দুই ম্যাচের একটি টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচটি খেলতে আগামীকাল থেকে মাঠে নামছে বাংলাদেশ, এবারে প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা। পাল্লেকেলেতে বাংলাদেশ সময় সাড়ে ১০টায় শুরু হবে খেলা। সাকিব আল হাসান অবশ্য মাঠেই আছেন – তবে তিনি ব্যস্ত আইপিএল নিয়ে, তাই শ্রীলঙ্কা সফরে তিনি নেই।
কিন্তু বছর দেড়েকের কিছু বেশি আগে তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আরোপের পর থেকে বাংলাদেশ দলের আনুষ্ঠানিক প্রেস কনফারেন্সে অধিনায়কদের একটা প্রশ্ন প্রতিনিয়ত শুনতে হয় – সাকিবকে ছাড়া খেলাটা কতটা কঠিন?
তবে সাকিব ছাড়াও বাংলাদেশ যে খেলতে পারে মমিনুল হক এবার বলেই দিলেন – অন্যদেরও দশটা-বারোটা হাত নেই, সাকিব ভাই বা মুস্তাফিজেরও দশ-বারোটা হাত নেই। কিন্তু টেস্টে সাকিব আল হাসান না থাকলেই মূলত দুটো সমস্যায় পড়ে টিম ম্যানেজমেন্ট- একজন বাড়তি বোলার ও একজন বাড়তি ব্যাটসম্যান প্রয়োজন হয়।
চার বছর ধরেই টেস্টে অনিয়মিত সাকিব: সেই ২০১৭ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকেই সাকিব টেস্ট ক্রিকেটে কিছুটা অনিয়মিত। হাতের চোট, ছুটি, নিষেধাজ্ঞা এবং এবারে আইপিএল – দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের দুটি টেস্ট থেকে শুরু করে সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ পর্যন্ত বাংলাদেশের খেলা ১৯টি টেস্ট ম্যাচের মধ্যে মাত্র ছয়টি টেস্টে খেলেছিন সাকিব। এই ছয়টি টেস্টের মধ্যে দুইটি টেস্টে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে শুধুমাত্র ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে হোম এবং অ্যাওয়ে সিরিজেই পরোটা সময় দলে ছিলেন সাকিব।
অধিনায়ক হিসেবে ছিলেন আফগানিস্তানের বিপক্ষে দেশের মাটিতে খেলা একটি টেস্ট ম্যাচে, যেখানে বাংলাদেশ বড় ব্যবধানে হেরে যায়। বাকি যে ১৩টি ম্যাচে সাকিব খেলেননি, তার মধ্যে মাত্র দুটো ম্যাচে জিতেছিল বাংলাদেশ- জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।
ব্যাটিংয়ে সাকিবের জায়গায় কে? টেস্টে সব সময়েই বাংলাদেশের মাথাব্যথার মূল কারণ ব্যাটিং। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের সবশেষ জয় এসেছিল সেই ২০১৭ সালে – ম্যাচটি ছিল শ্রীলঙ্কার মাটিতে।
সাকিব গত চার বছরে যেসব টেস্টে খেলেননি, সেইসব ম্যাচে তার জায়গায় বাংলাদেশ সৌম্য সরকার, মোহাম্মদ মিঠুন, সাব্বির রহমান আর লিটন দাসকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলিয়েছে। কিন্তু তারা চারজন টেস্ট ফরম্যাটে উল্লেখ করার মতো পারফরম্যান্স দেখাতে পারেননি।
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্রিকেট কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিম মনে করেন, সমস্যা অন্য জায়গায়। সাকিব আল হাসানের পজিশনে যারা খেলেছেন সাব্বির ছাড়া তারা সবাই আসলে ওপেনিং ব্যাটসম্যান।‘আমরা যেটা করি তা হলো, লিমিটেড ওভারে কেউ ভালো খেললেই তাকে আমরা টেস্ট ক্রিকেটে নিয়ে আসি। আমরা দেখি না টেস্ট ক্রিকেটের মেরিট তাদের কতটা আছে। এটা যতটা না ক্রিকেটারদের সমস্যা, তার চেয়ে বেশি সিস্টেমের সমস্যা,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
সাকিব টেস্টে ব্যাট করে পাঁচ নম্বর পজিশনে। ২০২০ সালে পাঁচ নম্বরে নেমে মুশফিকুর রহিম একটি ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। আর ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্টে লিটন দাস ৯৪ রানের একটি ইনিংস খেলে ম্যাচ ড্র করেন।
সাকিব না থাকলে মিডল অর্ডারে যে জায়গাটা ফাঁকা হয়, সেখানে খেলার জন্য ঘরোয়া ক্রিকেটে মিডল অর্ডারেই খেলেন এমন ব্যাটসম্যানকে সুযোগ দেয়ার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম।
বোলিংয়ে সাকিবের জায়গায় কে? সাকিব আল হাসান টেস্টে অনেকটা নিয়মিতভাবে দিনে ২০ থেকে ৩০ ওভার বল করেন। একই সাথে যেসব উইকেটে স্পিন ধরে, সেখানে কখনো কখনো ওভারের সংখ্যাটা ৩৫ থেকে ৪৫ ওভার পর্যন্ত দাঁড়ায়।
বোলিংয়ে তাইজুল ইসলামের সঙ্গী হয়ে মেহেদি হাসান মিরাজ এবং তুলনামূলক তরুণ নাইম হাসান মোটামুটি ভালো বল করেছেন সাম্প্রতিক কিছু ম্যাচে। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে বোলারদের লক্ষ্য থাকতে হয় প্রতিপক্ষের ২০টি উইকেট তুলে নেয়া।
এই কাজটি বাংলাদেশের বোলাররা দেশের বাইরে খুব কমই করতে পেরেছে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ৫৬টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছে দেশের বাইরে, যার মধ্যে মাত্র পাঁচটি ম্যাচে প্রতিপক্ষের পুরো ২০টি উইকেট নিতে পেরেছিল বাংলাদেশ। এটি দু’বার ঘটে ২০০৯ সালে ক্যারিবিয়ান সফরের সময়, যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের মূল দলের খেলোয়াড়রা ধর্মঘটের গিয়ে সেই সিরিজে খেলেননি।
সেই টেস্টে সাকিব আল হাসান সেঞ্চুরি করেন, ইনিংসে ৪ উইকেট নেন। সাথে ভালো ব্যাট করেছিলেন তামিম ইকবাল। তাই ম্যাচে মাঠে নামার আগে সাকিবের অভাব পূরণ করার ভাবনা থাকবেই বাংলাদেশের।
বিশেষত, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জাতীয় দলের বাইরের ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া দলের কাছে দেশের মাটিতে ম্যাচ হারের পর টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স এখন প্রশ্নের মুখে।
‘এক কথায় সাকিবের বদলি এখন নেই’: তবে নাজমুল আবেদীন ফাহিমের মতে, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে সাকিবের জায়গা পূরণ করার মতো ক্রিকেটার এখনো নেই। সাকিব যে পজিশনে খেলেন, সেখানে আসলে তিনি না থাকলে অভিজ্ঞতা আর পারফরম্যান্স দুটো দিক থেকেই পিছিয়ে যায় বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, এটা আবার একই সাথে একটা সুযোগও নতুন ক্রিকেটার তুলে আনার, যে কাজে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। ‘একজন ক্রিকেটার নেই, এটা নিয়ে না ভেবে বরং যারা আছেন, তাদের নিয়েই তো এগুতে হবে। সাকিব অবসরে যাবেন, বা টেস্ট থেকে রিটায়ার করবেন একদিন।’ সাকিবকে নিয়ে হোক কিংবা সাকিবকে ছাড়া হোক, বাংলাদেশ আসলে চার বছর আগে যে মানের ক্রিকেট খেলতো এখন তা খেলতে পারছে না বলে মন্তব্য করেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম। ‘আসলে কাগজে-কলমেই বাংলাদেশ এখন বেশ খারাপ অবস্থায় আছে,’ বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট দল মূলত এখন একটা আস্থাহীনতার জায়গায় আছে।’ সূত্র : বিবিসি