শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৪:৫০ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
বিশ্বমানের টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে : রাষ্ট্রপতি রাসূল (সা.)-এর সীরাত থেকে শিক্ষা নিয়ে দৃঢ় শপথবদ্ধ হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে—ড. রেজাউল করিম চৌদ্দগ্রামে বাস খাদে পড়ে নিহত ৫, আহত ১৫ চাহিদার চেয়ে ২৩ লাখ কোরবানির পশু বেশি আছে : মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী রাজনীতিবিদেরা অর্থনীতিবিদদের হুকুমের আজ্ঞাবহ হিসেবে দেখতে চান: ফরাসউদ্দিন নতজানু বলেই জনগণের স্বার্থে যে স্ট্যান্ড নেয়া দরকার সেটিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার মালয়েশিয়ার হুমকি : হামাস নেতাদের সাথে আনোয়ারের ছবি ফেরাল ফেসবুক হামাসের অভিযানে ১২ ইসরাইলি সেনা নিহত আটকে গেলো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অর্থ ছাড় গাজানীতির প্রতিবাদে বাইডেন প্রশাসনের ইহুদি কর্মকর্তার লিলির পদত্যাগ

লাইলাতুল বরাত

উম্মেহানি বিনতে আবদুর রহমান :
  • আপডেট সময় রবিবার, ২৮ মার্চ, ২০২১

আজ লাইলাতুল বরাত। সব প্রশংসা সেই মহান প্রতিপালকের যিনি মানুষকে গোনাহ থেকে মুক্তি লাভের জন্য কিছু সময়কে নির্ধারিত করেছেন; যেন তারা সে সময়ে মহান আল্লাহ পাককে প্রাণভরে ডাকতে পারে ও তাদের পাপ মাফ করাতে পারে, আর আল্লাহর প্রিয় পাত্র হতে পারে। এই নির্দিষ্ট সময়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ইবাদতের রাত হলো শাবানের ১৪তম দিবাগত রাত বা প্রচলিত পরিভাষায় ‘শবেবরাত’।শবেবরাত : ‘শব’ একটি ফারসি শব্দ। এর অর্থ রাত, ‘বারায়াত’কে যদি আরবি শব্দ ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হচ্ছে- সম্পর্কচ্ছেদ। যেমন কুরআন মজিদে সূরা বারায়াত রয়েছে যা সূরা তাওবা নামেও পরিচিত, আল্লাহ বলেন- অর্থ : আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা (সূরা তাওবা-১)।
এখানে বারায়াতের অর্থ হলো সম্পর্ক ছিন্ন করা। ‘বারায়াত’ মুক্তি অর্থেও আল-কুরআনে এসেছে যেমন- অর্থ : ‘তোমাদের মধ্যকার কাফিররা কি তাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ? না কি তোমাদের মুক্তির সনদ রয়েছে কিতাবসমূহে’ (সূরা কামার-৩৪)? আর ‘বারায়াত’ শব্দকে যদি ফারসি শব্দ ধরা হয় তাহলে অর্থ হবে সৌভাগ্য। অতএব শবেবরাত শব্দটার অর্থ দাঁড়ায় মুক্তির রজনী, অথবা সৌভাগ্যের রাত। মুসলিম বিশ্বে বিগত প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে চলে আসা ১৪ শাবান দিবাগত রাতে ইবাদতের জন্য জেগে থেকে পার করা হয়।
শবেবরাত উপলক্ষে কুসংস্কার : এ রজনীকে ঘিরে অনেকেই কুসংস্কারমূলক আচার-অনুষ্ঠান করে থাকে যা বিদয়াতের পর্যায়ে চলে যায়, তা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে এবং পরিবার-পরিজনকে বিরত রাখতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে- ১. হালুয়া-রুটি, গোশত, সেমাই আনুষ্ঠানিকভাবে রান্না করা। ২. আতশবাজি ফুটানো। ৩. দল বেঁধে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ঘুরতে যাওয়া। ৪. ফরজ ছেড়ে নফল নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকা। ৫. এ রাতে আলাদা কোনো নামাজ বা রোজা আছে বলা। ৬. কবর জিয়ারতকে এ রাতের জন্য নির্দিষ্ট করা। ৭. এ রাতে হায়াত-মউত ও রিজিক বণ্টনের বিষয় লেখা হয় বলে যে বিশ্বাস তা কুরআন ও হাদিসবিরোধী, তাই এ বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করতে হবে। ৮. শবেবরাত যে দোয়া কবুলের রাত তা নির্দিষ্টভাবে বিশ্বাস করা যাবে না। বরং প্রতি রাতের শেষ অংশেই দোয়া কবুলের উত্তম সময়।
এ রাতের ফজিলত : শবেবরাতের সব হাদিস একত্র করলে দেখা যায়, তা হাসান লিগইরিহি পর্যায়ভুক্ত সর্বনিম্ম স্তর। অনেক গবেষক বলেছেন, সবগুলো হাদিস একত্র করলে বলা যায় ‘সহিহ লিগইরিহি’ পর্যায়ভুক্ত, আবার অনেকে ‘সহিহ’ বলেছেন। শবেবরাতের ব্যাপারে হাদিস- ১. হজরত আয়শা রা: বলেন, এক রাতে রাসূল সা:কে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকিতে (মদিনার কবরস্থান) গিয়ে আমি তাঁকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, কী ব্যাপার আয়শা? (তুমি যে তালাশে বের হলে?) তোমার কি মনে হয় আল্ল‍াহ এবং তাঁর রাসূল তোমার ওপর কোনো অবিচার করবেন? হজরত আয়শা রা: বললেন, ‘আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোনো বিবির ঘরে গেছেন। রাসূল সা: তখন বললেন, যখন শাবান মাসের ১৫ রাত আসে অর্থাৎ যখন শবেবরাত হয়, তখন আল্ল‍াহ পাক এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি : ৭৩৯, আহমাদ : ২৬০২৮)। মানুষ মাত্রই ভুলের মধ্যে রয়েছে। ফেতনার এমন সঙ্কটময় সময়ে রবের কাছে সার্বক্ষণিক ক্ষমা প্রার্থনা মুমিন ব্যক্তিদের জন্য আবশ্যক। মহান রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য রাতের ইবাদত অত্যন্ত ফলপ্রসূ, এই লক্ষ্যে যদি এ রাত আল্লাহর স্মরণে অতিবাহিত হয় তবে তা মুমিনের জন্য কল্যাণকরই হবে। ২. হজরত মুয়াজ বিন জাবাল রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘অর্ধ শাবানের রাতে (শবেবরাতে) আল্ল‍াহ তায়ালা তাঁর সব মাখলুকের প্রতি মনোযোগ আরোপ করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষভাবাপন্ন ব্যক্তি ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন’ (ইবনে হিব্বান : ৫৬৬৫, মুসনাদুল বাজ্জার : ২৭৫৪, ইসহাক বিন রাহওয়াই : ১৭০২, আল মুজামুল আওসাত:৬৭৭৬, আল মুজামুল কাবির:২১৫, ইবনে মাজাহ : ১৩৯০)।
আল্লাহ ১৫ শাবান রাতে অপেক্ষা করেন বান্দাদের মধ্য থেকে অধিক সংখ্যককে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য। বর্ণিত হাদিসটি হোক হাসান বা সহিহ, যেখানে রবের ইবাদত করে তাকে সন্তুষ্ট করার ইচ্ছা পোষণে আরো কি কোনো উদাহারণ পেশের প্রয়োজন আছে?
৩. হজরত আয়শা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা:কে শাবান মাসের মতো এত রোজা অন্য মাসে রাখতে দেখিনি’ (নাসায়ি : ২১৭৯ সহিহ)। সহিহ মুসলিম গ্রন্থের ২৬৫৩ ও মিশকাতের ৭৯ এবং অন্যান্য সহিহ হাদিস দিয়ে প্রমাণিত, রাসূল সা: চাঁদের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখতেন। শবেবরাত এ তিন চাঁদের একদিন তো পায় তবে কেন এ দিন রোজা রাখা বিদয়াত হবে? তবে অবশ্যই এ কথা বলা যাবে না যে, রোজা একটি রাখা লাগবে বা বেশি রাখা লাগবে। শাবানের শুরু থেকে শেষ দুই-তিন দিন আগে পর্যন্ত রোজা রাখা যাবে।
৪. হজরত আলী রা: থেকে বর্ণিত-রাসূল সা: বলেছেন- ‘মধ্য শাবান এলে তোমরা রাতে ইবাদত করো আর দিনে রোজা রাখো’ (ইবনে মাজাহ : ১৩৮৮)।
ওই হাদিসটি জয়িফ, তবে এই মর্মে ‘হাদিসে নুজুুল’ যা ইবনে মাজার ৯৮ নম্বর পৃষ্ঠায় হজরত আয়শা রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে বিধায় তা আমলযোগ্য বলে পরিগণিত হয়েছে। এ হাদিস থেকে জানা গেল; শবেবরাতের দিনে রোজা রাখা ও রাতে নামাজ পড়ার বিশেষ তাকিদ, হাদিসটি যদিও জয়িফ তবে এর বিপরীত এমন কোনো সহিহ হাদিস নেই যেখানে বলা হয়েছে- এ রাতে নামাজ পড়া যাবে না এবং দিনে রোজা রাখা যাবে না। সুতরাং বলা যায়, শবেবরাত একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত। এ রাতে অধিক নামাজ পড়া উত্তম, দিনে রোজা রাখা সওয়াবের। শবেবরাতে রাতে ইবাদত এবং দিনে রোজা রাখায় কোনো নিষিদ্ধতা নেই শরিয়তে, এ রাতের ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করা হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে এ রাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব।
জয়িফ হাদিসের ব্যাপারে মতামত : দুর্বল বা জয়িফ হাদিস আমলের প্রতি উৎসাহদানে বর্ণনা করা যায়। ইমাম ইবনে হুমাম রহ: বলেন, ‘জয়িফ হাদিস যা মাওজু বা জাল নয় তা ফজিলতের আমলসমূহে গ্রহণযোগ্য (ফাতহুল কাদির-২/৪৩৮)।
মোল্লা আলী কারি রহ: বলেন- সবাই একমত যে, জয়িফ হাদিস ফজিলত হাসিল করার জন্য আমল করা জায়েজ আছে (আলমাওজুআতুল কাবির : ১০৮ পৃষ্ঠা)। আল্ল‍ামা ইবরাহিম হালবি রহ: বলেন- জয়িফ হাদিস দ্বারা সব আমলই মোস্তাহাব। যেমন- গোসলের পর রুমাল দিয়ে শরীর মোছা মোস্তাহাব। (গুলিয়াতুল মুস্তামালি ফি শরহি মুনিয়াতুল মুসল্লি, তিরিমিজি-১/১১২ পৃষ্ঠা)।
শবেবরাত সম্পর্কে মুহাক্কিকদের অভিমত : ১.ফিকহে হানাফির আল্ল‍ামা শামি ইবনে নুজাইম, আল্লামা শারামবুলালি আবদুুল হক মুহাদ্দেসি দেহলভী, আশরাফ আলী থানবী, আবদুুল হাই লাখনোভী মুফতি মুহাম্মদ শফিসহ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম মুহাক্কিক আলেম বিচারপতি মুফতি তকি উসমানি দা. বা. বলেন- শবেবরাতে শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী জাগ্রত থেকে একাকীভাবে ইবাদত করা মুস্তাহাব’ (সূত্র : আদদুররুল মুখতার : ২/২৪-২৫, আর বাহরুর রায়িক : ২/৫২, মা ছাবাতি বিসসুন্নাহ : ৩৬, মারাক্কিল ফালাহ : ২১৯, জাওয়ালুস সিনাহ : ১৭)।
২. ইমাম শাফেয়ি রহ: বলেন, শাবানের ১৫তম রাতে বশি বেশি দোয়া কবুল হয়ে থাকে (কিতাবুল উম্ম-১/২৩১)।
৩. ইবনে রজব হাম্বলি রহ: বলেন, শবেবরাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব। (আল মাবদি-২/২৭, কাশফুল কিনা-১/৪৪৫)।
৪. ইমাম হাজ মালিকি রহ: বলেন, সালফে সালিহিরা এ রাতকে যথেষ্ট সম্মান করতেন এবং এর জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন (আল মাদখাল-১/২৯২-৯৩)।
৫. শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ: বলেন, ‘অর্ধ-শাবান দিবাগত রাতের ফজিলত বিষয়ে অনেক হাদিস ও আসর আছে, যা প্রমাণ করে, এটি একটি ফজিলতপূর্ণ রাত এবং সালাফের অনেকেই এ রাতে নামাজের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। (ইকতিজাউস সিরাত-১/৩০৩)। আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি রহ: বলেন, ‘শবেবরাতের ব্যাপারে অনেক সহিহ বর্ণনা আছে’ (শাজি-২/৪৯)। এ ছাড়া ইবনে মুনজির, ইমাম তাবারানি, নুরুদ্দীন হাইসামি রহ:সহ অনেক মুহাক্কিক শবেবরাতের ব্যাপারে কথা বলেছেন এবং আমল করেছেন ও আমল করতে উৎসাহ দিয়েছেন।
নিসফুশ শাবান কেন্দ্র করে রাত জেগে আমল করা বা পরদিন রোজা রাখার মধ্যে পুণ্য রয়েছে, তবে যে ব্যক্তি পুরো জীবনে এ দিনে রোজা রাখবে না এবং রাত জেগে নামাজ পড়বে না সে কিয়ামতের মাঠে জিজ্ঞাসিত হবে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বান্দার সরিষা পরিমাণ আমলেরও প্রতিদান দেবেন। যিনি সরিষা পরিমাণ আমলেরও প্রতিদান দেবেন তাঁর ইবাদত করার ক্ষেত্রে কেন আমরা এ রাতের বিষয়ে রেফারেন্স তালাশে ব্যস্ত থাকব। আমলের বিষয়ে রব জানুক, আমল করা হোক। আল্লাহ আমাদের সবাইকে অতিরঞ্জিত সব বিষয় থেকে হিফাজত করুন, আমীন। লেখিকা : শিক্ষার্থী, আল-কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com