সম্পদকে আরবিতে বলা হয় ‘মাল’। এর বহুবচন আমওয়াল। আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদের ২৫ জায়গায় ‘মাল’ একবচন হিসেবে এবং ৬২ জায়গায় আমওয়াল বহুবচন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় তার জীবন, তারপর তার সম্পদ, তারপর তার সন্তান। কোনো কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে দেখা যায়, তার জীবনের চেয়ে সম্পদ তার কাছে অধিক প্রিয়। সে জীবন দিতে প্রস্তুত, কিন্তু সম্পদ দিতে প্রস্তুত নয়। তাই মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে প্রথমে সম্পদ দিয়ে তার পরে জান দিয়ে জিহাদ করতে বলেছেন। যেমন- ‘আর তোমার অর্থ-সম্পদ ও জান-প্রাণ দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করো’ (সূরা আসসফ-১১)। আরো বলেছেন, ‘গৃহে উপবিষ্ট মুসলমান- যাদের কোনো সঙ্গত ওজর নেই এবং ওই মুসলমান যারা জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে, সমান নয়’ (সূরা আন নিসা-৯৫)। অর্থের মোহ মানুষের শত্রু : আল্লাহ তায়ালা সূরা আত তাকাসুরে বলেছেন, ‘পার্থিব অর্থ লাভ করার মোহ তোমাদেরকে উদাসীন ও গাফেল করেছে। আজীবন সম্পদ বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকো। এমনকি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এ চিন্তায় রত থাকো। হজরত হাসান বসরি রহ: বলেছেন, ‘মানুষকে সম্পদ ও সন্তানের মোহ স্র্রষ্টার আনুগত্য করা থেকে গাফেল রাখে।’ আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি একটি পরীক্ষা’ (সূরা আত-তাগাবুন-১৫)। মহানবী সা: বলেন, ‘তুমি যে শত্রুকে হত্যা করতে পারার কারণে সফল হলে কিংবা সে তোমাকে হত্যা করলে তুমি জান্নাত লাভ করলে সে তোমার আসল শত্রু নয়। বরং তোমার আসল শত্রু তোমার ঔরসজাত সন্তান এবং তোমার ওই সম্পদ যার তুমি মালিক হয়েছ (তিবরানি)। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু’ (সূরা আত তাগাবুন- ১৪)। আল্লাহ তায়ালা আরো ইরশাদ করেন, ‘অতএব তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন আপনাকে বিস্মিত না করে। আল্লাহর ইচ্ছা হলো এগুলো দ্বারা দুনিয়ার জীবনে তাদের আজাবে নিপতিত রাখা এবং প্রাণবিয়োগ হওয়া কুফরি অবস্থায়’ (সূরা আত-তাওবা-৫৫)।
সম্পদ বাহ্যিক চাকচিক্য মাত্র : সম্পদ মূলত সৌন্দর্য ও চাকচিক্য মাত্র। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘মানবকুলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী, সন্তান-সন্ততি, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য, চিহ্নিত অশ্ব, গবাদিপশুরাজি এবং ক্ষেত-খামারের মতো আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রী। এ সবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্যবস্তু’ (সূরা আল-ইমরান-১৪)।
সম্পদের লোভ ক্ষতিকর : সম্পদ বৃদ্ধির লোভ আজীবন থাকে। মহানবী সা: বলেছেন, ‘আদম সন্তান বৃদ্ধ হয়, কিন্তু দু’টি জিনিস অবশিষ্ট থাকে, তা হলোÑ লোভ ও আশা’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘যদি কোনো আদম সন্তানের স্বর্ণের একটি উপত্যকা থাকে, সে দু’টি থাকা পছন্দ করবে, তার মুখ কবরের মাটি ছাড়া পূর্ণ হবে না’ (সহিহ বুখারি)। সম্পদের লোভ ব্যক্তিকে দ্বীনি কার্যক্রম থেকে বিরত রাখে এবং অন্যায় কজ করতে বাধ্য করে। মহানবী সা: বলেছেন, ‘আদম সন্তান বলেÑ আমার মাল, আমার মাল! হে আদম সন্তান! ওই মালই তোমার যা তুমি খেয়ে শেষ করেছ অথবা পরিধান করে নিঃশেষ করেছ কিংবা তুমি দান করে ব্যয় করেছ, আর অন্য যা কিছু রেখে এসেছ তা তুমি অন্যের জন্য রেখেছ’ (সহিহ মুসলিম)।
সম্পদের হিসাব নেয়া হবে : আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমার আল্লাহর নিয়ামতসমূহ গণনা করতে থাকো, তাহলে সেগুলো গণনা করে শেষ করতে পারবে না’ (সূরা ইবরাহিম-৩৪)। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘অতঃপর অবশ্যই সে দিন তোমাদের এ নিয়ামতগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’ (সূরা আত-তাকাসুর-৮)। হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা: বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের এখানে আসেন। আমরা তাকে খাওয়ার জন্য তাজা খেজুর এবং পান করার জন্য ঠাণ্ডা পানি দিলাম। তিনি তখন বলেন, এগুলো এমন সব নিয়ামতের অন্তর্ভুক্ত যেগুলো সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’ (মুসনাদ আহমদ, নাসায়ি, ইবনে জারির)। নিয়ামতসমূহের মধ্যে অসংখ্য নিয়ামত এমন যা আল্লাহ তায়ালা সরাসরি মানুষকে দান করেন। আর অসংখ্য নিয়ামত এমন যা মানুষকে দান করা হয় তার নিজের উপার্জনের মাধ্যমে। নিজের উপার্জিত নিয়ামতসমূহ মানুষ কিভাবে উপার্জন করেছে এবং কোন পথে ব্যয় করেছে সে সম্পর্কে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। যেসব সরাসরি লাভ করেছে সেগুলো সে কোন পথে ব্যয় করেছে সে প্রসঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করা হবে। বিচার দিবসে তিন বস্তুর জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না- ১. যে বস্তু দিয়ে সতর ডেকেছে; ২. যে খাদ্য খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেছে এবং ৩. যে গৃহে আশ্রয় নিয়ে গরম ও ঠাণ্ডা থেকে নিজেকে রক্ষা করেছে। সাহাবায়ে কিরাম মহানবী সা:কে জিজ্ঞেস করেন- কোন নিয়ামত প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হবে? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন- ১. পেট ভরে আহার করা; ২. ঠাণ্ডা পানি পান করা; ৩. আশ্রয় নেয়া গৃহ; ৪. সুস্বাস্থ্য’ ৫. নিদ্রার প্রশান্তি। অন্য বর্ণনা মতে, নিয়ামত হলো- নিরাপত্তা ও সুস্থতা। আলী ইবনে আবু তালহা হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণনা করেন-তিনি বলেন, উত্তম নিয়ামত হলো- ১. শারীরিক সুস্থতা, শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই কর্ণ, চক্ষু, অন্তঃকরণ সব কিছু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। মহানবী সা: বলেন, বিচার দিবসে আল্লাহ তায়ালা বলবেন, ‘আমি তোমাকে ঘোড়া ও উটের ওপর আরোহণ করিয়েছি, নারীর সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করেছি এবং তোমাকে নেতৃত্ব দান করেছি, তুমি এসবের কি শুকরিয়া করেছ’ (ইবনে কাসির)?
মৃত্যুর পর সম্পদ মূল্যহীন : মানুষের মৃত্যুর পর সম্পদ তার জন্য মূল্যহীন হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যখন সে মারা যাবে, তখন সম্পদ তার কোনো কাজে আসবে না’ (সূরা আল-লাইল-১১)। মহানবী সা: বলেছেন, তিন ধরনের মালই তার আসল মাল- ১. যা সে ভক্ষণ করেছে; ২. যা সে নষ্ট করেছে ও ৩. যা সে দান সদকা করেছে। তাই আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি তা মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় করো’ (সূরা মুনাফিকুন-১০)। লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামিয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।