ইন্টারনেটের স্বল্পতা ও উচ্চমূল্যের আঘাতে দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা- বাণিজ্য, অফিস-আদালত, বিনোদন ব্যবস্থা, পারিবারিক বন্ধন, সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে দাবি করেছে সংশ্লিষ্টমহল। বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) চিঠি দেয়া হয়েছে। । বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান বরাবর দেয়া ওই চিঠিতে বলা হয়েছে-দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা- বাণিজ্য, অফিস-আদালত, বিনোদন ব্যবস্থা, পারিবারিক বন্ধন, সবকিছু সচল রাখতে একমাত্র মাধ্যম নেটওয়ার্কের মানোন্নয়ন ও পর্যাপ্ত দ্রুতগতির ডাটা সরবরাহ করা। এমন পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের অভিভাবক হিসেবে আপনার কাছে বিনীত আহ্বান দ্রুত টেলিযোগাযোগ ও ব্রডব্যান্ডের মানোন্নয়ন ঘটান।
শিক্ষাব্যবস্থা গত এক বছরে ইন্টারনেটের স্বল্পতা উচ্চমূল্যের কারণে ভেঙে পড়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। টেলিমেডিসিন এ সময় আমাদের সহযোগিতা করলেও গ্রামীণ প্রান্তিক পর্যায়ে এ সেবা পৌঁছানো যায়নি। শুধু তাই নয়, ঢাকা শহরের বহু এলাকায় নেটওয়ার্ক পাওয়া দুষ্কর। এমনকি আমরা লক্ষ্য করেছি ঢাকা জজ কোর্টের বহু এলাকা, গুলিস্তান, পুরাতন ঢাকা, বিশ্ববিদ্যালয় ও মহামান্য হাইকোর্টের বহুলাংশে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। ২০১৯-২০২০ ও ২০২১ সালে গ্রাহক সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ। ডাটার ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি। বর্তমানে চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ প্রায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, এমনিতেই আমাদের দেশে গ্রাহক প্রতি যে পরিমাণ তরঙ্গ ব্যবহার করা হয় তা অপ্রতুল। এক হিসাবে দেখা যায়, সম্প্রতি নিলামের মাধ্যমে তরঙ্গ কিনে গ্রামীণফোনের সর্বমোট তরঙ্গ দাঁড়িয়েছে ৪৭ দশমিক ৪ মেগাহার্জ তরঙ্গ। অর্থাৎ তাদের মোট ৭ কোটি ৮১ লাখ গ্রাহক এর বিপরীতে তারা যে তরঙ্গ ব্যবহার করতে পারবে তা গ্রাহক অনুপাতে দাঁড়ায় ২০ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে ১ মেগাহার্জ তরঙ্গ। অথচ জিপি’র কোম্পানি টেলিনর অন্য দেশে এক লাখ গ্রাহকের বিপরীতে ব্যবহার করছে এক মেগাহার্জ তরঙ্গ। রবি আজিয়াটার ৯০০, ১৮০০ ও ২১০০ ব্যান্ড মিলিয়ে সর্বমোট তরঙ্গ ৪৪ মেগাহার্টজ। তাদের বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা ৫ কোটি ১৫ লাখ। হিসাব করলে দাঁড়ায় প্রায় ১৩ লাখ গ্রাহকের জন্য এক মেগাহার্জ তরঙ্গ। বাংলালিংকের ৯০০, ১৮০০ ও ২১০০ মিলিয়ে ৪০ মেগাহার্জ তরঙ্গ। তাদের বর্তমানে গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ। অর্থাৎ প্রায় ১০ লাখ ৬০ হাজার গ্রাহকের বিপরীতে এক মেগাহার্জ তরঙ্গ। আর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টেলিটক নতুন করে তরঙ্গ না কেনায় তাদের অবস্থান পূর্বের মতোই। টেলিটকের প্রায় ৫৫ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে তাদের ব্যবহৃত ২৫ দশমিক ২ মেগাহার্জ তরঙ্গ। অর্থাৎ ২ লাখ ১৫ গ্রাহকের বিপরীতে ১ মেগাহার্জ তরঙ্গ। বর্তমানে ৪টি অপারেটরের মোট ব্যবহৃত তরঙ্গের পরিমাণ ১৫৬ মেগাহার্জ তরঙ্গ। অথচ অন্যান্য দেশে একটি অপারেটরের চাইতে বেশি পরিমাণ তরঙ্গ ব্যবহার করে। এসব কারণে তথ্য ও প্রযুক্তিবিদরা মনে করছেন দেশে করোনার প্রকোপ বাড়লে মোবাইল নেটওয়ার্ক সিস্টেম ভেঙে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশের তথ্য প্রযুক্তি বিভাগের সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি যে গতিতে করোনা ছড়াচ্ছে ও মৃত্যুর হার বাড়ছে তাতে সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিরূপ প্রভাব তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে সরাসরি পড়বে বলে তাদের ধারণা। বিশেষ করে মোবাইল নেটওয়ার্কিং সিস্টেম সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব দিক বিবেচনা করে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসার আগেই মোবাইল নেটওয়ার্কের মান উন্নয়ন করতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) চিঠি দেয়া হয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে এর বিকল্প কোনো সমাধান নেই। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, সম্প্রতি মোবাইল গ্রাহক অনেক বেড়েছে। বেড়েছে মোবাইল ইন্টারনেটের চাহিদাও। মোবাইল অপারেটরদের হিসাবে মোবাইল ইন্টারনেটের গ্রাহক চাহিদা ৩০ ভাগ বেড়েছে। প্রকৃত তথ্য এর পরিমাণ ৪০ ভাগেরও বেশি। আর যদি করোনার প্রভাব আরো বাড়ে তাহলে গ্রাহকের চাহিদা বেড়ে ৫০ ভাগের বেশি হবে। তখন ওই চাহিদা কীভাবে সামাল দেবে অপারেটররা? মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এখনো মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছে। অফিস-আদালত সব চালু রয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানলে মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা যদি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাহলে গ্রাহক চাহিদা বেড়ে যাবে। সবমিলিয়ে সামনের পরিস্থিতি সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে আমরা বিটিআরসিকে চিঠি দিয়েছি। এদিকে বিটিআরসি চেয়ারম্যান বরাবর দেয়া চিঠিতে এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে নানা যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। চিঠিতে বিটিআরসি চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে- আপনি নিজেও জানেন যে, বর্তমান টেলিকম ও ইন্টারনেট সেবায় গ্রাহকরা কি পরিমাণে দুর্ভোগে রয়েছে। গত এক বছর দেশের সকল কার্যক্রম চলমান রয়েছিল কেবলমাত্র প্রযুক্তির উন্নয়ন ও নেটওয়ার্কের মহাসড়কের মাধ্যমে। কিন্তু এ মহাসড়কের অবস্থা বর্তমানে এতটাই বেহাল যা ভাষায় বোঝানো দুষ্কর। আপনার প্রতিষ্ঠান যে মানোন্নয়ন পরীক্ষা করেছে তাতে লক্ষ্য করা যায় কলড্রপের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ থেকে -৩.৫ এ উন্নীত হয়েছে। সংযোগ পেতে গ্রাহকের ৭ সেকেন্ডের পরিবর্তে ১০-১২ সেকেন্ড সময় লাগছে। মিউট কলসহ অসংখ্য বিড়ম্বনা, ইন্টারনেটের ধীরগতি, ডাটা ক্রয় করে ডাটা ব্যবহার করতে না পারা, আরো অসংখ্য প্রতারণা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে-করোনা মহামারির মধ্যেই দেশের শীর্ষ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন তার কাস্টমারকেয়ারগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। আজ গ্রাহক সেবার মান সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। এসব দুর্ভোগের কথা মাথায় রেখেই আমরা গত বছর ২৮শে নভেম্বর উকিল নোটিশ দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে মহামান্য হাইকোর্টে আমরা রিট পিটিশন দাখিল করি, যা বর্তমানে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে-দেশে ইতিমধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের বার্তা শোনা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি দ্রুত নেটওয়ার্কের মানোন্নয়ন ও ইন্টারনেটে ডাটার গতি বৃদ্ধি ও পর্যাপ্ত সরবরাহ না করা যায় তাহলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে।