বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ১১:১০ অপরাহ্ন

অগ্নিঝরা মার্চ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৫ মার্চ, ২০২১

মহান স্বাধীনতার মাস, মার্চের পঞ্চম দিন। ১৯৭১ সালের এইদিনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে সারাদেশে পূর্বঘোষিত পাঁচদিনের হরতালের তৃতীয় দিনের মতো সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক পালিত হয়। এদিকে এদিন রংপুরে কারফিউ ঘোষণা করা হয়।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তার ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ শীর্ষক পুস্তকে বর্ণনা করেন, “জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হয়ে গেছে, এ ঘোষণাটি যখন রেডিওতে প্রচার করা হয়েছে, তখন ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের সাথে কমনওয়েলথ একাদশের খেলা চলছে। মুহূর্তের মধ্যে জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, ঢাকা স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে একটি যুদ্ধক্ষেত্র। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকান-পাট সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নেমে আসে, পুরো ঢাকা শহর দেখতে দেখতে একটি মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু ঢাকা এবং সারাদেশে মিলিয়ে ৫ দিনের জন্য হরতাল ও অনির্দিষ্টকালের জন্য অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। সেই অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারকে কোনোভাবে সাহায্য না করার কথা বলেছিলেন এবং তার মুখের একটি কথায় সারা পূর্ব-পাকিস্তান অচল হয়ে গেল। অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্য কারফিউ দেয়া হলো- ছাত্র জনতা সেই কারফিউ ভেঙ্গে পথে নেমে এল। চারদিকে মিছিল, স্লোাগান আর বিক্ষোভ, সেনাবাহিনীর গুলীতে মানুষ মারা যাচ্ছে তারপরেও কেউ থেমে রইল না, দলে দলে সবাই পথে নেমে এল।”
আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদিন এক বিবৃতিতে যেসব সরকারি ও বেসরকারি অফিসের কর্মচারীদের বেতন দেয়া হয়নি সেসব অফিসে ৫ ও ৬ মার্চ বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত কাজ চালানোর নির্দেশ দেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ৫ মার্চ ভারতীয় রেডিও’র এক অপপ্রচারের প্রতিবাদ করেন। এদিন পূর্ব-পাকিস্তানের তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক এক বিবৃতিতে নিরপরাধ জনসাধারণকে হত্যা করার তীব্র নিন্দা করে যেসব ব্যক্তি অধিকার আদায়ের মহান সংগ্রামে জীবন দিয়েছেন তাদের মাগফিরাত কামনা করেন এবং অবিলম্বে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।
এদিকে ২ মার্চ সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর সৈন্যদের গুলীবর্ষণে ৫ তারিখ পর্যন্ত দেড় শতাধিক মৃত্যুর খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। টঙ্গী, খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে পুলিশের নির্বিচার গুলীতে শত শত লোক আহত হয়। বঙ্গবন্ধু ঢাকা সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে আনার দাবি জানালে সামরিক কর্মকর্তা পিন্ডির নির্দেশে ৫ মার্চ সকল সৈনিককে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা না আসায় সাহেবজাদা জেনারেল ইয়াকুব খান সিগন্যালের (টেলিগ্রাম) মাধ্যমে রাওয়ালপিন্ডিতে ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দেন। সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতার সপক্ষে বিভিন্ন সভা-মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বাংলার মেহনতী মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে।
স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত রণাঙ্গনের যোদ্ধা লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী তার ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১’ শীর্ষক গ্রন্থে একাত্তরের আজকের দিনের ঘটনাবলী সংক্ষেপে তুলে ধরেন এভাবে- “টঙ্গী শিল্প এলাকায় উত্তাল জনতার ওপর সশস্ত্র বাহিনী গুলী চালিয়ে ৪ জনকে হত্যা করলো, আহত হলো ২৫ জন। এই হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা শহরের সর্বস্তরের জনতা শহীদ মিনারে সমবেত হলো। ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ সেই সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আগামী ৭ মার্চের ভাষণ সরাসরি ঢাকা বেতার থেকে রিলে করার আহ্বান জানালেন। ঐ দিন অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান শেখ মুজিবের সাথে তার ধানমন্ডির বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন।
এদিকে, ড. দেলোয়ার হোসেন অনূদিত ও সম্পাদিত ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বৃটিশ মিডিয়ার ভূমিকা’ শীর্ষক গ্রন্থে বহির্বিশ্বেও কীভাবে মুক্তিকামী জনতা একাত্তরের ৫ মার্চ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল তার আংশিক চিত্র পাওয়া যায়। গ্রন্থটিতে উল্লেখ করা হয়, “ইয়াহিয়া খান হঠাৎ করে জাতীয় পরিষদ বসার তারিখ স্থগিত করে দেয়ার খবর লন্ডনে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে হাজার ছাত্র, যুবক, চাকরিজীবী রাজনৈতিক কর্মী এদিন পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে মিলিত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সমবেত জনতা সঙ্গত কারণেই সেদিন বিক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত ছিল। বিক্ষুব্ধ বাঙালি দূতাবাসে স্থাপিত পাকিস্তানী পতাকায় অগ্নিসংযোগ করে। সঙ্গত কারণে সেদিন থেকেই প্রবাসী বাঙালিদের সাথে পাকিস্তানের সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। আন্দোলনের এ পর্যায়ে লন্ডনের প্রবাসী বাঙালি ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বিশেষ ভূমিকা রাখেন।”
ভারতীয় ইতিহাসবিদ রাঘবনের মতে, বাংলাদেশীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেসব গ্রন্থ রচিত হয়েছে, তাতে যুদ্ধকে জাতীয় মুক্তির লড়াই হিসেবে দেখা হয়েছে। এসব গ্রন্থের গল্প বলা হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ উদ্ভব ও বিকাশের। বেশির ভাগ ভারতীয় গ্রন্থে ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে দেখা হয় তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে। এই গ্রন্থগুলোর মতে, যুদ্ধে ভারতীয় বিজয় শুধু পাকিস্তান ভেঙে টুকরোই করেনি, বরং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে যে আদর্শিক মন্ত্র ছিল তাও এ যুদ্ধ ভেঙে খান খান করে দেয়া হয়। এসব গ্রন্থের বয়ানগুলোই যে শুধু সমস্যাপূর্ণই তা নয়। এসব গ্রন্থে লেখকেরা যুদ্ধের বৈশ্বিক প্রভাবের কথা বলতে গেলে বিবেচনাই করেননি। এমনকি সবচেয়ে ভালো যে কাজ, সিশন ও রোসের বইতেও, যুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রভাবকে খাটো করে দেখা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ভারতীয় এই ইতিহাসবিদ।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com