হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা: সেই মহান ব্যক্তিত্ব, ইতিহাসে যার নাম ইসলামের ত্রাণকর্তা হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত; ইসলামের প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে জান বাজি রেখে যিনি নিরলস সেবা দিয়ে সারাজীবন পরিশ্রম করেছেন। ৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় কুরাইশ বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। হজরত মুহাম্মদ সা:-এর সাথে হজরত আবু বকরের বংশলতিকা পেছনের দিকে অষ্টম পর্যায়ে একই। মুররাহ ইবনে কাব তাদের উভয়ের পূর্বপুরুষ। মুহাম্মদ সা:-এর পূর্বপুরুষের ধারা হলো মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম ইবনে আবদ মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররাহ। আর হজরত আবু বকরের পূর্বপুরুষের ধারা হলো আবদুল্লাহ ইবনে উসমান ইবনে আমির ইবনে আমর ইবনে কাব ইবনে সাদ ইবনে তায়িম ইবনে মুররাহ।
হজরত আবু বকর রা: রাসূলুল্লাহ সা:-এর বাল্যকালের সাথী ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর প্রায় সারাক্ষণ নবীজীর দরবারে পড়ে থাকতেন। কি যুদ্ধ, কি সফর সব কর্মসূচিতে সিদ্দিকে আকবর রা:-এর অবস্থান থাকত নবীজীর সান্নিধ্যে। তিনি টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ সবকিছু প্রিয় নবীজীর মিশনে উৎসর্গ করেছেন, এমনকি নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করেননি।
হিজরতের রাতে তিনি রাসূলে করিম সা:-এর সাথে পথ অতিক্রম করছিলেন। যখন সওর পর্বতের কাছে এলেন তখন বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আগে প্রবেশ করি, গর্তে বিষাক্ত প্রাণী থাকতে পারে। তারা আঘাত করলে আগে আমাকে করুক কিন্তু প্রাণ থাকতে আপনার বিন্দুমাত্র কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব না। অতঃপর তিনি রাসূলের অনুমতিক্রমে গুহায় প্রবেশ করে নিজের পরনের কাপড় ছিড়ে গুহার সমস্ত ছিদ্র বন্ধ করে দিলেন, কাপড়ের অভাবে যে চিত্র বন্ধ করতে পারেননি সেটি নিজের পায়ের গোড়ালি দিয়ে চেপে ধরলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এবার তাশরিফ আনুন। এরপর নবীজী তাঁর কোলে বিশ্রাম করছিলেন, এ সময় রাসূলুল্লাহ সা:-এর দর্শন লাভে দীর্ঘদিন ধরে গর্তে অপেক্ষমাণ একটি বিষধর সাপ সব ছিদ্র বন্ধ দেখে সিদ্দিক রা:-এর পায়ের গোড়ালি দিয়ে চেপে রাখা ছিদ্র দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু না পেরে শেষ পর্যন্ত তাঁকে দংশন করল। তবুও তিনি ছিদ্র থেকে পা সরালেন না, এমনকি একটু নড়াচড়াও করলেন না। মনে মনে বলতে লাগলেন, প্রাণ যেতে পারে কিন্তু নবীজীর আরামে ব্যাঘাত হতে দেবো না। অতঃপর সারা শরীরে বিষ ছড়িয়ে পড়লে মনের অজান্তে চোখের পানি রাসূলুল্লাহ সা:-এর চেহারা মুবারকে পড়তেই নবীজী বললেন, ‘আবু বকর! তুমি কাঁদছ কেন? তোমার কী হয়েছে? জবাবে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে সাপে কেটেছে। তখন রাহমাতুল্লিল আলামিন স্বীয় থুথু মুবারক দংশিত স্থানে লাগাতেই সমস্ত শরীরের বিষ মুহূর্তের মধ্যেই পানি হয়ে গেল এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন।
হিজরতের পর দীর্ঘ ১০ বছর নবীজীর সাথে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অভিযান ও কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে সফল ও সার্থক করেন। নবীজীর ইন্তেকালের পর দু’বছরের বেশি সময় খিলাফতের মসনদে আসীন ছিলেন। তাঁর খিলাফতকাল দীর্ঘ না হলেও তিনি একজন সফল শাসক হিসেবে ভ- নবী দাবিদারদের রিদ্দার যুদ্ধের মাধ্যমে দমন করেন এবং তৎকালীন দুটি পরাশক্তি পারস্য ও বাইজেন্টাইনদের ওপর সফল অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানের ধারাবাহিকতায় কয়েক দশকে মুসলিম খিলাফত ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যের একটিতে পরিণত হয়।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর হিজরতের সেই কঠিন মুহূর্তে সিদ্দিকে আকবরের কোরবানি, বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্য ও বন্ধুত্বের কথা ইতিহাসে চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। তাঁর সাহচর্যের কথা তো পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে ঘোষিত হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা তাওবার ৪০ নম্বর আয়াতে ‘দুই জনের মধ্যে দ্বিতীয়’ আখ্যায় তাঁর নাম অমর করে এই আত্মত্যাগী মহান ভক্তকে পুরস্কৃত করেছেন।
১৩ হিজরি জমাদিউল আখের মাসে সিদ্দিকে আকবর রা: শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি তাঁর উত্তরসূরি মনোনীত করার জন্য প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে অন্যান্য সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করে উমর ইবনুল খাত্তাব রা:কে তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে নিয়োগ দেন। অসুস্থতার মাত্রা বেড়ে গেলে আলী রা:কে ডেকে বলেন, আমি মারা গেলে আপনার সেই হাতে গোসল দেবেন, যে হাতে প্রিয় নবীকে গোসল দিয়েছেন। অতঃপর সুগন্ধি লাগিয়ে লাশ কাফন পরিয়ে নবীজীর রওজা পাকের সামনে নিয়ে রেখে নবীজীর দরবারে আবেদন করবেন- ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার বাল্যবন্ধু, যৌবনকাল ও হিজরতের সাথী আজ আপনার কদমে হাজির। এতে যদি সাড়া পাওয়া যায় তাহলে আমাকে সেখানে দাফন করবেন অন্যথায় জান্নাতুল বাকিতে (কবরস্থানে) দাফন করবেন।
সিদ্দিক আকবরের ইন্তেকালের পর (২৩ আগস্ট) নির্দেশমতো হজরত আলী রা: লাশ মোবারক রাসূলের রওজা পাকের সামনে হাজির করে উল্লিখিত আবেদন করার পর রওজা পাক থেকে স্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসে- ‘আদখিলুল হাবিবা ইলাল হাবিব’ অর্থাৎ তোমরা বন্ধুকে বন্ধুর সাথে মিলিয়ে দাও। কারণ, বন্ধুর জন্য বন্ধু অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ।’ ‘খাসায়েসুল কুবরা; সহিহ বুখারি; রজিন মিশকাত; দালায়িলুন নবুয়ত)
লেখক : আরবি প্রভাষক, রানীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাজিল মাদরাসা; খতিব, রাজানগর রানীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ