সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৫ অপরাহ্ন

বুড়িগঙ্গা: শুধু বিষাক্ত কালো পানির উৎকট গন্ধ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১২ মার্চ, ২০২১

এক সময় বুড়িগঙ্গায় ছিল স্বচ্ছ টলটলে পানি। মৃদু ঢেউয়ের তালে চলত পালতোলা নৌকা। নির্বিঘেœ বুড়িগঙ্গার বুকে চলেছে স্টিমার-লঞ্চ। দুই তীরের মানুষ নদীতে মাছ ধরেছে। জলজ প্রাণী বসবাস করেছে স্বাচ্ছন্দ্যে। বিকেলে, সন্ধ্যায় মানুষ বুড়িগঙ্গার পাড়ে আড্ডা জমিয়েছে। বুড়িগঙ্গা ঢাকাবাসীকে ইলিশ মাছও উপহার দিয়েছে। সেই প্রাণোচ্ছ্বল নদী অত্যাচারে-অনাচারে, দূষণে-বিষণে এখন মৃতপ্রায়। এখন বুড়িগঙ্গার তীরে নাক চেপে ধরে হাঁটতে হয়। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদী এখন নিথর। দূষণে নদীর পানি দুর্গন্ধময় এবং আলকাতরার মতো কালো হয়ে গেছে। মানববর্জ্যরে পাশাপাশি শিল্পবর্জ্য, হাসপাতালের বর্জ্য, ইটভাটা, পলিথিন ইত্যাদির কারণে বুড়িগঙ্গা দূষিত বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এক সময় যে নদী মাছে ভরপুর ছিল, এখন সেখানে শুধু বিষাক্ত কালো পানির উৎকট গন্ধ।
দূষণের ফলে এই নদীতীরের মানুষ এমনকি বৃহত্তর এই নগরবাসীর দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই। পচা, দুর্গন্ধযুক্ত পানির কারণে বুড়িগঙ্গা পাড় হওয়া জনতা বিড়ম্বনা পোহান। বুড়িগঙ্গায় জীবিকা নির্বাহের তাগিদে খেটে খাওয়া মানুষ, শিশু, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সকলেই ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। দুর্গন্ধে নাক ভারী হয়ে এলেও করার কিছুই নেই। দুর্গন্ধ মেনে নিয়েই জীবনযুদ্ধ চালাতে হচ্ছে নদী পারা-পারের যাত্রীসাধারণ ও বুড়িগঙ্গা তীরের জনসাধারণের।
আইন করেও ঠেকানো যাচ্ছে না নদীদূষণ। দিন, মাস, বছর থেকে এখন দশক পার হলেও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণ রোধে সর্বোচ্চ আদালতের রায় কার্যকর হয়নি। আদালত দায়িত্ববানদের তলব করছেন, তিরস্কার করছেন এবং অসন্তোষও প্রকাশ করছেন। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। তারপরও হাইকোর্ট গত মঙ্গলবার বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধে ৬ মাসের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী ভবন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানায় পয়ঃনিষ্কাশন লাইন এবং সেপটিক ট্যাংক নির্মাণ করে বর্জ্য নিঃসরণের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে নির্দেশনায়।
সর্বশেষ গত বছর ৭ সেপ্টেম্বর আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করায় হাইকোর্ট ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) সতর্ক করেছেন। একই সঙ্গে রায় বাস্তবায়ন করে এক মাসের মধ্যে (২৮ অক্টোবর) আদালতে প্রতিবেদন দিতে ওয়াসার এমডিকে নির্দেশ দেয়া হয়। এ সময় আদালত বারবার সময় নেয়া এবং প্রতিশ্রুতি অনুসারে রায়ের বাস্তবায়ন না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ওয়াসার এমডি ইচ্ছাকৃতভাবে রায় প্রতিপালন করছেন না। এটা এমন কী সমস্যা, যা সবাই চাইলেও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না? সরকার নিশ্চয়ই বাধা দেয়নি, সাধারণ মানুষও আপত্তি তোলেনি। তাহলে বাধাটা কোথায়? দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা, স্বার্থসংশ্লিষ্টতা, না অন্য কিছু, আদালতকে তা জানানো হোক।
বি আইব্লিউটিএর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুড়িগঙ্গায় ৬৮টি সুয়্যারেজ সংযোগ রয়েছে, এর ৫৬টি ওয়াসার। অথচ ওয়াসা আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে জানিয়েছে, বুড়িগঙ্গায় কোনো সুয়্যারেজ সংযোগ নেই। এর আগে এ অসত্য প্রতিবেদন পেয়ে আদালত আরো বেশি অসন্তুষ্ট হয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিলেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে।
বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে ২০১০ সালে রিট আবেদনটি করা হয়। ২০১১ সালের ১ জুন তিন দফা নির্দেশনাসহ রায় দেয়া হয়। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য ফেলা বন্ধে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এবং বুড়িগঙ্গা নদীতে সংযুক্ত সব পয়ঃপ্রণালীর লাইন (সুয়্যারেজ) ও শিল্পকারখানার বর্জ্য নিঃসরণের লাইন ছয় মাসের মধ্যে বন্ধ করতে বলা হয়। ওই নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়ায় গত বছরের ৩০ এপ্রিল সম্পূরক আবেদন করে সংগঠনটি। এর ধারাবাহিকতায় গত ৪ মার্চ ওয়াসার এমডি আদালতে হাজির হয়ে রায় বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন। গত ১৮ আগস্ট ও ৭ সেপ্টেম্বর ওয়াসা দু’টি প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে আদালত সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
ওয়াসা ছাড়াও বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে অনেক কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টতা আছে, যারা দায় এড়াতে পারে না। আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে এসব কর্তৃপক্ষকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ বুড়িগঙ্গা দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ঢাকা জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরকে মামলার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ঢাকার কেরানীগঞ্জের ৩০টি ওয়াশিং প্ল্যান্টসহ বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের জন্য দায়ী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও কারখানার বিরুদ্ধে ১ মাসের মধ্যে মামলা করার নির্দেশ দিলেও এখনো তা কার্যকর হয়নি। ৩০টি কোম্পানির মধ্যে গত দুই মাসে মাত্র ৩টির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বুড়িগঙ্গার পানিতে বা তীরে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যেন ময়লা-আবর্জনা ফেলতে না পারে, সে বিষয়ে তদারকির ব্যবস্থা করতে ঢাকার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান, নির্বাহী কর্মকর্তা ও কেরানীগঞ্জ থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। কিন্তু আদালতের নির্দেশ সামান্যতমও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরের আইনজীবী আমাতুল করিম বলেন, আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ চলছে। কেরানীগঞ্জের ৩০টি কোম্পানির প্রায় সবগুলোই এখন বন্ধ রয়েছে। তিনটির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শুধু কেরানীগঞ্জ নয়, ঢাকার শ্যামপুর, কদমতলাসহ আরো যেসব জায়গায় পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
রিট আবেদনকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, বুড়িগঙ্গায় দূষণ ঠেকাতে পরিবেশ অধিদপ্তরের যে কর্মতৎপরতা তা সন্তোষজনক নয়। এ জন্য আদালত বার বার তাদের তাগিদ দিচ্ছে। আসলে দূষণ রোধ করতে হলে সরকরাকে আন্তরিকভাবে ভূমিকা রাখতে হবে। তা না হলে শুধুমাত্র আদালতের নির্দেশে কোনো কাজ হবে না।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com