হরতাল কর্মসূচি শেষে সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামে প্রাণহানির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া এবং গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি জানিয়ে দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে হেফাজতে ইসলাম। গতকাল রোববার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি শেষে সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন হেফাজতের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ সোমবার সারাদেশে দোয়া মাহফিল ও শুক্রবার সারা দেশে বিক্ষোভ। হেফাজত মহাসচিব বলেন, শুক্রবারের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে সামনে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
১০ নেতাকর্মী নিহতের প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলামের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল সারা দেশে বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যদিয়ে পালিত হয়েছে। গতকাল রোববার সকাল থেকে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় হরতালের সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল বের করে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলায় সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করে তারা। পরে পুলিশের অনুরোধে সড়ক অবরোধ তুলে নেয় মাদ্রাসা ছাত্ররা। লালবাগেও বিক্ষোভ করেছেন হেফাজত সমর্থকরা। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রবেশমুখ সাইনবোর্ড, সানারপাড় এলাকায় খুঁটি ফেলে সড়ক অবস্থান নেয় হেফাজতের নেতাকর্মীরা। একপর্যায়ে পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে হেফাজত কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে দাবি করেছে হেফাজত। হেফাজতের অবরোধে ঢাকার সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে সিলেট ও চট্টগ্রামগামী কোন দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যেতে পারেনি। ওদিকে গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে অল্প সংখ্যক দূরপাল্লার বাস ছেড়ে গেছে। সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে গণপরিবহন চলাচল করলেও তা সংখ্যায় সীমিত। দোকানপাট-মার্কেট ও বিপনিবিতান খোলা রয়েছে। হরতালকে ঘিরে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়েছে পুলিশ, র্যাব, বিজিবির সদস্যরা। এপিসি জলকামান নিয়ে বিভিন্ন সড়কে টহল দিচ্ছে তারা। এদিকে পুলিশের পাশাপাশি মাঠে রয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তারা রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়েছে।
এদিকে আমাদের জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় পালিত হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের হরতাল কমসূচি। হাটহাজারী-খাগড়াছড়ি মহাসড়কে খাল কেটে অবরোধ করেছে বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসা ছাত্ররা। এদিকে টানা আন্দোলনে দুদিন ধরে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালিত হচ্ছে। সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। শহরের টিএরোডে অবস্থান নিয়েছে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা। এছাড়া, আরো ১০-১২টি স্থানে অবস্থান নিয়েছেন হেফাজত সমর্থকরা। সিলেট নগরীতে সকাল থেকেই হরতালের সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে অবস্থান নিয়েছে হেফাজতের নেতাকর্মীরা। এতে শহরের গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সুনামগঞ্জে শহরের সড়কে অবস্থান নিয়েছেন হেফাজতের কর্মীরা। তারা দূর-দূরান্ত এবং শহরেও কোনো ধরনের যানবাহন চলাচল করতে দিচ্ছেন না । সীমিত সংখ্যক অটোরিকশাসহ হালকা যান চলাচল করছে। ফেনী-নোয়াখালী সড়ক অবরোধ করেছেন হেফাজত সমর্থকরা। ওদিকে রাজশাহী মহানগরীর ট্রাক টার্মিনালে রাখা বি আরটিসির দুটি বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের বিরুদ্ধে ‘প্রতিবাদী মুসল্লিদের ওপর হামলা ও হত্যার’ প্রতিবাদে রোববার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেয় হেফাজতে ইসলাম। হেফাজত নেতারা আজকের হরতাল সফল করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সংগঠনের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদি হরতালে সংঘর্ষের কোনো ঘটনা যেন না হয়, সে জন্য সরকার ও প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছেন। হেফাজতের আজকের হরতাল কর্মসূচিতে সমর্থন দিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবরোধ, ঢাকার সঙ্গে সিলেট-চট্টগ্রামের ট্রেন চলাচল বন্ধ: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেলপথ অবরোধ করায় ঢাকার সঙ্গে সিলেট ও চট্টগ্রামের ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনের আউটারে রেলপথে পাথর ফেলে রাখায় সকাল ৯ টা ২০ মিনিট থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরআগে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে চলাচলকারী আন্তঃনগর সোনার বাংলার ওপর আশুগঞ্জের তালশহর এলাকায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে হরতাল সমর্থকরা। এই পরিস্থিতিতে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন মাস্টার মো. শোয়েব এবং জিআরপি ফাঁড়ির ইনচার্জ সেতাফুর রহমান ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সাইনবোর্ডে সংঘর্ষ, ভাঙচুর, আগুন, গুলিবিদ্ধ ১: হরতালের সমর্থনে ঢাকা-চট্টগ্রামের প্রবেশমুখ সাইনবোর্ড এলাকায় পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসময় ৪ গাড়িতে আগুন ও শতাধিক গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে শাকিল (২৫) নামে একজন ফার্নিচার মিস্ত্রি গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
জানা গেছে, ১০ নেতাকর্মী নিহতের প্রতিবাদে ডাকা হরতালের সমর্থনে আজ সকাল থেকে বিদ্যুতের খুঁটি ফেলে ও টায়ার জ্বালিয়ে মহাসড়কটি অবরোধ করে রাখে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী। এতে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বেলা ১১টার দিকে পুলিশ বিজিবির সদস্যরা তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে বিজিবির সদস্যরা। এসময় উভয়পক্ষে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ শুরু হয়।
সংঘর্ষের এক পর্যায়ে শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করে হেফাজত কর্মীরা। এ ঘটনায় একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন জানা গেছে। থেমে থেমে চলে সংঘর্ষ। হেফাজতে ইসলামের সহ¯্রাধিক কর্মী ওই এলাকায় অবস্থান করে। বেশকিছু দূরে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা অবস্থান করে। এদিকে বেলা ১২টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর ব্রিজ এলাকায় ৪ গাড়িতে আগুনের দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে মুহূর্তেই গাড়িগুলো সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়।
ওদিকে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে বেলা পৌনে ২টায় পুলিশ বিজিবির যৌথ অভিযানে সাইনবোর্ডের মূল সড়ক থেকে পিছু হটে হেফাজত কর্মীরা। এসময় মুহুর্মুহু রাবার বুলেট ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে হেফাজত কর্মীদের ধাওয়া করে। হেফাজট নেতাকর্মীরা পিছু হটার পর সাইনবোর্ড থেকে সানারপাড় পর্যন্ত এলাকা পুলিশ-বিজিবি নিয়ন্ত্রণে নেয়। এসময় আরও কয়েজন গুলিবিদ্ধ হয়। দুটি এম্বুলেন্সযোগে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
সড়কে নামাজ আদায়: নারায়ণগঞ্জের মাদানীনগর মাদরাসার সামনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় চারটি গাড়িতে আগুন দিয়েছে অজ্ঞাতরা । এ দিকে রোববার দুপুরে ওই মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে জোহরের নামাজ আদায় করেছেন হেফাজতকর্মীরা। এ রিপোর্ট লেখার সময় রোববার দুপুর সড়কে হেফাজতকর্মী ও পুলিশ পাশাপাশি অবস্থান করছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, হরতালকারীরা দু’টি ট্রাক, একটি বাস ও একটি হায়েস গাড়িতে আগুন দিয়েছে। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ সময় সাংবাদিকরা ছবি তুলতে গেলে হরতালকারীরা তাদের বাধা দেয়।
এ দিকে রোববার হেফাজতে ইসলামীর সকাল-সন্ধ্যা হরতালকে কেন্দ্র করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ এলাকায় সকাল থেকে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় হেফাজতকর্মীদের লক্ষ্য করে বিজিবি সদস্যরা গুলি ছুড়েছে বলে দাবি করেছে হেফাজতে ইসলাম। এতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে চিটাগাংরোড পর্যন্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। গতকাল রোববার সকাল ৯টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় টায়ার জ্বালিয়ে রাস্তা অবরোধ করে রাখে হরতালকারীরা। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি ধাওয়া দিয়ে হেফাজতকর্মীদের সরিয়ে দিলে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সনারপাড় এলাকায় হেফাজতের আরেক গ্রুপ রাস্তা অবরোধ করে। এ সময় পুলিশ টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও ফাঁকা গুলি ছুড়লে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। হেফাজতের দাবি বিজিবির গুলিতে তাদের মধ্যে একজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় প্রায় ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ চললেও পুলিশ হেফাজতের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে হেফাজতকর্মীদের শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করার আহ্বান জানানো হয়।
আল্লামা আব্দুল হামিদ গুলিবিদ্ধ: সারা দেশব্যাপী হেফাজতে ইসলামের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন মাওলানা আব্দুল হামিদ (পীর সাহেব মধুপুর)। গতকাল রোববার ২৮ মার্চ দুপুর ১২ টা ৪০ মিনিটে মুন্সীগঞ্জের শিকারিপারা এলাকায় পিকেটিং চলাকালীন সময় গুলিবিদ্ধ হোন আল্লামা আব্দুল হামিদ। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরের একটি ভিডিও ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, আল্লামা আব্দুল হামিদ মধুপুর পীর সাহেব গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আহত হয়ে পড়ে আছেন রাস্তার পাশে একটি দোকানের চৌকাঠে।