রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪৭ অপরাহ্ন

অগ্নিঝরা মার্চ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১

স্বাধীনতার মাস মার্চের ১৪তম দিন। ১৯৭১ সালের এইদিন সকালে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি বিশিষ্ট মস্কোপন্থী রাজনীতিক খান আবদুল ওয়ালী খান, আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বাধিকার আন্দোলনের সংগঠক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে ওয়ালী খান বলেন, “শেখ সাহেব ৭ মার্চ যে চার দফা দাবি দিয়েছেন, এগুলো আমাদেরও দাবি। আমরা সর্বোতভাবে এগুলোকে সমর্থন করি। আমরা চাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।”
এদিন করাচী থেকে প্রকাশিত দ্য ডন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, “মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মুমতাজ মুহাম্মদ খান দৌলতানা বলেছেন, পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের দাবিই দায়ী।” আরেকটি খবরে বলা হয়, “জামায়াতে ইসলামীর সংসদীয় দলের প্রধান সৈয়দ সিদ্দিকুল হাসান গিলানী বলেছেন, এই পরিস্থিতির জন্য পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর ৩ মার্চের ন্যাশনাল এসেম্বলী স্থগিতের ঘোষণা দায়ী।” এছাড়া ভুট্টো বলেন, “দেশে দুটি সংগঠন আছে। পিপলস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংগঠন আর পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ। যদি দুটির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতেই হয়, তবে হতে হবে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিমের পিপলস পার্টির কাছে।”
এদিকে, শেখ মুজিব তার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংকালে বলেন, ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে তার সাথে আলোচনায় বসতে চাইলে তিনি সে আলোচনায় যোগদানে প্রস্তুত রয়েছেন। তবে তৃতীয় পক্ষ এতে অংশ নিতে পারবে না। এদিন ঢাকায় সকল দৈনিক পত্রিকায় ‘সমস্যা সমাধানে সময় উৎরে যাচ্ছে’ মন্তব্য করে একযোগে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। যা সাংবাদিকতা জগতের ইতিহাসে এক অসাধারণ বিরল ঘটনা। এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শেখ মুজিব বলেন, আপনারা পরিস্থিতি লক্ষ্য করুন এবং অপেক্ষা করুন। আমি আন্দোলনেই আছি। আমার এই অসহযোগ আন্দোলন সংকটের নিরসন না হওয়া পর্যন্ত চলবে। এদিন তিনি ৩৫ দফা নয়া নির্দেশনা জারি করেন। এই নির্দেশনায় বাংলাদেশের শাসন কীভাবে চলবে তার একটি রূপরেখা দেয়া হয়।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এদিন এক নতুন নির্দেশ জারি করেন। গত সপ্তাহের মতো সচিবালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে হরতাল অব্যাহত থাকবে। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। শেখ মুজিবের দেয়া চার দফা দাবির সমর্থনে এদিনও প্রদেশব্যাপী হরতাল, সভা-মিছিল হয়। বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন হেলালে ইমতিয়াজ ‘তমঘা’ সম্মাননা বর্জন করেন। তিনি বলেন, “জনগণকে যেভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে তার প্রতিবাদে আমি এ খেতাব বর্জন করছি।” বাংলাদেশের বাইরে রসদ পাচার বন্ধের লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। খুলনা শহরে মহিলারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে এবং রাজপথে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তারা মুক্ত ও স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার পক্ষে স্লোগান দেয় এবং কালো পতাকা ও প্ল্যাকার্ড বহন করে।
এদিন চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ সারা শহরে মিছিল করে। হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ এই মিছিলে অংশগ্রহণ করে। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় সারা চট্টগ্রাম শহর। বিকেলে চকবাজারের উর্দুগলিতে মিছিলে হানা দেয় হানাদারবাহিনী। সাতজন বাঙালী গুরুতর আহত হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেয়ার পথে দুজন মারা যায়। রাতে উত্তেজিত মুক্তিকামী মানুষরা উর্দুগলিতে আক্রমণ করে। হানাদারবাহিনীর সাথে বাঙালীদের বেশ মারাত্মক সংঘর্ষ হয়। ঘন্টাখানেকের মধ্যে পুলিশের মধ্যস্থতায় সংঘর্ষ শেষ হয়। এ ঘটনায় কারো নিহত হবার খবর পাওয়া যায়নি। পরে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে পাক আর্মির একটি ট্রাক এসে চকবাজারের মোড়ে প্রায় পনেরোজন বাঙালী যুবককে তুলে নিয়ে যায়। সারারাত টর্চার করে ভোররাতে কোতোয়ালীর সামনে এদের ফেলে দেয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদও এদিন ক’দফা নির্দেশ জারি করে। ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন ও শাজাহান সিরাজ স্বাক্ষরিত এক যুক্ত বিবৃতিতে জেলা ও থানা পর্যায়ের সংগ্রাম কমিটিকে নির্দেশ দেয়া হয়, যেন তারা স্ব-স্ব এলাকায় সেনাবাহিনীর জওয়ানদের নিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং নেয়া শুরু করে।
এদিকে, করাচীতে নিশতার পার্কে জুলফিকার আলী ভুট্টো এদিন এক জনসভায় বলেন, আওয়ামী লীগের ছয় দফা স্বাধীনতা হাসিলের জন্য সুপরিকল্পিত। সংকট অতিক্রম করার এখনও সময় রয়েছে। আমার দল ৬ দফার তিনটি ইতোমধ্যে মেনে নিয়েছে। আমি শেখ মুজিবের সাথে আলোচনায় প্রস্তুত।
অন্যদিকে বদরুদ্দীন আহমদ তার ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের নেপথ্য কাহিনী’ শীর্ষক গ্রন্থে বর্ণনা করেন, “ইয়াহিয়া ও ভুট্টো ঢাকা আসেন ১৪ মার্চ। ইতোমধ্যে মুমতাজ দৌলতানা, কাইয়ুম খানসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতা ঢাকা এসে উপস্থিত হয়েছেন। আলোচনা চলতে লাগলো। শেখ মুজিবের ঐ এক কথা, ছয় দফা মেনে নিতে হবে। ছয় দফা প্রশ্নে আমরা আপস করতে পারি না। আলোচনার অগ্রগতি দেখে মনে হয়েছিলো, মীমাংসা হয়ে যাবে। ভুট্টোর পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টি। উচ্চাভিলাষী এই ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু সারা পাকিস্তানে শেখ মুজিবের দল সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায় শেখ মুজিবই পার্লামেন্টারি পার্টির প্রধান হবেন। এই সত্য মেনে নিতে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কষ্ট হচ্ছিলো। তাই পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার প্রথম ধাপে তিনি দুই অংশের জন্য দুটি পৃথক শাসনতন্ত্রের কথা বললেন। ভুট্টোর এহেন উক্তিতে দেশের বুদ্ধিজীবীরা বিস্মিত না হয়ে পারেননি সেদিন। যে কোনো প্রকারে ভুট্টো সেদিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। ছয় দফা বাস্তবায়িত হলে ভুট্টোর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ ছিলো না, কিন্তু দুই শাসনতন্ত্রে তার পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com