দেশে বেড়েছে বিদেশি ফল চাষ। ড্রাগন, বারোমাসি থাই আম, স্ট্রবেরি, মাল্টা চাষে ঝুঁকছে কৃষকরা। উত্তর-দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে এ ধরনের ফলের ব্যাপক আবাদ হচ্ছে। বাণিজ্যিক চাষাবাদ সম্প্রসারণ করা গেলে পুষ্টির চাহিদা তো পূরণ হবেই, আমদানি কমিয়ে বাঁচানো যাবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রিকালচার বিভাগের ডিন ড. মো. আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমরা অবশ্যই বিদেশি ফল চাষ করতে চাই। এ জন্য উদ্যোগও নিয়েছি। এমনভাবে চাষ করতে চাই যাতে মৌসুম ছাড়াই ফলের চাহিদা পূরণ করতে পারি। যেমন শীতকালে আম, আর ড্রাগনের চাষ করা হচ্ছে। সারাবছরই মাল্টার চাষ করা হচ্ছে এখন। কাটিমন আম এখন গ্রামেই চাষ করা হচ্ছে। এই আম শীতকালে আমরা খেতে পারবো। এটি বেশ মিষ্টিও। তবে এখনও বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসেনি। গবেষণা চলছে। ড্রাগন ফল আমরা সারাবছরই চাষ করছি। আগামী ৫ বছরের মধ্যে আমরা সারাবছর নানা জাতের বিদেশি ফল উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে পারবো বলে আশা করি।’
ভিয়েতনামের জাতীয় ফল এটি। দেশের চুয়াডাঙ্গা, নাটোর, রাজশাহী, পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় ড্রাগনের ব্যাপক চাষ হচ্ছে। মে-জুন থেকে শুরু করে নভেম্বর পর্যন্ত ফল দেয় ড্রাগন। এই সময় বাজারে অন্য ফলও তেমন থাকে না।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এক বিঘা জমিতে ড্রাগন ফল চাষ করতে দেড় লাখ টাকার মতো প্রয়োজন হয়। চারা রোপণের ১ বছরের মধ্যে ফলন আসতে শুরু করে। প্রতিবছর এক বিঘা জমি থেকে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার ফল পাওয়া যায়। বাড়ির আঙ্গিনা, পুকুরপাড় এমনকি বাড়ির ছাদেও জনপ্রিয় হচ্ছে ড্রাগন চাষ।
এর আরেক নাম কাটিমন। দীর্ঘদিনের চেষ্টায় চুয়াডাঙ্গার কৃষক আবুল কাসেম এই আমের চাষ শুরু করেন। উনার হাত ধরেই এই আমের যাত্রা শুরু বাংলাদেশে। চারা রোপণের দেড় বছরেই ফল পাওয়া যায়। কাসেমের দেখাদেখি চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ রাজশাহীতে এখন এর চাষ শুরু হয়েছে।
জানা যায়, এই আমের মিষ্টতা ২৭ টিএসএস। যেখানে আমাদের দেশের আমের মিষ্টতা ১৫ থেকে ২১ টিএসএস। ঢাকায় এই আম বিক্রি হয় ৭০০ টাকা কেজি দরে।
মাল্টা সাইট্রাস পরিবারভুক্ত একটি বিদেশি ফল ছিল। এখন দেশে এটি এত ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে যে, এটাকে ঠিক বিদেশি বলা চলে না। রাজশাহী অঞ্চলের পাশাপাশি খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলায়ও মাল্টা চাষ হচ্ছে। কমলা আর বাতাবি লেবুর সংকরায়ণে এ ফলের সৃষ্টি। এর ইংরেজি নাম সুইট অরেঞ্জ। ভারতে বলে সান্তারা। উৎপত্তিস্থল ভিয়েতনাম, দক্ষিণ চীন ও উত্তর-পশ্চিম ভারত। রোগীর পথ্য হিসেবে মাল্টার বেশ কদর। ইদানীং মাল্টার চা-ও চলছে বেশ। ফলটি পুষ্টিতে ভরপুর। পুষ্টিবিদরা জানালেন, প্রতি ১০০ গ্রাম মাল্টার রসে ২০০ মিলিগ্রাম ক্যারোটিন ও ভিটামিন সি আছে প্রায় ৫০ মিলিগ্রাম।
ঝিনাইদহের মহেশপুরের রফিকুল ইসলাম ২০১৬ সালে দেশে দার্জিলিং কমলার চাষ করে হই চই ফেলে দিয়েছিলেন। পরে দেখা গেছে রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি যশোরেও অনেকে কমলার আবাদ করছেন। এতে করে পাহাড়ি কমলা নেমে এসেছে সমতলে।
আকর্ষণীয় বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ ও উচ্চ পুষ্টিমানের জন্য স্ট্রবেরি অত্যন্ত সমাদৃত। স্ট্রবেরি একটি ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল হলেও এতে অন্যান্য ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আছে। সরাসরি খাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন খাদ্যের সৌন্দর্য ও সুগন্ধ বৃদ্ধিতেও এর ব্যবহার আছে। স্ট্রবেরি মূলত শীতপ্রধান দেশের ফল। একসময় যারা বিদেশি ফল চাষ করতে চাইতেন, তাদের কাছে আরাধ্য ছিল এটি। পরে উষ্ণম-লীয় অঞ্চলে চাষোপযোগী জাত উদ্ভাবন করায় দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিকভাবে স্ট্রবেরি চাষ শুরু হয়। শীত মৌসুমে আমাদের দেশে তেমন কোনও ফল উৎপাদন না হলেও সাফল্যজনকভাবে স্ট্রবেরি চাষ সম্ভব। এখন দেশের ২৫টি জেলায় স্ট্রবেরি চাষ হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব হর্টিকালচারের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো আশরাফুল ইসলাম বলেন, বিদেশি ফল চাষ প্রসঙ্গে বলতে গেলে সবার আগে বলতে হয় ড্রাগন ফলের কথা। এটি আমাদের দেশের আবহাওয়ায় খুবই উপযুক্ত। চাহিদার দিক থেকেও আশাব্যঞ্জক। এতে পানি বেশি লাগে না। গোবর সার হলেই হয়। মে, জুন, জুলাই আমরা গ্রীষ্মের ফলগুলো পাই। এরপর একটা গ্যাপ হয়। সে সময়ে ড্রাগন ফলের মাধ্যমে চাহিদা পূরণ সম্ভব। আবার লেবুজাতীয় ফল বিশেষ করে মাল্টা আমরা এখন প্রায় সারা বছর পেতে পারি। পাহাড়ি এলাকায় এটি প্রচুর উৎপাদন করা হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গার দিকে কমলা উৎপাদন হচ্ছে এখন। পাহাড়ি জমিতে তো বটেই, এখন সমতলেও এসব ফল উৎপাদনের উদ্যোগ নিতে পারি।’