সীতাকুণ্ডে কোল্ড স্টোরেজ না থাকায়
সবজির রাজ্য খ্যাত সীতাকুণ্ডে এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তুু বিশাল এ উপজেলায় কোন সংরক্ষণাগার না থাকায় ডুবতে বসেছে কৃষকরা। ন্যূনতম ১২ টাকা কেজি দরে টমেটো উৎপাদন করে ৬ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে স্থানীয় কৃষকরা। একই অবস্থায় পড়েছে লাউ, শিম, ফুলকপি, বাধাকপি, বেগুন, মুলা চাষীরাও। বীজ বপন, সেচ, কীটনাশক, পরিচর্যা, ফসল তোলা,পরিবহনসহ আনুষঙ্গিক খরচ বেশি হওয়ায় আশানুরূপ দাম পাচ্ছেন না চাষীরা। বাজারে সব ধরণের সবজির সরবরাহ বেশি বলে দামও কম। ফলে সবজি বিক্রি করে খরচ ওঠে না আসায় লোকসানের মুখে কৃষকেরা। বিশেষ করে টমেটো চাষীরা পড়েছেন চরম বেকায়দায়। বাম্পার ফলন হলেও দাম না পাওয়ায় কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কৃষকদের। তবে প্রতিবার ব্যাপকহারে টমেটো উৎপাদন হওয়া এই উপজেলায় নেই কোন কোল্ড স্টোরেজ। যথাযথ সংরক্ষণাগার না থাকায় টমেটোসহ সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না মৌসুমি সবজিগুলো। ফলে কম দামেই সবজি বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের। কৃষক ও কৃষিবিদরা মনে করছেন সীতাকুণ্ডে সংরক্ষণাগার স্থাপন করা হলে কৃষকরা পেতেন উপযুক্ত দাম সেই সাথে মৌসুমের যেকোন সময় অপ্রতুল সবজিও কিনতে পারতো ক্রেতারা। দীর্ঘ দিন ধরে এই উপজেলায় কোন কোল্ড স্টোরেজ না থাকায় নষ্ট হচ্ছে শতশত কেজি টমেটো, ন্যার্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কৃষকুল। সরেজমিনে সীতাকুণ্ড মোহন্তের হাট, শুকলাল হাট, বড় দারোগারহাট, বাড়বকুণ্ড, কুমিরা ও ভাটিয়ারী সাপ্তাহিক সবজি হাট ঘুরে দেখা গেছে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের কৃষকরা তাদের ক্ষেতে উৎপাদিত সবজি বিক্রি করতে হাটে নিয়ে আসেন। সবকটি হাট ঘুরে টমেটোর সরবরাহ বেশি লক্ষ করা গেছে যা বাম্পার ফলনেরই কথা বলে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে চলতি মৌসুমে এ উপজেলায় ৩৬০ হেক্টর জমিতে টমেটোর চাষ হয়েছে। শিম চাষ হয়েছে ৩ হাজার হেক্টর, ফুলকপি চাষ হয়েছে ১৫০ হেক্টর জমিতে। সীতাকুণ্ড হাটেই কথা হয় গুলিয়াখালীর কৃষক মো. তাহের এর সাথে। তিনি জানান, এ মৌসুমে ৫’শ শতাংশ জমিতে টমেটোর চাষ করেছেন তিনি। সার,বীজ, কীটনাশক, মজুরি সব মিলিয়ে ১৪ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ তার। বাজারে টমেটোর ভালো দাম পাচ্ছেন না বলে জানিয়ে তিনি বলেন, মূলধনের এক তৃতীয়াংশই এখনো উঠে আসেনি। মৌসুম শেষের দিকে হলেও লাভের মুখ দেখছি না। প্রায় প্রত্যক হাটেই পানির দরে টমেটো বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। এতো কম দামে টমেটো বিক্রি করতে হচ্ছে যে প্রতি কেজি টমেটো উৎপাদনে যে টাকা খরচ পড়ে তা ওঠে আসা মুশকিল। কথা হয় সৈয়দপুর ইউনিয়নের শেখের হাটের কৃষক রাসেলের সাথেও। তিনি বলেন, এ বছর ৪৮ শতাংশ জমিতে টমেটো চাষ করেছি। বেশি টাকায় কীটনাশক ও সার কিনতে হয়েছে। সেচ, শ্রমিকের মজুরি সবমিলিয়ে দেড় লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করেছি। ফাল্গুনের শেষ হতে চললেও আসলের এক চতুর্থাংশের অর্ধেকও ওঠে আসেনি। যে পরিমাণে টমেটো বিক্রি করছি সে অনুযায়ী দাম পাচ্ছি না। এভাবে চলতে থাকলে বড় ধরণের লোকসানে পড়তে হবে। একই কথা বলেন, বারৈয়াঢালার কৃষক সবুর মিয়া। তিনি জানান, এবার ৫৯ শতাংশ জমিতে ফুলকপি চাষ করেছি। বাজারে ফুলকপি বিক্রির জন্য নিয়ে গেলে সব ব্যাপারীরা একই দাম বলে। বাধ্য হয়ে তাদের দামে বিক্রি করে আসতে হয়। যেখানে গতবছর প্রতি কেজি ফুলকপি ২৫-৩০ টাকা বিক্রি করেছি, সেখানে এ বছর প্রতি কেজি ফুলকপির দাম পাচ্ছি ১৭-১৮ টাকা। কোন কোন হাটে ১৪-১৫ টাকাও বিক্রি করতে হচ্চে। এ মৌসুমে মূলধন ওঠে আসার ব্যাপারে শঙ্কায় আছেন বলে জানান তিনি। বাজারে ফুলকপি বিক্রি করতে আসা কয়েকজন কৃষক বলেন, প্রতিবারের মতো এবারের ফলনেও আমরা সন্তুষ্ট। কিন্তুু ফলন ভালো হলে কি লাভ হবে যদি বাজারে ন্যার্য দাম না পাই। এতো কষ্ট করে সবজি চাষ করেও আশানুরূপ দাম পায় না। প্রতি হাটে দুই হাজার টাকার সবজি বিক্রি করলে পরিবহন খরচ, বদলা খরচ, হাসিল ও অন্যান্য খরচে ১ হাজার টাকা চলে যায়। এ বছর এতো কম দামে সবজি বিক্রি করছি যে নিজের খাটুনির মজুরিও পাবো বলে মনে হচ্ছে না। শুধু টমেটো নয় সব ধরণের সবজির দাম নিয়েও চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন কৃষকেরা। সবজির ন্যার্য দাম না পাওয়াই কৃষক অসন্তোষের মূল কারণ বলে মনে করছেন সীতাকুণ্ডের বিশিষ্ট জনেরা। সীতাকুণ্ড নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সদস্য সচিব লায়ন গিয়াস উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চল এলাকাটি সবজির রাজ্য খ্যাত। প্রতিবছর এখানে ব্যাপক সবজি উৎপাদন হয়। বিশেষ করে শিম ও টমেটোর বিশাল উৎপাদন ক্ষেত্র এই সীতাকুণ্ড। কিন্তুু দীর্ঘ দিন এখানে উদ্যোগের অভাবে হয়নি কোন কোল্ড স্টোরেজ। ফলে সীতাকুণ্ডের প্রথম শ্রেণির ও জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত কৃষকেরা ন্যার্য দাম না পেয়ে প্রত্যক বছর বহু টাকা লোকসান গুনছে। এখানে যদি কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন করা হয় তাহলে কৃষকরা নয় কেবল জেলেরাও উপকৃত হতো। সবজির পাশাপাশি ইলিশের মৌসুমে এই উপজেলায় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে, সীতাকুণ্ডের সবজি ও ইলিশ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ করা হয় সারাদেশে। কিন্তুু সংরক্ষণাগার কিংবা সসের কোন কারখানা না থাকায় শতশত কেজি টমেটো নষ্ট হয়ে যায় বা পঁচে যায়। তিনি আরো বলেন, কোল্ড স্টোরেজ করা হলে সেটির রক্ষণ ব্যয় বাদ দিয়েও লাভবান হতো কৃষকরা। তবে ভরা মৌসুমে ফলন বেশি হওয়ায় বাজারে দাম একটু কম থাকে বলে মনে করছেন উপজেলা ভারপ্রাপ্ত কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার রঘু নাথ নাহা। তিনি বলেন, কোল্ড স্টোরেজ থাকলে কৃষকরা তাদের সবজি সংরক্ষণ করে দাম না পাওয়া পর্যন্ত ধরে রাখতে পারতো, একইসাথে বছরের অন্য সময়ও মৌসুমি সবজি বাজারে পাওয়া যেতো। কিন্তুু সীতাকুণ্ডে কোল্ড স্টোরেজ না থাকায় তা হচ্ছে না। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনের বিষয়ে উধ্বতন মহলে জানানো হয় বলে জানিয়ে তিনি বলেন, কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনের কোন খবর আপাতত জানা নেই।