রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বিজিএমইএর সংকলিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে মোট ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের পণ্য বিশ্ববাজারে রফতানি করেছে বাংলাদেশ। ডিসকাউন্ট হিসেবে ১০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ না হলে মোট রফতানির বিপরীতে ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ পাবেন না রফতানিকারকরা। ক্রয়াদেশ অনুযায়ী পণ্য রফতানির বিপরীতে সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ না হওয়ার ঘটনা অহরহই ঘটছে কভিডকালে। এমন ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ডেবেনহ্যামসের ক্ষেত্রেও। কভিডকালের আগে বাংলাদেশ থেকে বছরে ১০-১১ কোটি ডলারের পোশাক কিনত প্রতিষ্ঠানটি। প্রায় ৪০টির মতো কারখানা থেকে সরবরাহ করা হতো এসব পোশাক। ডেবেরহ্যামসের পক্ষ থেকে মূল্য পরিশোধ না হওয়ায় প্রায় সব কারখানাকেই ভুগতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা।
কভিডের সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন শুরু হলে ডেবেনহ্যামসের ক্রয়াদেশের বিপরীতে পণ্য রফতানি হলেও অপরিশোধিত থেকে যায় প্রায় ৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে ৩ কোটি ডলার আদায় করা গেছে অনেক চেষ্টার পর। বাকি ৪ কোটি ডলার আদায় করার চেষ্টা এখনো চলমান রেখেছেন সংশ্লিষ্ট কারখানার মালিকরা। তাদের দাবি, বাংলাদেশে দেয়া ক্রয়াদেশে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যহ্রাস চাইছে ডেবেনহ্যামস। কভিডের প্রভাবকে কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়ে এখন রফতানি চালানের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধে গড়িমসি করছে তারা।
শুধু মূল্যহ্রাসই না, পণ্য নিলেও তার আংশিক দাম পরিশোধ করে বাকিটা অপরিশোধিত রাখার ঘটনাও ঘটেছে। গত বছরের শেষার্ধে মার্কিন পোশাক ক্রেতা ব্র্যান্ড সিডব্লিউসির ক্রয়াদেশ পায় বাংলাদেশে অবস্থিত কারখানা ক্রয়ডন কওলুন ডিজাইনস লিমিটেড (সিকেডিএল)। ঢাকা রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ডিইপিজেড) স্থাপিত কারখানাটি নির্ধারিত সময়ে পণ্য জাহাজীকরণ শুরু করে। এর বিপরীতে কিছু অর্থও পরিশোধ করে কোল্ডওয়াটার। কিন্তু এরই মধ্যে ডিসেম্বরে কভিডের সংক্রমণ শুরু হলে আগে থেকেই বয়ে বেড়ানো আর্থিক দুর্দশা আরো ঘনীভূত হয় কোল্ডওয়াটারের। এক পর্যায়ে মার্কিন আইন অনুসরণ করে লিকুইডেশন বা ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে সিকেডিএলকে দেয়া ক্রয়াদেশের বিপরীতে বাকি অর্থ অপরিশোধিত থেকে যায়।
গত বছর ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। কভিড-১৯-এর প্রভাবে আগের বছরের তুলনায় রফতানির এ পরিমাণ প্রায় ১৫ শতাংশ কম। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে কেনাবেচা বন্ধ থাকায় রফতানি অনেক কম হয়েছে। এখন দেখা দিয়েছে নতুন সংকট। ক্রেতারা রফতানির সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ না করে প্রস্তাব দিচ্ছেন ডিসকাউন্ট বা মূল্যহ্রাসের। রফতানিকারকরা দাবি করছেন, কভিড প্রেক্ষাপটে ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতের পাশাপাশি মূল্যহ্রাসের মতো পরিস্থিতিতে গত বছর রফতানি হওয়া পণ্যের মোট মূল্য থেকে ১০ শতাংশ অর্থ না পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
জানা গেছে, দেশ থেকে রফতানি হওয়া প্রতিটি চালানের ঘোষণা একটি নির্ধারিত ফরম পূরণের (ইএক্সপি) মাধ্যমে দেন রফতানিকারকরা। এতে সহায়তা করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ঘোষিত রফতানির বিপরীতে সম্পূর্ণ অর্থ দেশে আসছে কিনা তা নজরদারির দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি ডিসকাউন্ট কমিটিও আছে, যা রফতানি চালানের বিপরীতে কোনো অর্থ না এলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অনুমোদন দেয়। এরই মধ্যে কমিটির কাছে পণ্যের মূল্যহ্রাসের অনেকগুলো আবেদন জমা পড়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিসকাউন্ট কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভা সূত্রে জানা গেছে, ডিসকাউন্ট পেতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৬০টিরও বেশি আবেদন জমা পড়েছে। এসব আবেদন অনুমোদন পেলে রফতানির বিপরীতে প্রাপ্য অর্থের বড় একটি অংশ না আসার শঙ্কা রয়েছে। রফতানিকারকদের দাবি, চালান ও ক্রেতাভেদে পণ্যের মূল্যে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট চাওয়া হচ্ছে। শুধু পোশাক খাতের মোট রফতানি বিবেচনায় নিলে প্রায় ১৫ শতাংশ অর্থ রফতানিকারকরা পাবেন না। আর গোটা রফতানি খাত বিবেচনায় নিলে ১০ শতাংশ অর্থ দেশে না আসার শঙ্কা রয়েছে।
কভিডে গত বছর যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তাতে মোট রফতানির ন্যূনতম ১০ শতাংশ অপ্রত্যাবাসিত থাকতে পারে এমন শঙ্কা জানিয়ে বিজিএমইএ পরিচালক ও গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ভিলেজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান একেএম বদিউল আলম বলেন, অনেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান যেমন ডেবেনহ্যামস অনেক উচ্চহারে ডিসকাউন্ট চাইছে। সবার আবেদন জমা শেষে মোট পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলারের ওপরে চলে যেতে পারে।
জানা গেছে, ইএক্সপি ফরমে উল্লেখ করা পরিমাণের ৫ শতাংশের বেশি হেরফেরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন হয়। সম্প্রতি কমিটির অনুমোদন গ্রহণে ৫ শতাংশের সীমা বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাহাজীকৃত চালানের অনলাইন ইএক্সপির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ পর্যন্ত রফতানি মূল্য অপ্রত্যাবাসিত থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিসকাউন্ট কমিটিকে জানাতে হবে। ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে অপ্রত্যাবাসিত রফতানি মূল্যের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে। দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংককে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। সংগ্রহ শেষ হলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে আমরা সভা করব। সবাইকে নিয়ে যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিসকাউন্ট কমিটির সভার পরিপ্রেক্ষিতে সদস্যদের উদ্দেশে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বিজিএমইএ। কভিড-১৯-এ তৈরি পোশাক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি উল্লেখ করে ১৬ মার্চ সদস্যদের উদ্দেশে জারি করা বিজিএমইএর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এখনো অনেক ক্ষেত্রে যথাযথভাবে রফতানি মূল্য প্রত্যাবাসন হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিসকাউন্ট কমিটির নেয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে সদস্যদের জানানো হয় বিজিএমইএর বিজ্ঞপ্তিতে। বেশির ভাগ ক্রেতাই পণ্যের মূল্যহ্রাস বা ডিসকাউন্ট চাইছে উল্লেখ করে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, কভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্রেতাদের প্রয়োজন ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্ট। অনেক ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট চাওয়া হচ্ছে। তবে গড়ে ডিসকাউন্টের হার ১৫ শতাংশের মতো।
সূত্রমতে, কভিডের প্রথম ঢেউয়ে ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত করা ক্রেতাদের মধ্যে ছিল প্রাইমার্কের মতো বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানও। আয়ারল্যান্ডভিত্তিক প্রাইমার্কের পাশাপাশি ছোট-মাঝারি-বড় সব ধরনের ক্রেতাই ওই সময় ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছিল। পরে আবার এইচঅ্যান্ডএম, ইন্ডিটেক্স, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, কিয়াবি, টার্গেট, পিভিএইচসহ আরো কিছু ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান স্থগিত হয়ে পড়া ক্রয়াদেশ পুনরায় বহাল করে। বর্তমানে কভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে ক্রেতারা ক্রয়াদেশ সরবরাহের সময়ে বড় ধরনের পরিবর্তন শুরু করেছে।দেশের মোট রফতানির ৮৪ শতাংশই তৈরি পোশাক। খাতটির মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য বলছে, ২০২০ সালের এপ্রিল শেষে ১ হাজার ১৫০ কারখানার মোট ৩১৮ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়। এখন কভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে আবারো ক্রয়াদেশ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে এরই মধ্যে ক্রয়াদেশ ৩০ শতাংশ কমেছে বলেও জানিয়েছে বিজিএমইএ। এ পরিস্থিতিতে যে ক্রয়াদেশগুলো আসছে, তার বেশির ভাগই ঋণপত্র ছাড়া। এছাড়া পশ্চিমা খুচরা বাজারের অনিশ্চয়তায় পণ্যের দাম পরিশোধ নিয়েও ঝুঁকি বাড়ছে। এরই মধ্যে উপকরণ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত পণ্যের মূল্য হিসেবে ক্রেতাদের কাছে ৮ বিলিয়ন ডলারের পাওনা সৃষ্টি হয়েছে। এ পাওনা আদায় নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন রফতানিকারকরা।
রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গোটা রফতানি খাত বিবেচনায় নিলেও ২০২০ সালে মোট রফতানির ১০ শতাংশ না পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।