গাজীপুরের কালিয়াকৈরে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অর্থের অভাবে প্রতিষ্ঠান ব্যয় বহন করতে না পারায় ইতিমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দোকান ও রেস্টুরেন্টে পরিণত হয়েছে। অতিমারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক গেল বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশ ব্যাপী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিন্ডারগার্টেনসহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে চলছে সর্বাত্মক লকডাউন আর এই লকডাউনে আরো বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ ও কিন্ডারগার্টেনের পরিচালনা পরিষদসহ শিক্ষকরা। কোভিড-১৯ এর কারণে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ২৬০টি কিন্ডারগার্টেনে কর্মরত প্রায় ৫০০০ শিক্ষক দীর্ঘ ১৪ মাস বেতন বন্ধ থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। চক্ষু লজ্জার ভয়ে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতেও পারছেন না। পারছেন না মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলতে। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের পরিবারে চলছে নীরব দুর্ভিক্ষ চোখে আছে ব্যাপক হতাশার ছাপ।
একদিকে রমজানের কারণে পরিবারের অনেক ব্যয় বহন করতে হিমশিম খাচ্ছে তারা, অপরদিকে সামনে আসছে ঈদুল ফিতর আর এই ঈদ উপলক্ষে প্রত্যেক শিক্ষকের সন্তানসহ পরিবারের সকলেই নতুন জামার আশায় বসে থাকে। পবিত্র ঈদকে কেন্দ্র করে বাজারেরও একটি চাহিদা থাকে সকল পরিবারে। উপজেলার এক কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকের সাথে কথা হলে এসব চাহিদা মেটানোর কথা মনে করে তার চোখেমুখে দেখা মিলে নীরব আর্তনাদ ও হাহাকারের চিত্র।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, শিক্ষক হচ্ছে জাতির বিবেক রাষ্ট্র পরিচালকসহ সকল মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষাই জাতির মেরুদ- আর সেই মেরুদ-কে দ-ায়মান করে রাখেন শিক্ষকরাই তাই শিক্ষকদের প্রাপ্য মর্যাদা দেয়া উচিত। আমার মনে হয় আমরা শিক্ষিত হয়ে ভুল করেছি না পারছি মাঠে কাজ করতে, না পাচ্ছি কোন বেতন ভাতা। যারা সরকারি চাকরিজীবী তাদের তো কোনো চিন্তা নেই যত সমস্যা আমাদের। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যাকে আমরা মানবতার মা হিসাবে জানি আমি বাংলাদেশের সকল কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের পক্ষ থেকে উনার নিকট মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের নিয়ে বিবেচনা করার জন্য বিশেষভাবে আবেদন জানাচ্ছি। এছাড়া, দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় উপজেলার প্রায় এক লাখ বিশ হাজার শিক্ষার্থীর পাঠ গ্রহণসহ সকল শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হয়েছে। মহামারীকালীন প্রায় সময়েই দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ব্যতীত পোশাক কারখানাসহ অফিস-আদালত এবং প্রায় সকল সেক্টরই খোলা রয়েছে। পোশাক কারখানায় প্রতিনিয়ত প্রচুর লোক যাতায়াত করেন এদের মধ্যে কেউ না কেউ শিক্ষার্থীদের অভিভাবকও রয়েছেন। শিক্ষার্থীরা তাদের মাধ্যমেও সংক্রমিত হতে পারত কিন্তু এ ব্যাপারে তেমন কোন প্রভাব দেখা যায়নি। আর যেহেতু পরিসংখ্যানে দেখা যায় ৩০ বছরের নিচে লোক জনদের এই ভাইরাসটি তেমন ক্ষতি করতে পারে না তাই এখন স্কুল খুলে দেয়া যেতে পারে, এমন পরামর্শও দিয়েছেন অনেক অভিভাবক। আরো বিদ্যালয় বন্ধ থাকলে কিন্ডারগার্টেন মালিক এবং শিক্ষকদের অবস্থা দিন দিন মারাত্মক আকার ধারণ করবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার প্রতি অনীহা প্রকাশ পাচ্ছে, বিভিন্ন গেমস এবং মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে মতামত প্রকাশ করেছেন কিছু অভিভাবক।
এক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বলেন, আমাদের কিন্ডারগার্টেন গুলো চলে একমাত্র শিক্ষার্থীর বেতনের উপর নির্ভর করে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ থাকায় কোন শিক্ষার্থীর অভিভাবক বেতন দিতে চাচ্ছে না। তাই এমতাবস্থায় আমরা প্রতিষ্ঠান ভবনের ভাড়া ও শিক্ষকদের বেতন দিতে পারছি না। পরিবারের ব্যয় ও চাহিদা মেটাতে ইতিমধ্যে আমি আমার গ্রামের বাড়িতে একটি কৃষি প্রজেক্ট করেছি পাশাপাশি আমার প্রতিষ্ঠানের একটি কক্ষে আমি জামা কাপড়ের দোকান করেছি। এ অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করছি।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন গাজীপুর জেলার সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক ও শাহীন স্কুলের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে করোনা ভাইরাস নামক মহামারীর প্রভাবে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ভাতা এবং প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বহন করতে না পারায় উপজেলায় ৫টি স্কুল ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন পত্রিকা এবং টেলিভিশনে প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে জানা গেছে অর্থের অভাবে দেশের কিছু কিন্ডারগার্টেন স্কুল রেস্টুরেন্টেও পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা ছাড়া কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে বলে আমি মনে করি।
এই মুহূর্তেও যদি স্কুল খুলে দেয়া হয় তারপরেও এই প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়াতে এখন থেকে প্রায় তিন বছর সময় লেগে যাবে। এমতাবস্থায় কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রতি বিশেষ বিবেচনার জন্য আমি সকল কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ও সহযোগিতা কামনা করছি।
কালিয়াকৈর প্রাইভেট স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদ বলেন, কালিয়াকৈর উপজেলার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলো করোনার এ সঙ্কটে দিন যাচ্ছে তাদের সীমাহীন কষ্টে। লজ্জায় অনেকে আবার অন্যদের কাছে নিজের সঙ্কটের কথা বলতেও পারছেন না। সামাজিক মর্যাদার কথা চিন্তা করে মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে অনেক কিছুই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের বেতন বা টিউশন ফি আদায় করতে পারছেন না, অভাবের কথা না পারছে কাউকে বলতে, আবার না পারছে পরিবার পরিজন নিয়ে টিকে থাকতে। শিক্ষকতার মতো এমন একটি পেশায় থেকে এখন কাউকে নিজেদের অসহায়ত্বের কথা বলতে পারছি না। সরকারের পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন স্কুল দেশের শিক্ষাখাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে বলে আমি মনে করি।
ইতিপূর্বে উপজেলা শিক্ষা অফিস আমাদের কাছ থেকে শিক্ষকদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছিলো আমরা মনে করেছিলাম যে, হয়তো সরকারি কিছু সহযোগিতা পাব কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই পাইনি। তাই এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করছি।