মেঘনার উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর। অনুকূল আবহাওয়া ও উর্বর মাটির কারণে এ অঞ্চলে সয়াবিনের বাম্পার ফলন হয়। দেশে উৎপাদিত মোট সয়াবিনের ৮০ ভাগ সয়াবিন লক্ষ্মীপুরে উৎপাদিত হয়ে থাকে। ব্যাপক ভাবে এই ফসলের আবাদ ও বাম্পার ফলন হওয়ায় লক্ষ্মীপুর ‘সয়াবিনের রাজধানী’ খ্যাতি পেয়েছে। যে কারণে ব্রান্ডিং হিসাবে লক্ষ্মীপুরকে ‘সয়াল্যান্ড’ নামকরণও করা হয়। কিন্তু বর্তমানে সয়াবিনের রাজধানী লক্ষ্মীপুরে সয়াবিন উৎপাদনে দেখা দিয়েছে ভাটা। দিনদিন কমছে এই জেলায় সয়াবিনের আবাদ। লক্ষ্মীপুরের প্রায় শতভাগ কৃষক সয়াবিন আবাদের সাথে জড়িত। প্রতিবছর এই জেলায় সয়াবিন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে চাষাবাদ হতো অতিরিক্ত জমিতে। ২০১৯ সালে জেলায় সয়াবিনে আবাদ হয়েছে ৪৮ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে। তার পরের বছরই এর আবাদ নামে ৪০ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে। আর এবার গত বছরের ছেয়ে ১০০ হেক্টর জমিতে কম আবাদ হয়ে তা দাড়িয়েছে ৪০ হাজার ৮১০ হেক্টর জমিতে। এতে দিনদিন জেলায় সয়াবিনের আবাদ না বেড়ে কমছে আবাদ ও উৎপাদন। গত দুই বছর থেকে সয়াবিন চাষে বিপাকে পড়েন কৃষকরা। মৌসুমের শুরুতে অসময়ের টানা বৃষ্টিতে দীর্ঘদিন জমিতে পানি জমে থাকছে। এতে নিচু জমিতে লাঙল দেওয়া যাচ্ছেনা। আবহাওয়া আনুকূলে না থাকায় সয়াবিনের রাজধানী লক্ষ্মীপুরে গত দুই বছর থেকে আবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছেনা কৃষি বিভাগ। তবে কৃষি বিভাগ বলছেন বর্তমানে স্থানীয় কৃষকরা অন্য ফসল উৎপাদনে বেশি আগ্রহী হওয়ায় ও আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় কমছে সয়াবিনের চাষ। স্থানীয় কৃষকদের কাছে সয়াবিন শস্যটি ‘সোনা’ হিসেবে পরিচিত। এখন রবি মৌসুম। এ সময়ে সয়াবিন আবাদ হয়। তাইতো সোনা ফলাতে বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে বীজ বুনেছেন কৃষক। মৌসুমের শুরুতে লাগানো বীজ থেকে চারা গজিয়েছে। চারা থেকে গাছ এখন পরিপক্ক হয়েছে। সয়াবিন গাছে এসেছে ফল। জেলার রামগতি, কমলনগর, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর সদর ও রামগঞ্জ উপজেলায় আমন ধান কাটার পরই কৃষকরা সয়াবিন আবাদের প্রস্তুতি নেন। জমিতে রস থাকতে থাকতে চাষ দেন। আইল কেটে নেন, জমির উঁচু-নিচু সমান করেন। আগাছা পরিষ্কার, জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন। জমি শুকালে মই দিয়ে মাটি ঝরঝরে করা হয়। সব প্রস্তুতি শেষে বীজ বোনেন কৃষকরা। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলে সয়াবিনের বীজ বোনা। কৃষকরা সারিতে এবং ছিটিয়েও সয়াবিনের আবাদ করেন। বীজ থেকে চারা উঠে, গাছে এখন ফল এসেছে। এখন পরিচর্যার পালা-আগাছামুক্ত রাখা, প্রয়োজনে সেচের ব্যবস্থা করা। পোকা-মাকড় দমনে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নেওয়া। এ সব যথাযথ ভাবে করছেন কৃষক, এতে সোনা ফলে। হয় বাম্পার ফলন। স্থানীয় কৃষক সেকান্ত আলী, ফুল মিয়া, দেলোয়ার হোসেনসহ অনেকে জানান, সয়াবিন আবাদে খরচ কম। রোগ ও পোকার আক্রমণও কম হয়। চাষাবাদ পদ্ধতি সহজ। বিক্রি করলে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায় ধানের চেয়ে বেশি। যে কারণে এখানকার কৃষকরা সয়াবিন চাষে আগ্রহী ছিলেন। তবে গত কয়েক বছর সয়াবিন চাষ করে লাভের মুখ না দেখায় কৃষকরা সয়াবিন চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এতে দিন দিন এই জেলায় কমছে সয়াবিনের চাষাবাদ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারি পরিচালক মো. আবুল হোসেন জানান, সয়াবিন বছরের সব সময় চাষ করা যায়। তবে রবি মৌসুমে ফলন বেশি হয়। যে কারণে রবি মৌসুমে সয়াবিনের আবাদ হয়ে থাকে। ৯৫ থেকে ১১৫ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়। হেক্টর প্রতি ১.৫ থেকে ২.৫ টন উৎপাদন হয়ে থাকে। চলতি মৌসুমে জেলায় ৪০ হাজার ৮১০ হেক্টর জমিতে সয়াবিনের আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় ৩ হাজর ২৭০ হেক্টর জমিতে, রায়পুরে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে, রামগঞ্জে ৪০ হেক্টর জমিতে, রামগতিতে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে ও কমলনগর উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে ১২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সয়াবিনের আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৭ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. বেলাল হোসেন খান বলেন, অসময়ে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি ডুকে পড়ার করণে চর আঞ্চলের জমিতে সঠিক সময়ে কৃষক চাষাবাদ করতে পারেনি। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় লক্ষ্মীপুরে সয়াবিনের আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়ায়নি। তবে আশাকরি যা আবাদ হয়েছে তাতে ভালো ফলন পাওয়া যাবে। কাঙ্খিত ফলন পেতে কৃষি অফিস ও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের নিয়ে কাজ করছেন। সয়াবিনের পাতাসহ অন্যান্য অংশ এবং শিকড় অল্প সময়ের মধ্যে পচে-গলে মাটিতে জৈব সার তৈরি করে। এর ফলে মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ অনেক উন্নত হয়। মাটি হয় পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। সয়াবিন চাষের ফলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে পরবর্তী ফসলে সারের ব্যবহার অর্ধেক নেমে আসে। উৎপাদন খরচ কমে যায়। ফলনও ভালো হয়। বাণিজ্যিকভাবে সয়াবিন চাষে আমদানি নির্ভরতা কমানো, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, দারিদ্র দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব। তাছাড়া সয়াবিন তেল জাতীয় শস্য। গাছ ৩০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার উঁচু হয়। গাছের কান্ডে ফুল হয়। ফুল থেকে শিমের মতো চড়াতে বীজ জন্মে, এই বীজগুলোকেই সয়াবিন বলা হয়। সয়াবিন ভোজ্যতেলের প্রধান উৎস। এটি অত্যন্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। কচি ও শুকনো সয়াবিন বীজ সবজি ও ডাল হিসেবে খাওয়া হয়। পরিণত সয়াবিন বীজ থেকে শিশুখাদ্য, সয়া দুধ, দই-পনির, বিস্কুট ও কেকসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার তৈরি হয়ে থাকে। এছাড়াও পোল্ট্রি ও ফিশফিড তৈরি, রং, সাবান এবং প্লাস্টিক মুদ্রণের কালি ইত্যাদি দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সয়াবিন একটি অপরিহার্য উপাদান।