চলতি (২০২০-২১) অর্থ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সংশোধনী প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। এনইসি চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এ প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়। শেরে বাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। সচিবালয় থেকেও মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা এতে যুক্ত হন।
সংশোধনী প্রস্তাবে এডিপির আকার দুই লাখ পাঁচ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে এর আকার এক লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে এক লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়ন করা হবে ৬৩ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য শায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব ১১ হাজার ৬২৮ কোটি ৯০ লাখ টাকাসহ সংশোধিত এডিপি দুই লাখ ৯ হাজার ২৭১ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
সংশোধিত এডিপি বা চূড়ান্ত এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তা খাতে কমছে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। ফলে চূড়ান্ত উন্নয়ন বাজেট দাঁড়াচ্ছে এক লাখ সাড়ে ৯৭ হাজার কোটি টাকায়।
এতে দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট প্রকল্পসমূহের অগ্রাধিকার বিবেচনায় রাখা হয়েছে। সংশোধিত এডিপিতে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, জনসংখ্যা ও পরিবারকল্যাণ খাতে ১৪ হাজার ৯২১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে যা মূল এডিপির সাত দশমিক ৫৫ শতাংশ। মূলত কোভিড-১৯ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতকে এবারের সংশোধিত এডিপিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বেশি গুরুত্ব যেসব খাতে: এনইসি সভাশেষে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারী জানান, কোভিডের কারণে স্বাস্থ্যখাত ও দারিদ্র বিমোচনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন, আইসিটি শিক্ষার উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাসকরণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, অতিবৃষ্টি ইত্যাদির ক্ষয়ক্ষতি পুনর্বাসন সংক্রান্ত প্রকল্পে অগ্রাধিকার বেশি দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এবারের সংশোধিত এডিপি’র কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। এলাকা/অঞ্চল ভিত্তিক সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত প্রকল্পসমূহে বরাদ্দ প্রদান নিশ্চিত করা; চলতি অর্থ বছরে সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত প্রকল্পে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা; সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে/উদ্যোগে গৃহীত প্রকল্পের সহায়ক নতুন প্রকল্পকে অগ্রাধিকার প্রদান এবং বেসরকারি উদ্যোগে বাস্তবায়ন করার সম্ভাবনা রয়েছে এমন প্রকল্প আরএডিপিতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব পরিহার করা।
এডিপিতে কৃষিখাতে সাত হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে যা মোট এডিপির তিন দশমিক ৯১ শতাংশ। পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগে ১৮ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে যা মোট সংশোধিত এডিপির ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। এছাড়া পানিসম্পদ খাতে ছয় হাজার ৭০৯ কোটি ও শিল্প খাতে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ খাতে ২১ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে যা মোট এডিপি ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। শ্রম ও কর্মসংস্থান খাতে ৫৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
দেশজ সম্পদ, বৈদেশিক অর্থায়ন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ২০২০-২১ অর্থ বছরের এডিপি সংশোধন করা হয়েছে। এবার প্রথম বারের মতো অনলাইন পদ্ধতিতে সংশোধিত এডিপি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে যা বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আরেক ধাপ এগিয়ে গেলো।
মন্ত্রণালয়/বিভাগ-এর বরাদ্দ চাহিদা, অর্থ বিভাগ হতে প্রাপ্ত সম্পদ এবং সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের বিষয়টি আরএডিপি প্রণয়নে বিবেচনা করা হয়েছে। মোট প্রকল্প: সংশোধিত এডিপিতে মোট প্রকল্প এক হাজার ৮৮৬টি। এর মধ্যে স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার ১০১টি প্রকল্প রয়েছে। সংশোধিত এডিপিতে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার, অধিক কর্মসংস্থান, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়ন, মহামারি কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ করা হয়েছে। দারিদ্র বিমোচন ও দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
যেসব মন্ত্রণালয়কে প্রাধান্য: এডিপিতে ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে এক লাখ ৫০ হাজার ২৮২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে যা মোট সংশোধিত এডিপির সাড়ে ৭৬ শতাংশ। এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় সরকার বিভাগে ৩৪ হাজার ১৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে যা মোট এডিপির ১৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে ২৫ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা অনুমোদন দেয়া হয়েছে যা মোট এডিপির ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ। বিদ্যুৎ বিভাগকে গুরুত্ব দিয়ে ২১ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ১১ হাজার ৯৮৮ কোটি এবং স্বাস্থ্য সেবা বিভাগে ১১ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে যা মোট সংশোধিত এডিপির ছয় দশমিক ১১ শতাংশ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে ১০ হাজার ৯০৩ কোটি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১০ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে ৯ হাজার ৬৮৫, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে সাত হাজার ৩৬৪ কোটি এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঁচ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
নির্ধারিত সময়েই শেষ করতে হবে প্রকল্প: বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা সচিব জানান, চলতি অর্থ বছরে চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৪৪২টি শেষ করার কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব প্রকল্পের অনুকূলে নির্ধারিত অর্থ ইতোমধ্যে ছাড় হয়েছে। বৈঠকে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পগুলো এ সময়মধ্যেই শেষ করতে হবে। একইসঙ্গে অনুশাসন দেওয়া হয়েছে ভবিষ্যতে যদি কোনও প্রকল্প শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয় সেটা সেই সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে।
এডিবি বাস্তবায়নের হার কম: চলতি অর্থ বছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার তুলনমুলকভাবে কম। এ অর্থ বছরের প্রথম সাত মাসে (ফেব্রুয়ারি ২০২০) এডিপির জাতীয় অগ্রগতি ২৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মধ্যে ২৪টির অগ্রগতি জাতীয় অগ্রগতির তুলনায় ভালো। কিন্তু ৩৪টি মন্ত্রণালয়ের অগ্রগতি তুলনামূলক কম।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে প্রথম সাত মাসে এডিবি অর্জন ছিল ৩২ দশমিক ৪১ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে প্রথম সাত মাসে এডিবি অর্জন ছিলো ৩৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে প্রথম সাত মাসে এডিবি অর্জন ছিল ৩৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং ২০১৯-২০ অর্থ বছরে প্রথম সাত মাসে এডিবি অর্জন ছিল ৩২ দশমিক ৪১ শতাংশ।