রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০০ অপরাহ্ন

বাজারে মাহে রমজানের হাওয়া

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৫ মার্চ, ২০২১

বাজারে রমজানের হাওয়া লেগেছে। রমযানকে সামনে রেখে মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে যেখানে ভোগ্যপণ্যের দাম কমানোর প্রতিযোগিতা চলে সেখানে বাংলাদেশের চিত্রটা ভিন্ন। ব্যবসায়ীদের চিন্তাধারা এমন হয়ে গেছে যে রমযান মাস মানেই তাদের ভাগ্যের চাকা খোলার মাস। তাদের ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে। ব্যবসায়ীরা রমযান মাসকে বেছে নিয়েছে মুনাফা করার মাস হিসাবে। অথচ সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবে প্রতিবছর সৌদিআরবসহ বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশে সরকার এবং ব্যবসায়ীদের সমন্বিত উদ্যোগে ভোগ্যপণ্যের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। আর দাম কমানোকে ইবাদতের অংশ মনে করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা রমযানে অধিক মুনাফা করার মানসিকতা থেকে বের হতে পারছে না। এবারও রমযান আসার আগেই অধিক মুনাফা করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। বাজারে সরকারের কোনো নজরদারি নেই। এ সুযোগে পরিকল্পিতভাবে একের পর এক ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে।

খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, অতীতে শবে বরাতের আগ মুহুর্ত থেকে রমযানের ভোগ্যপণ্য বিকিকিনি শুরু হতো। এরমধ্যে কোন পণ্যের অস্বাভাবিক দাম বাড়লে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নজরদারি ও তদারকিতে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হতো। কিন্তু এবারে প্রশাসনের নজরদারি এড়াতে রমযানের প্রায় দুই মাস আগেই ভোগ্যপণ্যের বিকিকিনি শুরু করেছে আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এতে গত একমাস থেকে রমযানে প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম আগের চেয়ে বেড়ে গেছে এবং এখনো সব পণ্যের দাম উর্ধ্বমুখী। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এভাবে রমজানের দুই মাস আগে থেকে ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি করা অতি মুনাফালোভী আমদানিকারক ও পাইকারদের একটি কৌশল।
খাতুনগঞ্জ থেকে পাইকারিতে ভোগ্যপণ্য ক্রেতা ও খাদ্য পক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান ‘স্টার লাইন গ্রুপের’ কর্মকর্তারা জানান, গত একমাসে খাতুনগঞ্জের পাইকারিতে রমযানকেন্দ্রিক প্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা জানান, গত মাসে আমরা খাতুনগঞ্জ থেকে পাইকারি পর্যায়ে প্রতিকেজি চিনি ৫৮ টাকা, মটর ৩০-৩২ টাকা এবং ৯২ টাকায় প্রতি লিটার পাম অয়েল কিনেছি। কিন্তু চলতি সপ্তাহে একই চিনি ৬৫ টাকা, মটর ৩৮-৩৯ টাকা এবং পাম অয়েল ১০৬-১০৮ টাকায় কিনতে হয়েছে। রমজান ঘনিয়ে আসার আগেই খাতুনগঞ্জসহ দেশের বড় বড় আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
চট্টগ্রাম ডাল মিল মালিক সমিতির সভাপতি পরিতোষ মহাজন জানান, মহামারী করোনার কারণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে ডাল জাতীয় পণ্যের ফলন ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া করোনার শুরু থেকে আমদানি-রপ্তানির চেইন ভেঙ্গে পড়ায় প্রায় এক বছর ধরে বাজারে বেশিরভাগ পণ্যের দাম উর্ধ্বমুখী। আর্ন্তজাতিক বাজারের বুকিং দর বৃদ্ধি ও আসন্ন রমজানকে ঘিরে আমদানিকারক ও পাইকারী পর্যায়ে পণ্যের বিকিকিনি শুরু হওয়া গত একমাস ধরে প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দাম আবারো কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে। তবে রমযান ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে আমদানি ও চাহিদা বৃদ্ধি পেলে বাজারে পণ্যের দাম কিছুটা কমে আসবে।
চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম জানান, প্রতিবছর রমজানের আগেই নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির একটা প্রবণতা থাকে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তবে গত এক বছর ধরে আর্ন্তজাতিক বাজারে প্রায় ভোগ্যপণ্যের দাম আগের চেয়ে কিছুটা বেশি। এরপরও আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের প্রতি আমাদের আহবান- যাতে পণ্যের আমদানি খরচ ও লাভের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পণ্য বিকিকিনি করে।
ট্যারিফ কমিশন ও সরকারি হিসাবে দেশে প্রতি মাসে ছোলার চাহিদা গড়ে ১২ হাজার টন। বছরের চাহিদা এক লাখ ৪৪ হাজার টন। তবে রমযানে চাহিদা দু-তিন গুণ বেড়ে যায়। ইতোমধ্যে দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণে ছোলা আমদানি করা হয়েছে। এসব ছোলা ইতোমধ্যে বাজারে প্রবেশ করেছে। তবে বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ ছোলা কিনে নিয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ছোলার দাম বাড়ানো হচ্ছে।
জানা যায়, দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৮ লাখ টন। তার মধ্যে রোজায় চাহিদা থাকে ৩ লাখ টনের। ভোজ্য তেলের বার্ষিক চাহিদা ২১ লাখ টন। তার মধ্যে রমজানের চাহিদা ৪ লাখ টন। মসুর ডালের বার্ষিক চাহিদা ৫ লাখ টন। তার মধ্যে রোজার চাহিদা ৮০ হাজার টন। ছোলার বার্ষিক চাহিদা প্রায় দেড় লাখ টন। এর মধ্যে রোজার চাহিদা ৮০ থেকে ৯০ হাজার টন। পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন। এর মধ্যে রোজার চাহিদা ৫ লাখ টন।
গত ফেব্রুয়ারিতে বিক্রেতারা জানিয়েছিলেন, রমজানে ছোলা, চিনি, ভোজ্য তেল, মসুর ডাল, মটরের বাড়তি চাহিদা থাকে। এবার ছোলা প্রচুর মজুত ও আমদানি হচ্ছে। ফলে ছোলার দাম বাড়বে না। তবে মসুর ও মটর ডালের দাম বাড়তে পারে। এসব পণ্য আমদানি খরচ বেশি পড়ছে। এরই মধ্যে কিছু পণ্য দেশে পৌঁছেছে। আর পাইপলাইনে রয়েছে প্রচুর পণ্য। টিসিবি সূত্র জানিয়েছিল, রমজান মাসে যাতে ভোগ্যপণ্যের বাজার বাড়তে না পারে সেই লক্ষ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আড়াই কোটি লিটার ভোজ্য তেল, ৬০০ টন ছোলা, ১৭ হাজার টন মসুর ডাল ও ১৩ হাজার টন চিনি কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ডিলারদের মাধ্যমে খোলা বাজারে এসব পণ্য বিক্রি করা হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু ব্যবসায়ীরা আগে থেকে কিছু পণ্যের দাম বাড়ার ইঙ্গিত করেছিল সেহেতু সরকারের উচিত ছিল সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার যাতে পণ্যের দাম না বাড়ে। কিন্তু সরকার সেটা করতে পারেনি। ফলে ব্যবসায়ীদের আগাম কথায় সত্য হয়েছে।
এক সপ্তাহে একটি পণ্যের দাম বাড়লে সেটি আর কমছে না। পরের সপ্তাহে বাড়ছে আরেকটি পণ্যের দাম। রমযানকে টার্গেট করে দেশে ভোগ্যপণ্যের দাম পর্যায়ক্রমে বাড়ানোর উৎসব চলছে। প্রথমে চালের দাম বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা। এখনো সেই বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে। এরপর ভোজ্যতেলের দাম। তেল নিয়ে এখনো তেলেসমাতি চলছে। বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে মুরগি। নতুন করে বেড়েছে পেঁয়াজসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম। বেড়েছে চিনির দাম। সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণহীনতার সুযোগে এবার ডালের দাম বাড়াতে মরিয়া ব্যবসায়ীরা। ইতোমধ্যে সকল প্রকার ডালের দাম বাড়িয়ে দিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা। প্রতিবছর রমযানের শুরুর দিকে হু হু করে বেড়ে যায় নিত্য প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম। অস্বাভাবিক দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওই সময় তৎপরতা বাড়িয়ে দেয় সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। ফলে নতুন কৌশল হিসেবে রমজানের বহু আগেই নিত্য প্রয়োজনীয় এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভোগ্যপণ্যের দেশের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে রমজানে প্রয়োজনীয় বেশির ভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম এখন উর্ধ্বমুখী। প্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভোজ্যতেল, চিনি ও ডাল জাতীয় পণ্য ছোলা, মটর, মসুর, খেসারি ডালের দাম। বর্তমানে খাতুনগঞ্জে পাইকারি পর্যায়ে মানভেদে প্রতি মণ (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) অস্ট্রেলিয়ার ছোলা বিক্রি হচ্ছে ২২০০-২৫৫০ টাকার মধ্যে। গত এক মাস আগেও একই মানের ছোলা ২২০০ টাকার নিচে বিক্রি হয়েছে। সেই হিসেবে, একমাসের ব্যবধানে প্রতি মণ ছোলার দাম বেড়েছে ৩৫০ টাকা। এতদিন না থাকলেও আসন্ন রমযানকে ঘিরে মায়ানমারের ছোলাও ইতোমধ্যে বাজারে প্রবেশ করেছে, যা মণপ্রতি ২৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে বাজারে প্রতি মণ মটর বিক্রি হয় ১০০০-১১০০ টাকার মধ্যে (কেজি ২৭-৩০ টাকা)। কিন্তু গত এক মাসের মধ্যে দফায় দফায় বেড়ে বর্তমানে মটর বিক্রি হচ্ছে ১৪০০-১৪৫০ টাকার মধ্যে (কেজি ৩৮-৩৯ টাকা)। বাজারদর অনুযায়ী, গত এক মাসে দফায় দফায় পণ্যটির ৪৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে।
গত এক মাসে মণে প্রায় ৪০০ টাকা বেড়েছে আমদানিকৃত মসুরের দাম। বর্তমানে বাজারে প্রতি মণ কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার (মোটা জাতের) মসুর বিক্রি হচ্ছে ২৪২৫ টাকা (কেজি ৬৫ টাকা) দামে। যা একমাস আগে মাত্র ২০৫০ টাকার (কেজি ৫৫ টাকা) নিচে বিক্রি হয়েছে। সম্পূর্ণ দেশীয় উৎপাদনে দেশের খেসারি ডালের চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু আমদানি না হলেও আমদানি পণ্যের সাথে পাল্লা দিয়ে অস্বাভাবিক বেড়েছে খেসারি ডালের দাম। মাত্র এক মাস আগেও বাজারে প্রতিমণ খেসারি ডাল বিক্রি হয়েছে ২০৫০ টাকার (কেজি ৫৫ টাকা) নিচে। একমাসে প্রায় ৭৫০ টাকা বেড়ে বর্তমানে খেসারি ডাল বিক্রি হচ্ছে ২৮০০ টাকা (কেজি ৭৫ টাকা) দামে।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে অস্থির রয়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় আরেক ভোগ্যপণ্য চিনির বাজার। গত এক-দেড় মাস আগে বাজারে থাকা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতি মণ চিনি বিক্রি হতো ২১০০ টাকার নিচে। এই সময়ের মধ্যে ২৫০ টাকার বেশি বৃদ্ধি পেয়ে এখন প্রতি মণ চিনি বিক্রি হচ্ছে ২৩৫০-২৩৬০ টাকায়।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com