নোবেল প্রাইজ বিজয়ী সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস গতকাল সোমবার একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত অন লাইন ভার্সনে বলেছেন,‘করোনা-ভাইরাস মহামারী পৃথিবী জন্য এক নজীরবিহীন সংকট সৃষ্টি করেছে। এই সংকট আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ব্যর্থতাগুলোর পাশাপাশি আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতাও দিন দিন উন্মোচিত করে তুলছে। জাতি সংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের অবস্থান একনজরে দেখতে পাই। আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা যেসব সমস্যা তৈরী করেছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলিকে তার একটি তালিকা হিসেবে দেখা যায়। একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে এই সমস্যাগুলোর সমাধান নিশ্চিত করতে এগুলিকে লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে মূলত আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য।’ তার লেখা নিবন্ধটি বিস্তারিত তুরে ধরা হলো: ‘জাতি সংঘ এই সমস্যাগুলি তুলে ধরার আগেও আমরা এগুলো সম্বন্ধে সম্যক অবহিত ছিলাম এবং এগুলোর সমাধানের তাগিদও অনুভব করে আসছিলাম। তবু আমরা সমস্যাগুলো উপেক্ষা করে গিয়েছি এবং পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে দিয়েছি। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও সম্পদ কেন্দ্রীকরণের বিপদ সম্বন্ধে আমরা ভালভাবেই জানতাম। একইভাবে দারিদ্র, স্বাস্থ্যসেবা, লিঙ্গ-বৈষম্য ও অন্যান্য বিষয়ে সমস্যাগুলো সম্বন্ধেও আমরা জানতাম।
এগুলোর সমাধানও আমাদের জানা ছিল। কিন্তু সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা কোন উদ্যোগ নিইনি। মানুষ ইচ্ছা করলে যে-কেনো কিছুই অর্জন করতে পারে- তার অসাধ্য কিছুই নেই। কিন্তু এরপরও আমরা সমস্যাগুলো উপেক্ষা করে গেছি। কিন্তু কেন? এর একটি ব্যাখা হতে পারে এই যে, আমরা আমাদের বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছি যে এর থেকে বের হয়ে আসার কোনো চিন্তাই আমরা করতে পারছি না। এই ব্যবস্থা যেসব সমস্যা সৃষ্টি করছে সেগুলোর সমাধানে কোনো ইচ্ছাকেই আমরা মনে স্থান দিতে পারছি না। জাতি সংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলি বিভিন্ন দেশের সরকার ও তাদের জনগণকে এগুলোর সমাধান করার চিন্তা মাথায় জাগিয়ে দেবার একটি প্রয়াস। কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্ব ব্যাপী অর্থনীতির চাকা অচল করে দিয়েছে। পৃথিবীর সব জাতি তাদের অর্থনীতির চাকা আবারো সচল করতে এবং অবস্থা মহামারী-পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আমার প্রশ্ন হলো: আমরা কেন এক বছর আগে পৃথিবীকে যেখানে রেখে এসেছিলাম আবারো সেখানটাতেই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে যাচ্ছি? আমরা তখন যেপথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিলাম সেটাকি আমাদেরকে কোন শুভ গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে এটা বিশ্বাস করছিলাম? আমরাতো পরিস্কার জানি আমাদের সেই যাত্রাপথ আমাদেরকে এই পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্বের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছিল; সেই যাত্রাপথ মানবজাতিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন প্রজাতিগুলোর একটিতে পরিণত করেছে। এটা কি আমাদের বুঝতে কষ্ট হবার বিষয় যে আমাদের পথ হতে হবে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখি? আমার নিশ্চিত বিশ্বাস আমাদের পথ হওয়া উচিত এর বিপরীত। পুরোন পথে আর নয়। পূর্বের সেই আত্মাহুতির পথে ফিরে যাওয়া পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়।
আমরা এখন মহামারীকে ধন্যবাদ জানাতে পারি যে, মহামারী আমাদের পুরোন যাত্রাপথ রুদ্ধ করে দিয়ে আমাদেরকে নতুন পথে চলার একটি সুযোগ করে দিয়েছে। এখন ঘুরে দাঁড়ানোটা আমাদের জন্য সহজ হবে। আগামী অনেকগুলি প্রজন্ম ধরে অপেক্ষা করলেও এমন একটি সুযোগ আমাদের জন্য আর নাও আসতে পারে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা আমাদের জন্য একেবারেই ঠিক হবে না।
পুরোন পথে ফিরে যাওয়া মানে তো সেই পুরোন ব্যবস্থা, পুরোন অবকাঠামো, পুরোন ধ্যান-ধারণা, পুরোন ব্যবসায়িক লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা যেগুলি আরো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, আরো সম্পদ কেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি সৃষ্টি করবে যা পৃথিবীকে মানুষের জন্য একেবারে বসবাস-অযোগ্য করে দেবে।
ভাগ্যক্রমে, আমরা কিন্তু জানি নতুন পথে যেতে হলে কীভাবে বর্তমান ব্যবস্থাটির পুনর্বিন্যাস করতে হবে। এটা করতে হবে মানুষকে বিকল্প পথে যাবার সুযোগ করে দিয়ে। বর্তমান ব্যবস্থাটি ব্যক্তির জন্য কোনো বিকল্প রাখেনি- প্রত্যেক মানুষকে পূর্বনির্ধারিত পথে চলতে বাধ্য করেছে। ব্যবসার ক্ষেত্রে শুধু এক ধরনের ব্যবসা- মুনাফা সর্বোচ্চকরণের ব্যবসা। পেশা হিসেবে একটাই পেশা। চাকুরি করা। আমরা এমন একটি ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারি যেখানে মৌলিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রে প্রত্যেক মানুষের জন্য বিকল্প উন্মুক্ত থাকবে। আর তাদের সম্মিলিত এই সিদ্ধান্তগুলি অর্থনীতির বৈশ্বিক গতিধারা নির্ধারণ করে দেবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এই বিকল্পগুলি মানুষের মধ্যে পরিচিত করা যেতে পারে যা প্রত্যেক তরুণকে যার যার পথ বেছে নেবার সুযোগ দেবে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় তরুণদের সামনে কোন বিকল্প দেয়া থাকে না, বাছাই করার কোন সুযোগ থাকে না।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি লক্ষ্য হওয়া উচিত ছাত্রদেরকে এটি বলা যে, পৃথিবীতে মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই যদি তারা সম্মিলিতভাবে তা অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। তরুণদেরকে এটা বুঝিয়ে দেয়া উচিত যে, তারা তাদের পছন্দমতো করে একটা পৃথিবী তৈরী করে নিতে পারে। তারা এই পৃথিবী নামক মহাকাশযানের “যাত্রী” নয় – তারা এর চালক। তারা এটাকে নিত্য নতুনভাবে তৈরী করে নিতে পারে এবং যেখানে যেতে চায় সেখানে নিয়ে যেতে পারে। এটা ভুল পথে গেলে এর জন্য কাউকে দায়ী করার কোনো উপায় নেই। প্রতিটি প্রজন্মের দায়িত্ব তারা পৃথিবীকে যেভাবে পেয়েছে তার চেয়ে নিরাপদ ও ভাল পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং যে গন্তব্যে পৌঁছাতে চায় সে গন্তব্যে মসৃণভাবে নিয়ে যাওয়া।
নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করতে হলে ব্যবসা সম্বন্ধে আমাদের সনাতন ধ্যান-ধারণা বদলে ফেলতে হবে। আমাদের এখন শিখিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, ব্যবসার লক্ষ্য একটাই, আর তা হচ্ছে ব্যক্তিগত মুনাফা সর্বোচ্চ করা। নতুন ব্যবস্থায় ছাত্রদেরকে শিখিয়ে দিতে হবে যে, তাদের কাছে দু’টি বিকল্প আছে – আর তা হচ্ছে ১) সর্বোচ্চ মুনাফার ব্যবসা আর ২) মুনাফাবিহীন সামাজিক ব্যবসা। মানুষ শুধু ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয় ছাত্রদের শুধু এটা না শিখিয়ে আমাদের নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের এই শিক্ষা দেবে যে, মানুষ দুই ধরনের স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয় – ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সমষ্টিগত স্বার্থ, এবং প্রত্যেক মানুষ বেছে নেবে সে কোন স্বার্থ পূরণে ব্যবসা করবে। এরকম পছন্দ করার সুযোগটা মানুষের সামনে দিলে এটাই ব্যবসার জগতে একটি মৌলিক পরিবর্তন এনে দেবে। সমষ্টিগত স্বার্থ ও ব্যক্তিগত স্বার্থের (অর্থাৎ ব্যক্তিগত মুনাফার) মধ্যে একটি পরিস্কার বিরোধ রয়েছে। এই দু’টির মধ্যে তুলনা করে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা থাকবে প্রত্যেক মানুষের কাছে। এর সঙ্গে অবশ্য আরো একটি বিকল্প এসে যাবে। একজনের সামনে বিকল্প থাকবে এটা করা বা অন্যটা করা, অথবা একই সঙ্গে এটা করা এবং অন্যটাও করা। সমষ্টিগত স্বার্থ অর্জনের জন্য আমাদের প্রয়োজন সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটি ব্যবসা – এমন এক ব্যবসা যেখানে বিনিয়োগকারীর ব্যক্তিগত মুনাফার কোনো অভিপ্রায় থাকবে না, যেখানে ব্যবসার উদ্দেশ্য হবে সমাজের সমষ্টিগত কোনো সমস্যার সমাধান করা। আমরা এর নাম দিয়েছি “সামাজিক ব্যবসা” – মানুষের সমস্যার সমাধান করতে লভ্যাংশবিহীন ব্যবসা। আমরা প্রত্যেকে বেছে নিতে পারি আমরা কে কতটুকু ব্যক্তিগত মুনাফা-প্রত্যাশী ব্যবসা আর কতটুকু সমষ্টিগত স্বার্থ অর্জনকারী-ব্যবসা সৃষ্টি করবো। অবশ্য সেগুলোকে আলাদাভাবে করতে হবে। আমাদেরকে একথা মনে রাখতে হবে যে, ব্যক্তিগত মুনাফা-প্রত্যাশী ব্যবসাও সামাজিক ব্যবসা সৃষ্টি করতে পারে, এবং সামাজিক ব্যবসাও মুনাফা-প্রত্যাশী ব্যবসা সৃষ্টি করতে পারে।
আর এইসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূলে থাকবে, একজন ব্যক্তি কোন ধরনের পৃথিবী গড়ে তুলতে চান সেই মৌলিক লক্ষ্যটি। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় বিষয় হতে হবে এই প্রশ্নটি। সকল পর্যায়ের ছাত্রদের জন্য প্রতি বছর প্রতি ক্লাশে অন্তত এক সপ্তাহের জন্য একটি তুমুল পর্যালোচনার ব্যবস্থা রাখতে হবে যেখানে তারা একটি প্রশ্নের জবাব খুঁজবে – আমরা কোন ধরনের পৃথিবী সৃষ্টি করতে চাই। আলোচনা শেষে তাদের এই সিদ্ধান্ত লিখে রাখা হবে – পরবর্তী বছর আবার সে বিষয়ে তাদের চিন্তাগুলিকে পরিচ্ছন্ন করার জন্য।
প্রত্যেক তরুণকেই সে কোন জীবিকা বেছে নেবে তা বাছাইয়ের সুযোগ দিতে হবে। এখন তরুণদের সামনে বেছে নেবার জন্য কোনো বিকল্প নেই: তাদেরকে এখন একটি লক্ষ্যেই প্রশিক্ষিত করা হয়, আর তা হলো লেখাপড়া শেষ করে চাকরি খুঁজে নেয়া। আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই যেন “চাকরির জন্য সর্বোতভাবে প্রস্তুত” এমন একটি তরুণ সমাজ তৈরী করতে ডিজাইন করা হয়েছে। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রত্যেক ছাত্রই পরিস্কারভাবে জানবে যে, প্রতিটি মানুষই উদ্যোক্তা হয়ে জন্মগ্রহণ করে। তার মধ্যে সৃজনশীলতার সীমাহীন সম্ভাবনা নিহিত আছে। তাদের সামনে দু’টি বিকল্প রয়েছে – তারা উদ্যোক্তা হতে পারে অথবা চাকরি করতে পারে। চাকরির সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সৃজনশীলতার সংঘর্ষের বিষয়টিও তাকে জ্ঞাত করা হবে। তার নিজেকে আবিস্কারের পথে অপরের হুকুম মেনে চলা বাধার সৃষ্টি করতে পারে। উদ্যোক্তা হবার মধ্যে কত রকম ঝুঁকি আছে সেটাও তাকে বুঝিয়ে বলা হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় দু’ধরনের শিক্ষার সুযোগ থাকবে – উদ্যোক্তা হবার শিক্ষা এবং চাকরিজীবি হবার শিক্ষা। ছাত্ররা নিজেরাই ঠিক করবে তারা কোন পথে যাবে। “চাকরিই জীবন” এর ভিত্তিতে গড়ে তোলা শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে হবে।
নতুন পৃথিবী গড়তে হলে আমাদেরকে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরী করতে হবে। নতুন ধরনের প্রতিষ্ঠান তৈরী করতে হলে প্রয়োজন হবে নতুন আইনের। সকল সম্পদকে মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গিয়ে সম্পদ কেন্দ্রীকরণের বর্তমান যে বিরামহীন প্রক্রিয়া তাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে, যাতে সম্পদ ও মানুষ একীভূত হতে পারে, পরস্পর থেকে দুরে সরে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে পরস্পরমূখি করে দিয়ে। তার জন্য সর্বপ্রথম দরকার একটি নতুন ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা। আমাদের বিদ্যমান ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পদ ও মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার একটি হাতিয়ার মাত্র। আমাদের প্রয়োজন হবে নতুন ধরনের ব্যাংক ব্যবস্থা যা আয়ের দিক থেকে নিচের অর্ধেক জনগণের সেবায় কাজ করবে, বিশেষ করে নারীদের জন্য। এবং এ ব্যবস্থা সবচেয়ে নিচের ১০ শতাংশ মানুষকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে। পৃথিবীর সকল দেশে ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা মানুষদের জন্য আমাদেরকে সামাজিক ব্যবসার ভিত্তিতে “নবীন উদ্যোক্তা ব্যাংক” সৃষ্টি করতে হবে। একই ভিত্তিতে অর্থাৎ সামাজিক ব্যবসার ভিত্তিতে পুঁজি সরবরাহের জন্য “নবীন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড” গঠন করতে হবে। তাদের দায়িত্ব হবে দেশের যেকোনো মানুষকে উদ্যোক্তা হবার জন্য উৎসাহিত করা এবং তার জন্য ঋণ ও পুঁজি সরবরাহ নিশ্চিত করা। তারা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে প্রতিনিয়ত ছাত্র-ছাত্রীদের জানাবে যে তারা অপেক্ষায় আছে তাদের জন্য Ñ যেকোনো সময়ে তারা যেকোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিতে চাইলে তারা সেজন্য ঋণ এবং পুঁজি নিয়ে অপেক্ষা করছে। এই ব্যবস্থা সকল দেশের জন্য প্রযোজ্য হবে – তা ধনী দেশই হোক, বা দরিদ্র দেশই হোক। এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, অর্থায়নের অভাবে কোনো দেশে কাউকে যেন উদ্যোক্তা হবার পথ ছেড়ে চাকুরি খুঁজতে বের-হতে না হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলি সামাজিক ব্যবসার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা খুবই জরুরী। তা নইলে আবার এরাই মুনাফার সন্ধানে বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ ও পুঁজি সরবরাহের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বে এবং ব্যাখ্যা দেবে যে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়। এটা আর্থিকভাবে টেকসই হয় না। যে ব্যাখ্যা আমরা বরাবরই শুনে আসছি।
ক্রমাগতভাবে সম্পদ ও মানুষের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির প্রক্রিয়ার ফলে মানুষ ও সম্পদের মধ্যে একটি বিশাল দূরত্ব বিশালতর হয়ে চলেছে। মাত্র গুটিকয়েক মানুষের হাতে পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে, আর পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ মানুষ আয়স্তরের একেবারে নীচে ঠাসাঠাসি করে জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে আমাদেরকে সম্পদ ও মানুষের মধ্যকার দূরত্ব শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। এর ফলে যেকোনো দশ শতাংশ মানুষের কাছে দশ শতাংশ সম্পদ থাকবে। সেই দশ শতাংশ মানুষ পৃথিবীর যে অঞ্চলেই বসবাস করুক না কেন। এটা মোটেই অসম্ভব কিছু নয়। পৃথিবীতে মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই। এজন্য যা দরকার তা হলো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সিদ্ধান্ত। আবার অর্থনীতির পুরোন পথে ফিরে যাবার কথায় আসি।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না “পুরোন পথে ফিরে যাওয়া”র অর্থ কী। এর মানে সেই একই ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া, একই ব্যবসায়িক লক্ষ্য, সেই একই পদ্ধতিতে একই প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের কাছে নিজেদের সোপর্দ করা, একই জিনিসগুলো করে যাওয়া যার অর্থ আরো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, মানুষ ও সম্পদের মধ্যে দূরত্ব ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে সম্পদকে মানুষের ধরাছোঁয়ার অনেক বাইরে নিয়ে যাওয়া, সেই সম্পদের মতিগতির সঙ্গে পৃথিবীর ও মানুষের ভবিষ্যতকে সঁপে দেয়া, আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স কর্তৃক আরো বেশী মানুষের কাজ কেড়ে নেয়া।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নতুন কিছু নয়। এ বিষয়ে আমাদের যা জানা দরকার তার সবই আমরা জানি। এটি পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্য একটি বিরাট হুমকি। আমরা এ-বিষয়ে যতই জানছি আমাদের কাছে এটা ততই ভীতিকর মনে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দুশ্চিন্তা বা শংকার কোনো লক্ষণই দেখা যায় না। আমরা এই ভেবে নিজেদের দায়মুক্ত রাখতে চাইছি যে, “এ ব্যাপারে আমার কিছুই করার নেই। আমাদের সরকার কখনো আমাদেরকে এ বিষয়ে কিছু করতে বলেনি। তারা নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে কিছু করছে। অবস্থা এতই খারাপ হলে তারা অবশ্যই আমাদেরকে জানাতো। আমার কাজ আমার নিজের জীবন নিয়ে ভাবা।” কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমাদের ঘরে আগুন লেগেছে, আমরা এটা জেনেও না-জানার ভান করছি, সবাইকে বুঝাবার চেষ্টা করছি যে আমরা এ নিয়ে মোটেই উদ্বিগ্ন নই। আমরা সেই জ্বলন্ত গৃহেই বিরামহীন উৎসব পালনে ব্যস্ত। এই উৎসবই আবার ঘরে লাগা আগুনে ক্রমাগত ঘৃতাহুতি দিয়ে চলেছে। এটি একটি আত্ম-বিধ্বংসী চক্রে পরিণত হয়েছে। আর আমরা এই অজুহাতে নির্বিকার আছি যে, অবস্থা এতই খারাপ হলে সরকারই নিশ্চয়ই কিছু একটা করবে। ব্যাখ্যাগুলো পরিণত হয়েছে একে অপরের উপর দায় চাপানোর খেলায়, আর এভাবেই সমস্যাগুলো উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।
আমরা অন্য প্রেক্ষাপট থেকে পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারি। যে ব্যবসাগুলি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঘটাচ্ছে সেগুলো আমাদেরই তৈরী, অন্য কোনো গ্রহ থেকে আসা আমাদের কোনো শত্রু এগুলো সৃষ্টি করেনি। এই ব্যবসাগুলি আমরা নিজেরাই পরিচালনা করছি। আর ভোক্তা হিসেবে তাদের উৎপাদিত পণ্য ক্রমবর্ধমানভাবে ব্যবহার করে আমরা বরং এই ব্যবসাগুলিকে আরো উৎসাহিত করছি, বড় করছি। আমরা বাংলাদেশ, ফান্স বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানেই থাকি-না কেন তাতে কিছু এসে যায় না। আমাদের গৃহে আগুন লেগেছে আর আমরা এই গৃহেরই ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে অবস্থান করছি। ঘরে আগুন লাগলে স্বতঃস্ফুর্তভাবে আমরা যেভাবে পারি আগুন নেভাতে যেমন এগিয়ে আসি এক্ষেত্রেও আমাদের তাই দায়িত্ব। সরকার আমাদেরকে এটা করতে বলুক বা না-বলুক। আগুন নেভানোর জন্য আমাদের হাতে সময় খুবই কম, এবং এরই মধ্যে আগুন না-নেভালে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। এখনই ব্যবস্থা না-নিলে ব্যবস্থা নেবার সুযোগই আমাদের হাতে আর থাকবে না।
আমাদের কিশোররা বড়দের চেয়ে পরিস্থিতি অনেক ভালভাবে উপলদ্ধি করতে পারছে। তারা প্রতি শুক্রবার রাস্তায় নেমে মিছিল করছে, তারা নিজেদের নাম দিয়েছে “ফ্রাইডেস ফর ফিউচার।” তারা কুণ্ঠাহীনভাবে তাদের বাবা-মা ও অন্যান্য মুরুব্বীদের এই বলে অভিযুক্ত করছে যে, তাদের দায়িত্বহীন, স্বার্থপর আচরণ তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত ধ্বংস করছে। আমাদের কিশোররা বিপদ বুঝতে পারছে এবং তারা এ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। তারা তাদের সরকার তাদেরকে কিছু বলার জন্য অপেক্ষা করছে না। আমাদের সময় হয়েছে তাদের কথা শোনার, সংকটের গুরুত্ব উপলদ্ধি করার, এবং বিপদ মোকাবেলায় আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করার।
আমি কিশোর-কিশোরীদের সচেতনতার প্রশংসা করি, যেখানে বড়রা নির্ভর করছে প্যারিস চুক্তির সফলতার উপর। প্যারিস চুক্তি আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন। এর লক্ষ্যগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নীতি নির্ধারণ এবং কর্মকাঠামো গড়ে তোলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারী কর্মপন্থাগুলিও সুনির্দিষ্ট। কিন্তু জনগণের ভূমিকা এখানে কী? সমস্যাগুলি মূলত জনগণই নানাভাবে তৈরী করেছে, আর এগুলোর সমাধানে প্রাথমিক দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। আমি মাদকাসক্ত, আমি অপেক্ষা করছি কেউ আমার হাত থেকে মাদকটা জোর করে কেড়ে নিয়ে আমাকে বাঁচাক। এই অপেক্ষা সমস্যাকে শুধু জটিলতর করবে। সমাধান হলো আমাকেই আমার আসক্তি থেকে মুক্ত করে আনতে হবে। আমার আসক্তিকে চিনে নিতে হবে। তার থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে।
তরুণরা সমস্যাগুলি বুঝতে পারছে। তারা বড়দের জাগ্রত করতে এগিয়ে এসেছে। এতে আমি উৎসাহিত বোধ করছি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে তরুণদের বর্তমান প্রজন্মই সবচেয়ে শক্তিশালী প্রজন্ম। এর কারণ এই নয় যে, তারা বেশী বুদ্ধিমান- এর কারণ এই যে, তাদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি, এমন কি গ্রামের দরিদ্র মেয়েটির কাছেও, যা মাত্র কয়েক বছর আগেও পৃথিবীর কারো কাছে ছিলনা। প্রতিটি তরুণের কাছে এখন পৃথিবীকে বদলে দেবার ক্ষমতা রয়েছে। তাদের প্রত্যেকেই এখন আলাদিনের চেরাগের দৈত্যের মতো অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের মধ্যে এই বোধ জাগ্রত করতে হবে যে, তারা আগের প্রজন্মগুলোর চেয়ে শুধু আলাদাই নয়, চিন্তা ও প্রযুক্তির শক্তিতে বহুগুণে শক্তিশালীও। তরুণদেরকে তাদের শক্তি অনুধাবন করার ক্ষমতা দেয়া এবং শিক্ষাকালীন সময়ে সে ক্ষমতা ব্যবহারের জন্য প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করাও নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাদের শক্তির বিন্দুমাত্র অংশ যেন তারা ব্যবহার না-করে অপচয় করে ফেলে।
তরুণদেরকে অবশ্যই বড় কাজ করার জন্য মানসিকভাবে তৈরী হতে হবে। তাদের নিশ্চিতভাবে বুঝতে হবে যে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা তাদের রয়েছে। তাদেরকে সাহসী হতে, বিনা প্রশ্নে যে-কোনো কিছু মেনে না নিতে এবং পুরোন আপ্তবাক্য বিনা পরীক্ষায় গ্রহণ না করতে, এবং প্রয়োজনে বড়দের সাথে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যে ধরনের পৃথিবী তারা দেখতে চায় তা তৈরীর কাজ শুরু করে দিতে হবে, এবং তা করতে হবে এখনই- একথা বলে দেরী করা যাবে না যে, বড় হয়ে করবো। তাদেরকে সবকিছু এখনই শুরু করার জন্য তৈরী হতে হবে। উত্তরাধিকার সুত্রে তারা যা পেয়েছে তার সবকিছুই তাদেরকে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া কোনো কিছুই বিতর্কের উর্দ্ধে নয়। তাদেরকে বলতে হবে যে, পুরোন পথ তাদেরকে কেবল পুরোন গন্তব্যেই নিয়ে যাবে। নতুন পথ তাদেরকেই তৈরী করে এগুতে হবে। তাদের বিশ্বাস করতে হবে যে, তারা সে কাজ করতে পারবে।
কল্পনার শক্তিতে তাদের বিশ্বাস করতে হবে। তাদেরকে সীমাহীন কল্পনায় অভ্যস্ত হতে হবে। তাদের মনে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিতে হবে যে, তারা কল্পনা করলেই একদিন তা বাস্তবে রূপ নেবে। তাদেরকে নিশ্চিত হতে হবে যে, তাদের কল্পনা কল্পনাবিলাসীর কল্পনা হবে না। এই কল্পনা হবে কল্পনাতাড়িত তরুণের নতুন পৃথিবী রচনার কল্পনা। তাদেরকে বুঝতে হবে যে-জিনিস কোনোদিন কল্পনা করা হয়নি – সেজিনিস কখনো বাস্তবে সৃষ্টি হয়না।
সাইন্স ফিকশন যেমন বিজ্ঞানের শক্তি জোগায়, তেমনি তাদেরকে সোশ্যাল ফিকশন রচনা করে সমাজ পরিবর্তনের শক্তি সংগ্রহ করতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে পৃথিবীতে মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই। শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ্বাস করতে হবে যে, যে-মানুষ কিছুদিনের মধ্যে অসাধ্যকে সাধ্য করবে সে এখন তার শিক্ষা ব্যবস্থার আওতাতেই বেড়ে উঠছে। শিক্ষা ব্যবস্থা কি তার জন্য সহায়ক পরিবেশ দিচ্ছে, নাকি তাকে দমিয়ে দেবার, এমনকি তার স্বপ্ন ভন্ডুল করার কাজে নিয়োজিত আছে। তাকে তার মতো করে প্রস্তুতি নেবার সকল সুযোগ দিতে হবে।’