ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে রয়েছে ঘনিষ্ঠ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। কিন্তু পানি নিয়ে বিরোধ থেকে শুরু করে ধর্মীয় উত্তেজনা এমন অনেক বিষয় দেশ দুটির মাঝে অবিশ্বাসের বীজ বপন করেছে এবং সম্পর্কের ক্ষতি করেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনে যোগ দিতে আসছে মার্চ মাসে ঢাকা সফর করবেন। এই সফরটিকে দুই প্রতিবেশী দক্ষিণ এশীয় দেশের মধ্যে কয়েক দশকের পুরনো বন্ধুত্বের প্রতীক বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে সবকিছু ঠিকঠাক নেই।
২০২১ সালের শুরুতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন সরবরাহের বিষয়ে বিতর্ক দেখা দেয়, যাদের ভারতের পুনে ভিত্তিক সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া এর সাথে ভ্যাকসিন তৈরির অংশীদারিত্ব রয়েছে। সিরামের প্রধান নির্বাহী আদার পুনাওয়ালা বলেছিলেন, ভারতের জনগণ এই ভ্যাকসিন না পাওয়ার আগ পর্যন্ত ভারত সরকার বেসরকারি বাজারে সিরামের ভ্যাকসিন বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
ওই বিবৃতিটি বাংলাদেশে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করে। কারণ বাংলাদেশ গত বছর ৩০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন পেতে ভারতের সাথে চুক্তি করেছিল। তাই, অনেক বাংলাদেশি মনে করেন, ভারত চুক্তির বাধ্যবাধকতা মানেনি। কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতকে অবিশ্বস্ত প্রতিবেশী হিসেবে চিহ্নিত করেন।
পরে পুনাওয়ালা অবশ্য আরেক বিবৃতিতে স্পষ্ট করে জানান, সব দেশেই ভ্যাকসিন রপ্তানির অনুমোদন আছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.কে. আব্দুল মোমেনও নিশ্চিত করেন যে তার দেশ ভ্যাকসিন গ্রহণের পথে রয়েছে। তবু, এ ধরনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশিরা ভালোভাবে নেয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘ভ্যাকসিন নিয়ে পুনাওয়ালার বিবৃতিটি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ চুক্তি করার পর আমাদের ভ্যাকসিন দিতে অস্বীকার করার কোন মানে হয় না।’
অবিশ্বাসের কারণ প্রতিশ্রুতিগুলো না রাখা: ইয়াসমিন বেশ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করেন যে সময়গুলোতে ঢাকা মনে করেছে ভারত প্রতিশ্রুতি রাখছে না।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে, নয়াদিল্লি হঠাৎ করে পিঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর বাংলাদেশ ভারতকে সে দেশে পিঁয়াজ রপ্তানি আবার শুরু করতে বলেছিল।
ভারত বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পিঁয়াজ সরবরাহ করে, ক্রয়ের পরিমাণ বার্ষিক গড়ে ৩৫০,০০০ টনেরও বেশি। রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার পর, বাংলাদেশে পিঁয়াজের দাম ৫০ শতাংশেরও বেশি বেড়ে যায় যার ফলে সরকারকে অন্য জায়গা থেকে পিঁয়াজ সংগ্রহ এবং ভর্তুকি দিয়ে তা সরবরাহ করতে হয়।
ইয়াসমিন বলছিলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক ছিল ভালো। কিন্তু দেশটি সেই সম্পর্ক সুসংহত করার অনেক সুযোগ হাতছাড়া করেছে।”
পানি নিয়ে দুর্ভোগ: ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দুই দেশ একটি ভার্চ্যুয়াল শীর্ষ সম্মেলনে বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং পরিবহন সংযোগ বাড়ানোর মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। তবে সেখানে তিস্তা নদীর পানি ভাগ করে নেয়ার মতো ঝামেলাপূর্ণ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়, যে নদী ভারতের সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে।
পানি প্রবাহে নিচু এলাকার দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ চায় ভারত তাকে আরো বেশি তিস্তার পানির ভাগ দিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তীব্র বিরোধিতার কারণে নয়াদিল্লি এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে কোন চুক্তি করতে পারে নি।
পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের দুই রাজনীতিবিদ বলেছেন, তিস্তায় পানি সরবরাহকারী হিমবাহ ক্রমবর্ধমান গলে যাওয়ায় এবং বাংলাদেশের সাথে পানি ভাগ করলে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে খরার ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে অদূর ভবিষ্যতে এই সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা নেই।
তৃণমূল থেকে নির্বাচিত ভারতের সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্য সুখেন্দু শেখর রায় বলেন, ‘ভারত পানি ভাগাভাগি করতে চাইলে, উত্তর-পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে কিভাবে চাষের মৌসুমে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যেতে পারে সে সম্ভাবনাগুলো খুঁজে বের করতে হবে। অন্যথায়, তিস্তা নদীর পানি শুকিয়ে যাবে যেমনটা ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি চুক্তির ফলে হয়েছিল। কলকাতা বন্দরটি বাংলাদেশের দিকে পানি দিয়ে এখন মৃত। তাছাড়া, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এতোটাই নিচে নেমে গেছে যে বিভিন্ন এলাকায় আর্সেনিকের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, যাতে কয়েক মিলিয়ন মানুষের জীবন বিপন্ন। সেই অভিজ্ঞতা বাঙালিকে তিক্ত করে তুলেছে, তাই তারা তিস্তার পানির ভাগাভাগি নিয়ে উদ্বিগ্ন।’
নয়াদিল্লি-ভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) সিনিয়র ফেলো জয়িতা ভট্টাচার্য বলেন, ‘নয়াদিল্লিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সাথে এই নদীর পানির সমস্যাটি সমাধানের বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারেই নিয়েছে। তবে আমাদের বুঝতে হবে এটা সমাধানের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ একটি প্রধান অংশীদার। পশ্চিমবঙ্গ যদি নিজের অবস্থান পরিবর্তন না করে তবে এই চুক্তি সম্পাদন করা কঠিন।
চীন বাংলাদেশের দৃষ্টি আকর্ষণের আপ্রাণ চেষ্টায় মত্ত: ভারত যখন তিস্তার সমস্যাটি বাংলাদেশের সাথে সমাধানের চেষ্টা করছে, তখন চীন মঞ্চে প্রবেশ করে এবং তিস্তা নদীতে একটি সেচ প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশকে একশ’ কোটি মার্কিন ডলার প্রস্তাব দেয়। কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে বেইজিং এর সাথে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ কেবল অর্থনৈতিকভাবেই লাভবান হতে চায়।
যেমনটি জয়িতা ভট্টাচার্য বলছিলেন, ‘অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও তার অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য কোনকিছুতে চুক্তিবদ্ধ হবে। বেশ কয়েকটি বিষয়ে চীনের সাথে দেশটির মতবিরোধ রয়েছে, তাই চীনের সাথে অর্থনৈতিক চুক্তি বাংলাদেশকে ভারত থেকে দূরে সরিয়ে দেবে, এই ধারণা করা ভুল হবে।’
বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির (বিএনপি) সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘তিস্তার বিষয়টি ভারত সমাধান না করায় বাংলাদেশ সহায়তার জন্য চীনের দিকে তাকাতে বাধ্য হয়েছিল। ভারতের এখনও পদক্ষেপ নেওয়ার সময় আছে যাতে আমাদের চীন থেকে সাহায্য না নিতে হয়।’
বিবাদে যোগ দেয় পাকিস্তান: এই অঞ্চলে চীনের নিকটতম মিত্র পাকিস্তানও বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। যদিও কিছু পর্যবেক্ষক বলছেন, ইসলামাবাদ ও ঢাকার মধ্যে যে কোন অর্থবহ সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি নির্ভর করে, পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) উপর একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যে অত্যাচার চালিয়েছিল তা স্বীকার করে নিতে কেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে তার উপর। বাংলাদেশ সরকার বলছে, যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল। পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে কথা বলতে শুরু করার আগে অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা একমত। বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন, ভারতকে রেখে চীন ও পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি স্থায়ীভাবে পরিবর্তনের ভবিষ্যদ্বাণী করাটা খুব বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে যায় এবং ঢাকার উচিত তার বিদেশনীতি এবং কৌশলগত পছন্দ সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করা।