রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৪ অপরাহ্ন

শরিয়তসম্মত মতদ্বন্দ্ব ও নিন্দিত দলাদলি

ড. ইউসুফ আল কারযাভী:
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৯ মে, ২০২১

উম্মাহ তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে মর্মে বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, উম্মাহ সত্তরটির অধিক দলে বিভক্ত হবে তার সবগুলো জাহান্নামি হবে কেবল একটি মাত্র দল মুক্তি পাবে। এ হাদিসটি প্রমাণিত কি না এবং তার প্রকৃত তাৎপর্যই বা কি? সে ব্যাপারে অনেক কথা রয়েছে : ক. এখানে যে বিষয়টি সর্বাগ্রে জেনে নেয়া দরকার তা হলো : এ হাদিসটির বিষয়বস্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তা বুখারি ও মুসলিমের কোথাও বর্ণিত হয়নি। এর মানে হলো এ হাদিসটি ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিম কারো শর্তে উপনীত হয়নি।
এটা সত্য যে, তারা দু’জনেই সব সহিহ হাদিস বর্ণনা করেননি। তবে এটাও সত্য যে, তারা দু’জনেই জ্ঞান জগতের এমন কোনো অধ্যায় নেই যা গুরুত্বপূর্ণ। আর তাতে তারা কিছু না কিছু এমনকি একটি হাদিসও বর্ণনা করার চেষ্টা করেননি।
খ. হাদিসটির কোনো বর্ণনায় এ কথা উল্লেখ করা হয়নি যে, একটি মাত্র দল ছাড়া বাকি সব দল জাহান্নামি হবে। সে বর্ণনায় কেবল তারা নানা দলে বিভক্ত হবে আর দলের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। এটা হচ্ছে আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত সে হাদিস যা আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবন মাজাহ ইবন হিব্বান ও হাকেম বর্ণনা করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, ‘ইহুদিরা একাত্তর বা বাহত্তর দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে ছিল। আর খ্রিষ্টানরাও একাত্তর বা বাহত্তর দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে ছিল। আর আমার উম্মত তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে।’
এ হাদিস সম্পর্কে তিরমিজি যদিও মন্তব্য করেছেন যে, হাদিসটি হাসান সহিহ। আর ইবন হিব্বান ও হাকেম সহিহ বলে মন্তব্য করেছেন। হাদিসটির সূত্রের ভিত্তি হলো মুহাম্মদ ইবন আমর ইবন আলকামা ওয়াক্কাস আল লাইসি। যারা ‘তাহজিবুত তাহজিবে’ তার জীবনী পড়েছেন তারা জানেন যে, লোকটির স্মৃতিশক্তি সম্পর্কে নানা কথা রয়েছে। তা ছাড়া কেউ তাকে পুরোপুরিভাবে নির্ভরযোগ্য বলে মন্তব্য করেননি। তারা যা উল্লেখ করেছেন তার সার কথা হলো; তিনি তার চেয়ে দুর্বলদের তুলনায় অগ্রাধিকার প্রাপ্ত। এ কারণেই হাফেজ ইবন হাজর ‘তাকরিবুত তাহজিবে’ কেবল এতটুকু বলেছেন যে, তিনি সত্যবাদী তবে তার কিছু সন্দেহজনক ব্যাপার আছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে কেবল সত্যবাদী হওয়া যথেষ্ট নয়, তার সাথে অবশ্যই প্রখর স্মৃতির অধিকারী হওয়াও অবশ্যক। আর যদি তার সাথে সন্দেহজনক ব্যাপার থাকে তা হলে কী করে তার হাদিস গ্রহণযোগ্য হতে পারে? এ কথাও পরিজ্ঞাত যে ইমাম তিরমিজি, ইবন হিব্বান ও হাকেম হাদিসের ওপর হকুম দেয়ার ব্যাপারে সহজনীতি অবলম্বনকারীদের অন্তর্ভুক্ত। হাকেম সম্পর্কে বলা হয়েছে তিনি সহিহ সাব্যস্ত করার ব্যাপারে প্রচুর ভুল করেছেন।
তিনি এ হাদিসটি সহিহ মুসলিমের শর্তে উপনীত বলে মন্তব্য করেছেন। কারণ মুহাম্মদ ইবন আমর এর হাদিস দ্বারা ইমাম মুসলিম দলিল দিয়েছেন। তবে হাকেমের এ কথা প্রত্যাখ্যান করেছেন আল্লামা যাহাবি এ কথা বলে যে, তিনি একক রাবি হলে সে ক্ষেত্রে ইমাম মুসলিম তার হাদিস গ্রহণ করেননি। বরং তার সাথে অন্য রাবি থাকলে কেবল তখনই গ্রহণ করেছেন (৬/১)। তা ছাড়া এ হাদিসটি আবু হুরাইরার বর্ণনায় ‘কেবল একটি দল ছাড়া বাকি সব দল জাহান্নামি হবে’ এ অতিরিক্ত অংশটুকু নেই। অথচ এ বাক্যটির উপরেই গোটা বিতর্ক বা ব্যাপারটি নির্ভর করে।
হাদিসটি এই অতিরিক্ত অংশসহ বেশ ক’জন সাহাবি থেকে বর্ণিত হয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন আব্দুল্লাহ ইবন আমর, মুআবিয়া, আউফ ইবন মালেক ও আনছ রহ:। তবে সব হাদিসের সনদই দুর্বল। তাই সব হাদিসকে পরস্পর মিলিয়ে তবে তাকে সহিহ সাব্যস্ত করা হয়েছে।
আমি মনে করি অনেক সূত্রের ওপর নির্ভর করে একটি হাদিসকে সহিহ সাব্যস্ত করা সর্বক্ষেত্রে সঠিক নয়। কারণ এমন অনেক হাদিস আছে যার একাধিক সনদও আছে। তবুও হাদিসগুলোকে দুর্বল বলে মন্তব্য করা হয়েছে। তাখরিজ ও ইলালের গ্রন্থ দেখলে তার প্রমাণ মেলে। অনেক সনদ থাকলে একটি হাদিসকে সহিহ সাব্যস্ত করে তখনই গ্রহণ করা যায়; যখন তার বিরোধী কোনো হাদিস না থাকে। আর অর্থ বা তাৎপর্য সম্পর্কেও কোনো সমস্যা না থাকে।
অথচ এই হাদিসের ক্ষেত্রে একটি বিরাট সমস্যাও রয়েছে। সেটি হলো : এক দিক থেকে ইহুদি খ্রিষ্টানদের চেয়ে বেশি দলে এ উম্মাহ বিভক্ত হবে, আবার অন্য দিকে এসব দলের মধ্যে একটি দল ছাড়া বাকি সব দল ধ্বংস হবে ও জাহান্নামি হবে- এমন ধরনের বিরাট সমস্যাও রয়েছে। এটা এমন একটি ব্যাপার যার কারণে সব দল দাবি করছে যে, তারাই একমাত্র মুক্তি পাবে, আর বাকি সবাই ধ্বংস হবে। এটি এমন একটি দাবি যা উম্মতকে দ্বিধাবিভক্ত করছে এবং এক দল অপর দলকে আঘাত ও আক্রমণ করছে। যার ফলে গোটা উম্মাহ দুর্বল হয়ে পড়ছে, আর তার শত্রুরা শক্তিশালী হচ্ছে এবং উম্মাহকে আঘাত করার সাহস পাচ্ছে।
এ কারণেই আল্লামা ইবনুল ওয়াযীর সাধারণভাবে গোটা হাদিসটির ওপর আর বিশেষভাবে এই অতিরিক্ত অংশের ওপর আঘাত করেছেন। কারণ এর কারণে উম্মাহর এক অংশ অপর অংশকে বিভ্রান্ত বলে অবহিত করছে। বরং এক অংশ অপর অংশকে কাফের পর্যন্ত বলছে।
তিনি তার ‘আল আওয়াসেম’ নামক গ্রন্থে এ উম্মাহর ফজিলত ও মর্যাদা এবং এর কাউকে কাফের বলার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে বলেন : ‘সাবধান ‘একটি দল ছাড়া বাকি সব দল ধ্বংস হবে এমন কথা বলার মতো ধোঁকায় পড়বেন না। কারণ হাদিসের অতিরিক্ত অংশটুকু সহিহ নয়; ফাসিদ। তা মুল্হিদ নাস্তিকদের (হাদিসে অনু প্রবেশকৃত) বানানো কথা হওয়ার সম্ভাবনামুক্ত নয়।
তিনি আরো বলেন যে, ইবন হাযম থেকে বর্ণিত আছে যে, তার মতে ওই অংশটুকু জাল, মাওকুফও নয়; মারফুও নয়। তেমনিভাবে কাদারিয়া মারজিয়া আশআরীয়া সম্পর্কে যেসব হাদিস বর্ণিত হয়েছে তাও দুর্বল শাক্তশালী নয় (আল আওয়াসেম ওয়াল কাওয়াসেম, খ:১,পৃ:১৮৬)।
গ. অতীত ও বর্তমান যুগের অনেক আলেম এ হাদিসটিকে সনদের দিক থেকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আবার কেউ কেউ মতন ও অর্থের দিক থেকেও প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ হাদিসের মতন প্রসঙ্গে একটি প্রশ্ন জাগে। সেটি হলো- আল্লাহ তায়ালা যে উম্মতটিকে অন্যান্য উম্মাতের ওপর সাক্ষ্য হিসেবে মর্যাদা দান করলেন, যাদেরকে তিনি শ্রেষ্ঠ উম্মত মানুষের কল্যাণের জন্যই তাদের সৃষ্টি বলে অবহিত করেছেন, তারা দলাদলির ক্ষেত্রে ইহুদি খ্রিষ্টানের চেয়ে খারাপ, এমনকি তারা দলাদলির দিক থেকে ইহুদি খ্রিষ্টানদের চেয়ে বেশি দলে বিভক্ত হবে, এ হাদিস থেকে এ ব্যাপারটি আবশ্যক হয়ে পড়ে। অথচ আল কুরআন ইহুদিদের সম্পর্কে বলেছে, ‘আর আমি তাদের মধ্যে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত শত্রুতা ও ঘৃণা ঢেলে দিয়েছি’ (সূরা আল মায়েদা : ৬৪)। আর খ্রিষ্টানদের সম্পর্কে বলেছে, ‘‘আর যারা বলে, ‘আমরা নাসারা’, আমি তাদের থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম। অতঃপর তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল, তারা তার একটি অংশ ভুলে গিয়েছে। ফলে আমি তাদের মধ্যে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত শত্রুতা ও ঘৃণা উসকে দিয়েছি এবং তারা যা করত সে সম্পর্কে অচিরেই আল্লাহ তাদেরকে অবহিত করবেন” ( সূরা আল মায়েদা : ১৪)।
আল কুরআনে মুসলিম উম্মাহ এরূপ হতে পারে এ ধরনের কোনো বক্তব্য আসেনি। বরং তাতে এ উম্মাহকে তাদের আগের উম্মতরা যেভাবে দলাদলি করে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল সে রকম দলাদলি করে বিভক্ত হয়ে পড়তে নিষেধ করা হয়েছে।
হাদিসটিতে আরো বলা হয়েছে যে, ‘সব দল জাহান্নামি হবে কেবল একটি মাত্র দল ছাড়া।’ এ বক্তব্যটি এ উম্মাহর ফজিলত সম্পর্কে যেসব বক্তব্য হাদিসে আছে তার সাথে আদৌ সঙ্গতিশীল নয়। যেমন : এ উম্মাহ রহমতপ্রাপ্ত দল, জান্নাতবাসীদের তিন ভাগের এক ভাগ বা দুই ভাগের এক ভাগ তারাই হবেন, ইত্যাদি।
তা ছাড়া ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা সত্তরের অধিক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল এমন কথা তাদের উভয় স¤প্রদায়ের ইতিহাস থেকে জানা যায় না। বিশেষত ইহুদিরা এত দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল তা তাদের ইতিহাস থেকে মোটেও প্রমাণ করা যায় না।
এই যে আবু মুহাম্মদ ইবন হাযম তিনি যারা আকিদাগত কারণে তার কিছু তিনি উল্লেখ করেছেন- অন্যদেরকে কাফের বলে ঘোষণা করে; তাদের চরমভাবে বিরোধিতা করেছেন। আর তারা যেসব দলিলের উপর ভিত্তি করে এরূপ কাফের বলার মতো কাজ করে তার মধ্য থেকে এমন দুটি হাদিসও উল্লেখ করেছেন যা তারা নবী সা:-এর হাদিস বলে দাবি করে থাকেন। হাদিস দুটি হলো :
১. ‘কদরীয়া ও মারজিয়ারা এ উম্মাহর মাজুসি বলে সাব্যস্ত।’
২. ‘এ উম্মাহ সত্তরের অধিক দলে বিভক্ত হবে, সব দল জাহান্নামি হবে একটি দল ছাড়া, সেটি জান্নাতি হবে।’
আবু মুহাম্মদ আরো বলেন : ‘এ দুটি হাদিসের একটিও সনদের দিক থেকে আসলে সহিহ নয়। আর যেসব হাদিস এরকম তা যারা খবরে ওয়াহেদ গ্রহণ করেন তাদের কাছেও গ্রহণযোগ্য নয়, আর যারা গ্রহণ করেন না তাদের কাছে কিরূপ হবে? (তাও অনুমেয়।)
ইয়ামেনি মুজতাহিদ ইমাম হাদিস শাস্ত্রের সেবক বুদ্ধিবৃত্তি ও হাদিসশাস্ত্র উভয় রকম জ্ঞানের অধিকারী মন্ত্রী মুহাম্মদ ইবন ইবরাহীম তার ‘আল আওয়াসেম ওয়াল কাওয়াসেম’ নামক গ্রন্থে মুআবিয়া রা: যেসব হাদিস বর্ণনা করেছেন তার আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন : তার মধ্যে (অষ্টম হাদিসটি হলো) সত্তরের অধিক দলে এ উম্মাহ বিভক্ত হওয়া এবং তার মধ্যে একটি মাত্র দল ছাড়া বাকি সব দল জাহান্নামি হওয়া সংক্রান্ত হাদিসটি সম্বন্ধে বলেন : ‘এ হাদিসটির সনদে একজন নাসেবী আছেন (নাসেবী হচ্ছে এমন একটি বিভ্রান্ত স¤প্রদায় যারা আলী রা: কে গালাগাল করত)। তার হাদিসটি মুআবিয়া থেকে সহিহ সাব্যস্ত হতে পারে না। ইমাম তিরমিজি আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন আস থেকে অনুরূপ হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি তারপর বলেছেন : এটি একটি গরিব হাদিস। তিনি তা কিতাবুল ঈমানে আফ্রিকির সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তার নাম হলো আব্দুর রহমান ইবন যিয়াদ। তিনি আব্দুল্লাহ ইবন ইয়াজিদ থেকে মুআবিয়া থেকে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। আর ইবন মাজাহও আউফ ইবন মালেকের সূত্রে আনাছ থেকে অনুরূপ হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন : এতে সহিহ হাদিসের শর্তে উপনীত হয় এমন একটি হাদিসও নেই। এ কারণেই বুখারি ও মুসলিম তার কোনো হাদিস বর্ণনা করেননি। তিরমিজি তার মধ্যে মুহাম্মদ ইবন আমর ইবন আল কামার সূত্রে আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত হাদিসটি সহিহ বলে মন্তব্য করেছেন। তবে সে হাদিসে ‘একটি দল ছাড়া বাকি সব দল জাহান্নামি হবে’ এ কথাটি নেই। ইবন হাযম থেকে উল্লেখ আছে যে, এই অতিরিক্ত অংশটুকু জাল। ‘বাদরুল মুনীরের’ লেখকও এ কথা বলেছেন (ইবনুল ওয়াযির, আল আওয়াসেম ওয়াল কাওয়াসেম, সম্পাদনা শায়খ শোআইবর আরনূউত, (খ:৩,পৃ:১৭০-১৭২)। তিনি এখানে শায়খ নাসের উদ্দিন আলবানীর বক্তব্য খ-ন করেছেন। নাসির উদ্দিন আলবানী তার ‘আস সহিহ’ এর প্রথম খ- ৩য় অংশে (৩/১৯-২০) বলেছেন যে, ইবনুল ওয়াযির হাদিসটি মতনের দিক থেকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, সনদের দিক থেকে নয়। আমি জানি না তিনি এ কথা কি করে বললেন?)
হাফেজ ইবন কাসীর তার তাফসিরে ‘বলো, তিনি ওপর থেকে বা তোমাদের পদতল থেকে তোমাদের ওপর কোনো আজাব নাজিল করতে অথবা তোমাদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে এক দলকে আর এক দলের শক্তির স্বাদ গ্রহণ করিয়ে দিতে সক্ষম। দেখো, আমি কিভাবে বারবার বিভিন্ন পদ্ধতিতে আমার নিদর্শনসমূহ তাদের সামনে পেশ করছি, হয়তো তারা এ সত্যটি অনুধাবন করবে’ (সূরা আল আনআম ৬৫)। আয়াতটির তাফসির প্রসঙ্গে বলেন : রাসূল সা: থেকে নানা সূত্রে বর্ণিত এক হাদিসে আছে, তিনি বলেছেন : ‘এ উম্মাহ অচিরেই তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে। সব দল জাহান্নামি হবে কেবল একটি মাত্র দল ছাড়া।’ তিনি এরপর আর কোনো কথা বলেননি। তিনি এ আয়াতের তাফসিরে আয়াত সংক্রান্ত হাদিস ও আছর উল্লেখ করে দীর্ঘ আলোচনা করা সত্ত্বেও হাদিসটি সহিহ না হাসান তেমন কোনো কথা বলেননি।
ইমাম শাওকানী এ হাদিস সংক্রান্ত ইবন কাসিরের কথা উল্লেখ করার পর বলেন : আমি বলেতে চাই ‘একটি মাত্র দল ছাড়া সবগুলো দল জাহান্নামি হবে’। এ অংশটুকু একদল মুহাদ্দিস দুর্বল বলে মন্তব্য করেছেন। বরং ইবন হাযম তা জাল বলেও মন্তব্য করেছেন।’
হাদিসটিকে তার একাধিক সূত্র থাকার কারণে কোনো কোনো আলেম হাসান বলে মন্তব্য করলেও যেমন হাফেজ ইবন হাজর, আর কেউ কেউ সহিহ বলে মন্তব্য করলেও যেমন শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া এটা প্রমাণ করে না যে, এভাবে এবং এত দলে এ উম্মাহর বিভক্ত হওয়া কেয়ামত পর্যন্ত অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবীভাবে হতেই থাকবে। কোনো একসময় এভাবে এত দলে উম্মাহ বিভক্ত হলেই হাদিসের বক্তব্য সঠিক বলে প্রমাণিত হবে।
এসব বাতিল দল কখনো কখনো দেখা যায়, আবার তাদের ওপর হকপন্থীরা বিজয়ী হয়, ফলে বাতিলরা চিরতরে বিদায় হয়। আর কখনো ফিরে আসে না। অনেক বাতিল ফিরকার ক্ষেত্রে কার্যতই এরূপ ঘটনা ঘটেছে। তাদের অনেক দল ধ্বংস হয়ে গেছে। সেসব দলের অস্তিত্ব এখন আর বাকি নেই।
তাছাড়া এ হাদিসটি প্রমাণ করে যে, এসব দলের সবই মুহাম্মদ সা:-এর উম্মতের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ যারা তার ডাকে সাড়া দিয়েছেন তাদের অন্তর্ভুক্ত। কারণ হাদিসের বক্তব্য হচ্ছে ‘আমার উম্মত’। এর মানে হচ্ছে এসব দল বিদাআতি হলেও মুসলিম মিল্লাত থেকে বের হয়ে যায়নি। তারা মুসলিম উম্মাহর অংশ থেকেও বহির্গত নয়। আর ‘তারা জাহান্নামি হবে’ মানে তারা কাফেরদের মতো জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে না। বরং তাওহিদপন্থী গুনাহগাররা যেমন জাহান্নামে যাবে এরাও তেমনি জাহান্নামে যাবে।
হয়তো এদের জন্য কোনো নবী বা ফেরেস্তা বা কোনো মুমিন সুপারিশ করবে। হয়তোবা তাদের এমন কোনো সৎকর্মও থাকতে পারে যা তাদের অপরাধ মুছে দেবে বা এমন আপদ বিপদ থাকবে যার জন্য অপরাধ মুছে যাবে, ফলে তারা আজাব থেকে মুক্তি পাবে।
হয়তো এমনও হতে পারে যে আল্লাহ তায়ালা নিজ করুণা ও দয়ায় তাদের ক্ষমা করে দেবেন। বিশেষত তারা যদি সত্য জানার জন্য চেষ্টা করা সত্ত্বেও তা না বুঝে বিপথগামী হয়ে থাকে। আল্লাহ এ উম্মাতের ভুলভ্রান্তি এবং যে কাজ তারা বাধ্য হয়ে করেছে তা ক্ষমা করে দিবেন।
অনুবাদক :ড. মাহফুজুর রহমান প্রফেসর, আরবি ভাষা ও সাহিত্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com