর একমাত্র জাতি বাঙালি ভাষার জন্য এ মাসে জীবন দিয়েছিল। প্রতি বছর ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় নানা কর্মসূচি। জমজমাট হয়ে উঠে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার । কিন্তু এ বছর এই কর্মসূচিতে কিছু হলেও ব্যত্যয় ঘটছে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামরির কারণে। অমর একুশের বইমেলা হচ্ছে না। অনান্য অনুষ্ঠানগুলোতে আনা হয়েছে নানান পরিবর্তন।
ফেব্রুয়ারিকে যখন আমরা ভাষার মাস বলছি, তখন অবশ্যই এটা ভাষা নিয়ে আলাপ–আলোচনা করার প্রাসঙ্গিক সময়। এই মাসে আমরা মোটা দাগে কতগুলো জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হই। যেমন, যে বাংলাকে আমরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছি, সেই ভাষার এখন কী অবস্থা। মর্যাদার দিক থেকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার যে জাতীয় অঙ্গীকারটি প্রায়ই উচ্চারিত হয়, তা কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে? মাতৃভাষা বাংলার প্রতি আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের, বিশেষত নবীন প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি কী। শিক্ষার্থী সমাজ, শিক্ষিত কর্মজীবী সমাজ, অফিস–আদালত, শিল্প–ব্যবসা, সেবা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠন, সামগ্রিকভাবে নাগরিক সমাজ বাংলা ভাষাকে কীভাবে মূল্যায়ন করে। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা আশাভঙ্গের দুঃখ বোধ করি: আমরা বলি, মাতৃভাষা বাংলা আমাদের অনাদরের শিকার হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, মাতৃভাষার প্রতি আমাদের আচরণ এখন বিমাতাসুলভ। এটা করা হয় ইংরেজি ভাষার প্রতি আমাদের আগ্রহের সঙ্গে বাংলার তুলনা করতে গিয়ে। শিক্ষিত তরুণ সমাজের কাছে আজ বাংলার গুরুত্ব নেই, কারণ বাংলা ভাষার জ্ঞান ও দক্ষতা তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে না। সেটা করে ইংরেজি ভাষা। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইংরেজির প্রাধান্য শুধু বাংলাদেশের বাস্তবতা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা। কিন্তু তার ফলে ফরাসি, জার্মান, রুশ, চীনা, জাপানি ইত্যাদি ভাষাভাষী মানুষের কাছে নিজ নিজ মাতৃভাষার গুরুত্ব, মর্যাদা, সমাদর কিছুই কমছে না। তাহলে বাঙালির কাছে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা ও সমাদর কেন কমেছে এবং আরও কমে যাচ্ছে?
এসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার দায়িত্ব জাতীয় নীতিনির্ধারকদের। ভাষার গুরুত্ব তার ব্যবহারে; জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে জাতীয়ভাবে পর্যাপ্ত উদ্যোগ কখনোই কেন নেওয়া হয়নি এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হবে। স্বাধীনতার পরপর যেসব পরিকল্পনা ও উদ্যোগের সূচনা করা হয়েছিল, সেগুলো কেন এগিয়ে নেওয়া যায়নি, তা–ও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। উচ্চ আদালতে বাংলার পূর্ণাঙ্গ প্রচলনে বাধা কোথায়, তা–ও ভেবে দেখা প্রয়োজন। সরকারি–বেসরকারি অফিস–আদালতে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলার ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
বাংলা সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের ক্রেতাসাধারণের জন্য ভোগ্যপণ্যের বিজ্ঞাপন ইংরেজি ভাষায় প্রচার করার কোনো প্রয়োজন বা উপযোগিতা নেই; এর পরিবর্তে বাংলায় বিজ্ঞাপন তৈরি ও প্রচার করা উচিত। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা প্রচারের কথা ভাবা যেতে পারে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ সব দেশি প্রতিষ্ঠানের নামফলক বাংলায় লেখা শুরু হোক, পণ্য কেনাবেচার রসিদ কেন বাংলায় হবে না? প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার সব স্তরে বাংলা ভাষা শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার। এসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা এই ভাষার মাসেই শুরু হোক।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com