ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আসন্ন বাংলাদেশ সফর ইস্যুতে দেয়া এক ভিডিও বার্তায় কলকাতার বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমন বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘অনুগ্রহ করে, আপনারা ব্যবহৃত হবেন না।’ সোমবার নিজ ফেইসবুক প্রোফাইলে ‘জরুরি ভিডিও বার্তা’ শিরোনামে এই ভিডিওটি তিনি আপলোড করেন। ভিডিও বার্তার শুরুতে কবীর সুমন বলেন, ‘এই ভিডিও বার্তাটি আমি তৈরি করছি এবং ফেইসবুকে এটি দেবো প্রধানত আমার প্রিয় প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের শ্রদ্ধেয় সরকার, তাদের সকল মাননীয় সদস্য, তাদের সকল মাননীয় অনুগামী অনুসারী এবং বাংলাদেশের আমাদের প্রিয় জনগণের উদ্দেশ্যে।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘বন্ধুরা, এই তিয়াত্তর বছর বয়সে পুরানো দিনের কথা খুব বেশি মনে পরে, আগে এতটা পরতো না। এখন আমার মনে পরছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম যুবক। সেসময় লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশের শরণার্থী চলে এসেছিলেন আমাদের পশ্চিমবঙ্গে। কি অবস্থা যে সে সময় হয়েছিলো, তার একটু পরিচয় পেতে আপনার অনুগ্রহ করে ইন্টারনেটে অ্যামেরিকান কবি এলেন জিন্সবার্গের লেখা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি পড়লে খুব ভালো হয়। ওনি এসছিলেন সে সময়। স্বচোক্ষে দেখেছিলেন বাংলাদেশের শরণার্থীদের। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের একটি মানুষেরও মুখ কিন্তু আমি ভারাক্রান্ত দেখিনি। মনে রাখবেন, আমাদের গোটা উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের জীবন কিন্তু ভারাক্রান্ত। তারা কেউ ধনী নন। তাদের আর্থিক ভার বয়ে বেড়াতে হয়। তার-ই মধ্যে আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষরা তাদের সামান্য সম্বল কিন্তু ভাগ করে নিয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের সঙ্গে।
‘অনেক সময়ই লোকে বরং তামাশা করে হেসে বলতো, এবারে বেশ ভালো ইলিশ পাওয়া যাবে। বাঙ্গালী একটু উদারপরায়ণ। আমি কোনদিন কোন মুখ দেখি নি, যেটা ভারাক্রান্ত। কেন আমাদের শেয়ার করতে হবে, বাংলাদেশের শরণার্থদের সঙ্গে? এমন কথা কোনদিন শুনি নি। এটা আমার বিশেষ গর্ব।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আসন্ন বাংলাদেশ সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আজ খবর পাচ্ছি যে, ভারতের সম্মানীয় প্রধানমন্ত্রী তিনি বাংলাদেশে যাচ্ছেন, যাবেন। হয়তো কিছু দিন থাকবেনও। ঠিক ওই সময়, যখন পশ্চিমবঙ্গে ভোট হচ্ছে, সেসময় একটি বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের দেবালয়ে গিয়ে পুজো দেবার জন্য। এই ধর্ম সম্প্রদায় কিন্তু এখানেও থাকেন। আমি এখন পর্যন্ত কোন কাগজে দেখি নি যে, তিনি হঠাৎ বিশেষ কোন দেবালয়ে চলে গেলেন, গিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘পলিটিক্স একটা অদ্ভুত খেলা। আমিও ভোটে দাঁড়িয়েছি। ভোট চলে ভোটের নিয়মে, মানুষের নিয়মে না। আমার শুধু চিন্তা হচ্ছে এই ভেবে যে, যে পার্টিটি আজকে ভারতের কর্তৃত্বে, সে পার্টির নীতি হলো বিভাজন, ধর্মীয় বিভাজন- মনে রাখবেন এটা। আর আমাদের ভারত কিন্তু সেক্যুলার দেশ। এখানে ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান, যিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া মুসলমান। রোজা রাখা মুসলমান। তিনি কিন্তু হরি ওম তাতসাত বলে গান করেন, পাহাড়ি ঠুংরি। তাতে মুসলমান বা হিন্দু কারোরই কোন আপত্তি হয় না। ‘
ভারতের বর্তমান সরকার কর্তৃক বাংলা ভাষাকে ক্লাসিকাল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে এই প্রখ্যাত গীতিকার বলেন, এই যে বর্তমান ভারত সরকার, যাদের সম্মানীয় প্রধানমন্ত্রী যাবেন বাংলাদেশে বা যাচ্ছেন বা গিয়ে থাকছেন হয়তো। সে সরকার কিন্তু বাংলা ভাষাকে ক্লাসিকাল ভাষার মর্যাদা দিতে চায় নি, দেয় নি। প্রতিবেশি উড়িশার ভাষার ক্লাসিকাল ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। খুব ভালো, কিন্তু বাংলা পায় নি। অর্থাৎ সৈয়দ আলাওল কেউ না, মুকুন্দরাম কেউ না, বড়ু চন্ডীদাস কেউ না, চন্ডীদাস কেউ না, এরা কেউ না। শ্রী কৃষ্ণ কীর্তন কিচ্ছু না, পদ্মাবতী কিচ্ছু না।’
‘মাননীয় বন্ধুরা এটা মনে রাখবেন, যে ব্যক্তিটি যাচ্ছেন, নিশ্চয়ই খুব সম্মানীয় তিনি। কিন্তু তার দল ভারতকে একটা সেক্যুলার দেশ হিসেবে স্বীকারই করে না। এই জায়গাটা মনে রাখবেন। তারা বাংলা ভাষাকে স্বীকার করে না। তাদের নথিতে রয়েছে, বাংলা ভাষায় যারা কথা বলে তারা বাংলাদেশের লোক। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে কেউ ভারতের লোক না। এই জায়গা থেকে তারা দেখছেন। ‘
‘তিনি যে যাচ্ছেন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যাচ্ছেন, যেতেই পারেন। কি আশ্চার্য! এটা তো কোন ব্যাপার না। কিন্তু যে সময় যাচ্ছেন, সে সময় তার একটি বিশেষ বক্তৃতা প্রাণপণে প্রচার করা হবে চারদিকে, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গও থাকবে। আমাদের তখন ভোট। ওই সম্প্রদায়ের মানুষ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গেও থাকেন। সংখ্যায় তারা বেশ ভারী। যেকোরে হোক, যাকে বলে সুয়িং আনা ভোটে ….। তারা জানেন, তারা হেরে যাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সেক্যুলার। ধর্মান্ধতার রাজনীতি এখানে কোনদিন হালে পানি পায় নি, পাবেও না। তবে সেটা জানেন। জেনে শুনে তারা প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশের স্বরণ নিচ্ছেন, যাতে তিনি ওখান থেকে একটা বক্তৃতা করতে পারেন এখানকার নির্বাচনী শিষ্টাচার মেনে। অর্থাৎ এখানে কিছু করা হলো না, অন্য জায়গা থেকে করা হলো; এখানে মানুষ শুনলো।’ উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ধরে নেয়া যাক, আমার এই ভিডিও ভাষণটির কারণে আমার ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাবে, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। সত্যকে আপনি যেভাবেই চান চাপা দিয়ে রাখা যাবে না।’
বাংলাদেশ ও বেগম সুফিয়া কামালকে নিয়ে গাওয়া গানের কথা উল্লেখ করে এই গায়ক বলেন, ‘মাননীয় বন্ধুরা, আসি সেই জায়গা থেকে বলছি এবং বলছি কবীর সুমন হিসেবে। আমি সেই লোকটা, যে পশ্চিমবঙ্গের জন্য একটি গান লেখে নি। পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে গান তৈরি করে নি। গান তৈরি করেছি বাংলাদেশকে নিয়ে। যার শেষ স্তবকে আছে, স্মৃতিতে এখনও শুনি বঙ্গবন্ধুর আহ্বান, পুবের আকাশ ছুঁয়ে শান্তিতে ভোরের আজান। আমি সেই গীতিকার, সুরকার, গায়ক ও বাদক। মনে রাখবেন, আমি সেই কবির সুমন, যেই লোকটা কিনা বাংলাদেশের আমরা সবাই যাকে খালাম্মা বলি, সেই বেগম সুফিয়া কামলাকে নিয়ে গান লিখে, সুর করে, গেয়ে বাজিয়ে ঘুরে বেরিয়েছি।’
বাংলাদেশের মানুষদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে জনপ্রিয় এই সঙ্গীতশিল্পী বলেন, আমি সেই সম্প্রতি-ভালোবাসার জায়গা থেকে এই ভিডিও বার্তাটি পাঠাচ্ছি, অনুগ্রহ করে, আপনারা ব্যবহৃত হবেন না। পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের বন্ধু। এব্যাপারে অন্য কোন বিবেচনা আনবেন না। এইটুকু মনে রাখবেন, যে সম্মানীয় ব্যক্তিটি যাচ্ছেন, তার সরকার এবং দল বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিই জানান নি ক’দিন আগে। আরও অনেক ভাষা স্বীকৃতি পেয়েছে, বাংলা কিন্তু পায় নি। এটা মনে রেখে কি আপনার একটি আপত্তি করতে পারেন না?
সবশেষে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রশংসা করে তাঁর উদ্দেশ্যে কবীর সুমন বলেন, ‘আপনার ভাষা, আপনার দেশের ভাষা, বঙ্গবন্ধুর ভাষা, আপনার পরিবারবর্গের ভাষা, আপনাদের সকলের ভাষা, আপনার দেশবাসীর ভাষা ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পায় নি। যে সরকার এই স্বীকৃতি দেয় নি, সেই সরকারের প্রধান যাচ্ছেন আপনাদের দেশে।’