বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৭ পূর্বাহ্ন

প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থা ও ইসলামী আকিদা

আবু নুসাইবা মুহাম্মাদ নূরুন্নবী:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

বর্তমান বিশ্বের একক কর্তৃত্বকারী অর্থনৈতিক মতবাদ হলো পুঁজিবাদ। আর তার উপজাত হলো প্রচলিত ব্যাংকব্যবস্থা। এ দুইয়ের ওপর ইসলামী অর্থনীতি ও তার সঙ্গী ইসলামী ব্যাংকিংয়ের শ্রেষ্ঠত্ব আজ প্রমাণিত সত্য। এই শ্রেষ্ঠত্ব এক দিকে যেমন পুঁজিবাদের দার্শনিক ভিত্তির অসারতার জন্য; অন্য দিকে ইসলামী অর্থনীতির চিরন্তন ও অভ্রান্ত দর্শনের বদৌলতে।
আমরা জানি যে, পুঁজিবাদ একটি কয়েক শ’ বছরের পুরনো ইউরোপীয় অর্থনৈতিক মতবাদ। এর প্রথম উদ্ভব হয় মধ্যযুগে, ভূস্বামী ও ভূদাসদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ফলে। এই পুঁজিবাদ আধুনিকরূপে আবির্ভূত হয় ষোড়শ শতাব্দীতে, উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে। বিশেষ করে ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডসে, ১৭৬০ সালে শিল্পবিপ্লব শুরুরও আগে। তারপর বিগত ৫০০ বছরের বিশ^ অর্থনীতির ইতিহাস তো বলতে গেলে পুঁজিবাদেরই ইতিহাস। মাঝখানে ৭০ বছর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মিছে মায়া।
যত দিন ইউরোপীয় সমাজে চার্চের কর্তৃত্ব ছিল তত দিন পুঁজিবাদের একটা অন্তঃস্থ বিশুদ্ধিকরণ ব্যবস্থা ছিল। পথ চলতে গিয়ে পুঁজিবাদে কোনো ভুল ঢুকে পড়লে খ্রিষ্টান মিশনারি প-িতরা তা শুধরে দিতেন। কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপজুড়ে যে রেনেসাঁ আন্দোলন (চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত), সংস্কার আন্দোলন (ষোড়শ শতাব্দী), যুক্তিবাদী আন্দোলন (সপ্তদশ শতাব্দী) ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন (১৬৮৫-১৮১৫ খৃ.) প্রভৃতি পরিচালিত হয়েছে তার দাপটে এক সময় চার্চের কর্তৃত্ব কমে যায়; শেষ হয়ে যায় সমাজে খ্রিষ্টান মিশনারি পণ্ডিতদের প্রভাব। ফলে এসব আন্দোলনের দাবি, দর্শন ও নীতি পুঁজিবাদকে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্ন করে ফেলে। বলাই বাহুল্য, এসব আন্দোলন, বিশেষ করে যুক্তিবাদী আন্দোলন (সপ্তদশ শতাব্দী) ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের (১৬৮৫-১৮১৫ খৃ.) নেতারা অধিকাংশই ছিলেন নাস্তিক দার্শনিক। ইউরোপের কোনো বিজ্ঞানী রেশনালিস্ট সোসাইটির সদস্য ছিলেন না। রেশনালিস্টরা আওয়াজ তুললেন-
ধর্মের ভিত্তি হলো অজ্ঞতা ও কুসংস্কার; বিধাতার ধারণা মানুুুষের সৃষ্টি; বিধাতা মানুষকে সৃষ্টি করেননি, বরং মানুষই সৃষ্টি করেছে বিধাতাকে ইত্যাদি।
তারপর বলা হলো, Economics is a positive science- অর্থনীতি হলো একটি অবিমিশ্র বিজ্ঞান। এখানে নৈতিকতার স্থান নেই। অর্থনীতিতে নৈতিকতাকে টেনে আনা হলে অর্থনীতি তার স্বাভাবিক গতিপথ থেকে বিচ্যুত হবে। তখন তা আর বিজ্ঞান থাকবে না। আরো বলা হলো, চন্দ্র-সূর্যের উদয়াস্ত, বায়ুর প্রবাহ, নদীর স্র্রোত প্রভৃতির মতো অর্থনীতিও চলবে ফিজিক্যাল ল’ অনুযায়ী। এটা পারফেক্ট, এর কোনো পরিবর্তন নেই। তারা বলল, মানুষ কাজ করবে শুধু ব্যক্তি স্বার্থে- টাকার জন্য। এর বাইরে তার কাজ করার অন্য কোনো প্রণোদনা নেই।
এসব দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে পরিচালিত আন্দোলনের ফলে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেল অমানবিতা ও নীতিহীনতা। এর অনিবার্য ফল হিসেবে সমাজে ও অর্থনীতিতে মৃত্যু হলো নৈতিক মূল্যবোধের। যুক্তিবাদ (Rationalism) নৈতিকতার শূন্যস্থান পূরণ করে নিলো। আবির্ভাব ঘটল বস্তুবাদের (Materialism). বস্তুবাদের হাত ধরে এলো সোশ্যাল ডারউইনিজম। Survival of the fittest and Natural selection. বলা হলো, গরিব যোগ্যতার অভাবে রোজগার করতে পারে না। রোজগার করতে না পারায় খেতে পায় না। খেতে না পেয়ে মারা পড়ছে। এখানে আমার কী করার আছে? যোগ্যরাই তো টিকে থাকবে!
এই যে ধারণাগুলো-ক. ধর্মের ভিত্তি হলো অজ্ঞতা ও কুসংস্কার; খ. বিধাতা মানুষকে সৃষ্টি করেননি, বরং মানুষই সৃষ্টি করেছে বিধাতাকে; গ. অর্থনীতিতে নৈতিকতার স্থান নেই, এটি একটি positive science positive ঘ. অর্থনীতি হলো পারফেক্ট, এর কোনো পরিবর্তন নেই; ঙ. মানুষ কাজ করবে শুধু ব্যক্তি স্বার্থে- টাকার জন্য। এর বাইরে তার কাজ করার অন্য কোনো প্রণোদনা নেই- এগুলো ইসলামের মৌলিক বি‍শ্বাস তথা তাওহিদ, খিলাফাহ ও আদালাহ-এর সাথে সাংঘর্ষিক।
অর্থনৈতিক লেনদেনের সাথে মুসলমানদের আকিদার এই সঙ্ঘাত এড়াতে উদ্ভব ঘটেছে ইসলামী অর্থনীতি ও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের। ইসলামী ব্যাংকিং হলো Asset based অন্যদিকে প্রচলিত ব্যাংকিং হলো Debt based. ইসলামী ব্যাংকিং যেখানে Risk Share করে সেখানে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ে যার যার ঝুঁকি তার তার। ex-ante পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে প্রচলিত ব্যাংক ঋণগ্রহীতাকে যেমন সীমাহীন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয় তেমনি সে নিজেও গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত নিতে গিয়ে ঝুঁকির মধ্যে নিপতিত হয়। এ ছাড়া সুদের লেনদেনের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর পক্ষ থেকে যুদ্ধ ঘোষণার ভয়াবহতা তো রয়েছেই।
এসব কারণে বিশ্বময় ইসলামী ব্যাংকিংয়ের কদর দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কদরের দু’টি দিক : ধর্মীয় ও দার্শনিক। মুসলমানদের কাছে তার কদর বৃদ্ধির কারণ ধর্মীয় হলেও অমুসলিমদের কাছে তার আবেদন দার্শনিক, যা এতক্ষণ আলোচনা করা হলো। এই জনপ্রিয়তার কারণে একদিকে যেমন নতুন নতুন ইসলামী ব্যাংক ও ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, অন্যদিকে তেমনি প্রচলিত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও তাদের বিদ্যমান খোল-নলচে পাল্টে ইসলামী অবয়ব ধারণ করছে। ইসলাম ও তার অর্থব্যবস্থার আসল সিক্রেট কি?
ইসলামের সার্বজনীনতা (Inclusiveness in Islam): ইসলামের সর্বজনীনতা বা অর্ন্তর্ভুক্তিমূলক আদর্শ মানে ইসলাম সব যুগের ও সব স্থানের জন্য। এখানে ব্যক্তি মানুষের পরিচয় কোনো বিষয় নয়। তিনি কে এবং কোন দেশের নাগরিক তা ইসলামে বিবেচ্য নয়। ইসলাম সবার ধর্ম-সবার জীবন বিধান।
ইসলামে সুদ নিষিদ্ধ: ইসলাম সুদ নিষিদ্ধ করেছে এর সর্বাত্মক জুলুমের কারণে। সুদ নিষিদ্ধে ইসলামের প্রধান লক্ষ্য হলো সম্পদ যাতে সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে পুঞ্জীভূত হতে না পারে তা নিশ্চিত করা। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার (১২৬২-১৩২৮ খৃ.) মতে, সুদের উৎপত্তি হয়েছে অভাব থেকে। গরিব মানুষ অভাবের কারণে ধনীদের কাছে টাকা ধার চায়। তখন ধনীরা এই সুদ নামক হাতিয়ারের মাধ্যমে গরিব মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে। অপর দিকে ইসলাম চায় স্বচ্ছতা ও ইনসাফভিত্তিক একটি আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে।
ইসলামী শরিয়তে রিবা: ইসলামী শরিয়তে রিবাকে দু’টি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন- ক. রিবা নাসিয়া : রিবা নাসিয়া হলো Lender কর্তৃক Borrower-কে প্রদত্ত সময়। এই সময়ের বিনিময়ে  Borrower ধারদাতাকে মূল টাকার অতিরিক্ত কিছু প্রিমিয়াম দেয়। এটাই সুদ। এটাই রিবা নাসিয়া। অর্থ শাস্ত্রের ভাষায় এটাকে বলে Time value of money. খ. রিবা ফদল : রিবা ফদল হলো ওজনে বা পরিমাণে বেশি দেয়া বা নেয়া। রিবা নাসিয়ার সম্পর্ক সময়ের সাথে; রিবা ফদলের সম্পর্ক Trade-এর সাথে।
রিবা প্রসঙ্গে কুরআন ও সুন্নাহ: কুরআন রিবাকে কঠোর ভাষায় নিন্দা করেছে। উদাহরণ স্বরূপ- কুরআন রিবাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কুরআন রিবার লেনদেনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। অন্যদিকে হাদিসে রিবার বিভিন্ন দিক বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন- ক. রিবা নিষিদ্ধকরণ; খ. রিবা লেনদেনকারীর পাপের ভয়াবহতা বর্ণনা; গ. রিবার বিভিন্ন প্রকার বর্ণনা ইত্যাদি। কুরআন ও সুন্নাহর এসব নির্দেশনা জানার পর প্রচলিত ব্যাংকারদের উচিত হলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুদের শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত করে নেয়া এবং যার যার অধিকার প্রকৃত হকদারকে ফিরিয়ে দেয়া। ইনশা আল্লাহ, পরবর্তী প্রবন্ধে আলোচিত হবে, প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তর : শরিয়তের দৃষ্টিতে করণীয় ও বর্জনীয়। লেখক : সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, পূবালী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং

 

 




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com