রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ০১:০৩ পূর্বাহ্ন

গার্মেন্টস শিল্পের টিকে থাকার লড়াই

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৯ মে, ২০২১

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন
২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে কমপক্ষে ১১০০ শ্রমিক নিহত হওয়ার পর গার্মেন্ট শ্রমিকদের বিপর্যয়ের এক বিশ্বব্যাপী পোস্টার হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। সেখান থেকে সংস্কারের এক সফলতার কাহিনী গড়ে ওঠে। ২০১৩ সালে ইউরোপিয়ান খুচরা ক্রেতা ইন্ডিটেক্স, এইচঅ্যান্ডএম, প্রাইমার্ক, বাংলাদেশের শ্রমিক ইউনিয়ন এবং কারখানা মালিকরা ঐতিহাসিক দ্য একর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি বৈশ্বিক তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য আইনগত বাধ্যতামূলক চুক্তি। এরপর প্রথমবারের মতো কমপক্ষে ২০০ আন্তর্জাতিক ব্রান্ডের জন্য যেসব কারখানায় তাদের পোশাক প্রস্তুত হয়, সেখানে নিরপেক্ষভাবে কারখানাগুলো পরিদর্শনে সম্মত হয় তারা। একই সঙ্গে নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ এবং কিছু কারখানার উন্নয়নে অর্থায়নে সহায়তা করে। কোনো কোম্পানি যদি কোনো শর্ত লঙ্ঘন করে তাদেরকে জরিমানা অথবা এই গ্রুপ থেকে বহিষ্কারের বিধান রাখা হয়। দ্বিতীয়ত, এর চেয়ে একটু শিথিল চুক্তি দ্য অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটিতে স্বাক্ষর করে ওয়ালমার্ট, গ্যাপ এবং টার্গেট-এর মতো মার্কিন কোম্পানিগুলো এবং এই চুক্তি একই বছর সচল হয়।
কিন্তু এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। এ অবস্থায় সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে কঠোরভাবে অর্জিত এই নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে। অনলাইন নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত দীর্ঘ এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়, ব্রান্ডগুলো, ইউনিয়ন এবং স্থানীয় প্রস্তুতকারকরা এর বিকল্প একটি চুক্তির জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। সবাই বলতে চান যে, বছরে বাংলাদেশ যে ৩৪০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে তা কিভাবে দেখভাল করা হবে। চুক্তি শেষের মূল তারিখের ১০ দিন আগে ২১ শে মে ইউনিয়নগুলো প্রকাশ্যে সরে পড়ে (ওয়াকড অ্যাওয়ে)। বর্তমান চুক্তির প্রতিশ্রুতিগুলোর পাশাপাশি শুক্রবার শেষ সময়ে ব্রান্ড এবং ইউনিয়নগুলো চুক্তি তিন মাস বর্ধিত করার চেষ্টা চালানো সত্ত্বেও, গার্মেন্ট কারখানার নিরাপত্তায় নজরদারি এক কঠিন অবস্থায় পড়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং বৈশ্বিক পোশাক শিল্পগুলো যখন এক জটিল সময়ের মুখোমুখি। যেসব কারখানা থেকে পোশাক সরবরাহ দেয়া হয়, তার খুব কম সংখ্যকেরই মালিক ফ্যাশন রেটেইলাররা। বেশির ভাগ গার্মেন্ট এবং জুতার যে অর্ডার আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নেয়া হয় তার মধ্যে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান কিছু মার্কেট আছে। এখানে খরচ কম এবং শ্রমিকের মজুরিও সস্তা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের মতে, বাংলাদেশের ৪৫০০টি গার্মেন্ট কারখানা থেকে পোশাক রপ্তানি হয়। এতে কাজ করেন কমপক্ষে ৪৫ লাখ শ্রমিক। চীনের পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তৈরি পোশাক রপ্তানির দেশ বাংলাদেশ। চুক্তির ফল অনুযায়ী, গত ৫ বছরে কমপক্ষে এক লাখ ২০ হাজার অগ্নিকা-, ভবন এবং বৈদ্যুতিক গোলযোগ ঠিক করা হয়েছে এদেশে। কমপক্ষে ৩৮ হাজার পরিদর্শন সম্পন্ন হয়েছে। এর ফলে নাজুক নিরাপত্তার মান থাকায় ২০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন এমন প্রায় ২০০ কারখানা তাদের চুক্তি বা কাজ হারিয়েছে। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্টার্ন স্কুল অব বিজনেসের প্রফেসর মাইকেল পোসনার বলেন, বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও অডিটের জন্য এই চুক্তি ছিল একটি স্ট্যাবিলাইজারের মতো, যা বাংলাদেশে মাঠপর্যায়ে প্রকৃত উন্নয়ন করেছে। জনক্ষোভের মুখে, তারা এবং এলায়েন্স একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যার ফলে প্রতিদ্বন্দ্বী পশ্চিমা কোম্পানিগুলোকে একত্রে কাজ করতে বাধ্য করেছে। সাপ্লাই চেইনের স্বচ্ছতার উন্নয়ন করেছে এবং যে খাত থেকে তারা দীর্ঘদিন শুধু লভ্যাংশ তুলেছে, সেখানে তাদেকে বৃহত্তর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
কিন্তু একর্ড এবং এলায়েন্স উভয়েই পরিচালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক গ্রুপ দ্বারা। এর মধ্যে এলায়েন্স নিষিদ্ধ হয়েছে ২০১৮ সালে। একর্ডকে যখন তিন বছরের বর্ধিত মেয়াদ দেয়া হয়েছে, তখনও দীর্ঘ মেয়াদি উদ্দেশ্য ছিল সব সময় প্রশিক্ষণ, পরিদর্শন এবং চুক্তি কার্যকারিতা বাংলাদেশভিত্তিক একটি পরিষদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। গত ১২টি মাস ছিল নবগঠিত রেডি মেড গার্মেন্টস সাসটেইন্যাবলিটি কাউন্সিল এবং মেয়াদ শেষ হওয়া একর্ডের মধ্যে একটি অন্তর্র্বতী সময়। এর মধ্যে রেডি মেড গার্মেন্টস সাসটেইন্যাবলিটি কাউন্সিলকে দেখভাল করে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন। নবগঠিত রেডি মেড গার্মেন্টস সাসটেইন্যাবলিটি কাউন্সিলের আছে ১৮টি আসন। তা শ্রম অধিকার, আন্তর্জাতিক ব্রান্ডের প্রতিনিধি এবং গার্মেন্ট মালিকদের মধ্যে সমভাবে বন্টন করা হয়েছে। গার্মেন্ট মালিকদের অনেকেরই দেশের রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক আছে। সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিরন আলী গত মাসে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, আমরা বিদেশিদের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে এসেছি এবং বাংলাদেশিদের কি কি করতে হবে সে বিষয়ে বলেছি, যা হবে অধিক সহযোগিতা ও জাতীয়তার ভিত্তিতে।
পূর্বের মতো নবগঠিত গার্মেন্ট কাউন্সিলের আইনগত কোনো কর্তৃত্ব নেই। করোনা মহামারির ফলে সমঝোতা প্রক্রিয়ায় বিলম্বের ফলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে ইউনিয়ন নেতা এবং ক্লিন ক্লোথস ক্যাম্পেইনের মতো অলাভজনক সংগঠনগুলোর মধ্যে। তাদের উদ্বেগ কর্মচারীদের সুরক্ষার জন্য যে ব্যয়বহুল পরিবর্তন আসবে তা মানতে এই পরিষদের শর্তগুলো ব্রান্ড এবং কারখানা মালিকদের মানতে বাধ্য করাতে যথেষ্ট কিনা তা নিয়ে।
ইউএনআই গ্লোবাল ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি বলেছেন, ব্রান্ডগুলো গত সপ্তাহে ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন ফ্রেমওয়ার্ক দিয়েছে। এতে একর্ডের মূল উপাদানগুলো নেই। যেমন কোনো একটি ব্রান্ডের জবাবদিহিতা এবং তৃতীয় পক্ষের অডিটর দিয়ে নজরদারি করা। তিনি বলেছেন, রানা প্লাজা বিপর্যয় দেখিয়ে দিয়েছে ব্রান্ডগুলোর নিজস্ব মনিটরিং কাজ করে না। ব্রান্ডগুলো করোনা মহামারিকে এই সময়ে ব্যবহার করছে এবং নতুন একটি চুক্তি করছে। এতে ইউনিয়নগুলোকে খুব কমই ক্ষমতা দেয়া হবে। আমাদেরকে বাদ দিয়ে এটা একটা উপুুক্ত মডেল হতে পারে না।
বৈশ্বিক শ্রম ইউনিয়ন ইন্ডাস্ট্রিঅল-এর টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট শিল্প বিষয়ক পরিচালক ক্রিস্টিনা হাজাগোস-ক্লাউসেনের মতে, কিছু ইউরোপিয়ান ব্রান্ডের নেতাদের সুনির্দিষ্ট কিছু এজেন্ডা আছে নতুন চুক্তিতে। এতে ওয়ালমার্টের মতো মার্কিন ব্রান্ডগুলোকে অঙ্গীভূত করার খায়েশ আছে, যারা আইনগত বাধ্যবাধকতার বিষয়ে উদ্বিগ্ন এবং তারা বর্তমান সমঝোতা প্রক্রিয়ার অংশ নয়। বর্তমানে টমি হিলফিজারের মার্কিন মালিকানাধীন পিভিএইচ এবং কেলভিন ক্লেইন সংগঠন এতে জড়িত। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে যে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় তার প্রায় এক তৃতীয়াংশ যায় মার্কিন ব্রান্ড এবং খুচরা ক্রেতাদের কাছে। মিস হাজাগোস-ক্লাউসেন বলেন, ইউরোপিয়ানরা চেষ্টা করছে উত্তর আমেরিকার খুচরা ক্রেতাদেরকে সমন্বিত নিরাপত্তা মনিটরিং প্রক্রিয়ায় অধিকভাবে অবদান রাখতে উদ্বুদ্ধ করতে। এক্ষেত্রে জবাবদিহিতার বিষয়টি কম করে দেখানো হচ্ছে। তবে অবশ্যই আমরা চাই অধিক পরিমাণ ব্রান্ড এতে যুক্ত হোক। সর্বোপরি কিছু কারখানা আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ক্রেতা উভয়ের জন্যই পোশাক প্রস্তুত করে। একই সঙ্গে তারা আন্তর্জাতিক অন্যান্য ব্রান্ডের জন্যও পোশাক প্রস্তুত করে। এসব বিষয়ে গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ফারুক হোসেন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। অন্যদিকে আসোস-এর মতো পশ্চিমা কিছু ব্রান্ড প্রকাশ্যে বলেছে, তারা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক এমন চুক্তি সমর্থন করবে। যখন এ নিয়ে সমঝোতা চলছে তখন অনেকেই স্বেচ্ছায় এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। মূল চুক্তি সৃষ্টির মূলে ছিল সুইডিশ খুচরা ক্রেতা এইচঅ্যান্ডএম। তারাও বর্তমান আলোচনার অংশ। এইচঅ্যান্ডএমের বৈশ্বিক উৎপাদন বিষয়ক প্রধান পায়েল জৈনের মতে, তারা এখনও এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি বলেন, এখনও ট্রেড ইউনিয়ন, নিয়োগদাতাদের সংগঠন এবং সরকারের অংশগ্রহণের একটি কাঠামোতে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। একই সঙ্গে ব্রান্ডগুলোর পরিষ্কার জবাবদিহিতা থাকতে হবে। অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তা বিষয়ক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, আমরা যে একটি চমৎকার সমাধানে যেতে পারি এ বিষয়ে আমি আস্থাশীল।
বাংলাদেশে গার্মেন্ট শ্রমিকদের এরই মধ্যে বেতন কর্তন করা হয়েছে। বিলম্বিত করা হয়েছে মজুরি। তাদেরকেও এতে জড়িত করতে হবে। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির শতকরা ৮০ ভাগ আসে গার্মেন্ট খাত থেকে। ২০২০ সালে এই আয় কমে গেছে শতকরা ১৭ ভাগ। করোনা মহামারির কারণে বিভিন্ন ব্রান্ড তাদের দোকানপাঠ বন্ধ করায় এবং ৩৫০ কোটি ডলারের অর্ডার বাতিল করায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকখাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেক কারখানা মালিক একেবারে বসে পড়েছেন। তারপরও এই শিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ভবিষ্যত অনিশ্চিত। বিশেষ করে এ অবস্থা লকডাউন এবং ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের জন্য।
ক্ষুদ্র এবং মাঝারি আকৃতির কারখানা মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে বলেছেন, তারা নিরাপত্তার মানদণ্ড মেটাতে যে অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে তা তারা কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে অনেক বৈশ্বিক ব্রান্ড কঠিন বাণিজ্যিক পরিস্থিতিতে অর্ডারের মূল্য কমিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে আরো আর্থিক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের। এরই মধ্যে কারখানাগুলোকে নতুন কোভিড-১৯ সংক্রমণ বিষয়ক ব্যয়বহুল নিরাপত্তা পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছে ব্রান্ডগুলো। মিস্টার পোসনারের মতে, বাংলাদেশে যখন সর্বসম্মত শ্রমিকদের নিরাপত্তা উন্নত হয়েছে, কিন্তু কাজ শেষ হয়ে যায়নি। এখনও বাংলাদেশে অনেক কারখানা আছে, যা নিরাপদ নয়। যেহেতু বিশ্ব এখন নতুন করে সব কিছু শুরু করতে যাচ্ছে, আবারও চাহিদা বাড়ছে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com