নরসিংদীতে মাইক্রোবাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৫
নরসিংদী মাধবদীর পাঁচদোনাতে ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে মাইক্রোবাসের নারী ও শিশুসহ পাঁচ যাত্রী নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন মাইক্রোবাসটির আরো সাত যাত্রী। গত রোববার দিবাগত রাত ১২টার দিকে নরসিংদীর পাঁচদোনার ঘোড়াশাল-টঙ্গীর আঞ্চলিক সড়কের পাঁচদোনার ভাটপাড়া মোড়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে। মাইক্রোবাসটিতে করে ১২ সদস্যের একটি দল সিলেটে গিয়েছিল মাজার জিয়ারত করতে। সেখান থেকে রাজধানীর আশুলিয়ায় বাড়িতে ফেরার পথে পাঁচদোনার ভাটপাড়া মোড়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে। তাদের সবার বাড়ি ঢাকার সাভার উপজেলার আশুলিয়ার জিরাব এলাকায়। নিহতরা হলেন মাইক্রোবাস যাত্রী রোকেয়া বেগম (৫২), মুক্তি আক্তার (৩০) ও তার ছেলে সাদিকুল (৮) এবং রুবি আক্তার (৪০) ও তার মেয়ে রাহিমা (৩)। মুক্তি আক্তার ও রাহিমার মৃত্যু হয়েছে ঘটনাস্থলে এবং রুবি আক্তার, সাদিকুল ও রোকেয়া বেগমের মৃত্যু হয়েছে ঢাকায় হাসপাতালে নেওয়ার পথে। এই ঘটনায় আহত সাতজনকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে চিকিৎসা জন্য নিয়ে আসা হলে চারজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে প্রেরণ করেন। ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯-এ সড়ক দুর্ঘটনা প্রায় ৪ শতাংশ কমে যায়। এর পরের বছর করোনা মহামারীর কারণে দেশটিতে দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা কমে প্রায় ২০ শতাংশ। ভারতের ঠিক কাছাকাছি সময়ে নতুন সড়ক আইন কার্যকর করে বাংলাদেশও। পাশাপাশি মহামারীর কারণে গত বছর দীর্ঘ সময় সীমিত ছিল যান চলাচল। তবে এসবের খুব একটা প্রভাব পড়েনি দুর্ঘটনার চিত্রে। কমে যাওয়ার বদলে উল্টো বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা।
নরসিংদী মাধবদীর পাঁচদোনার দুর্ঘটনা সম্পর্কে পুলিশ ও স্বজনরা জানায়, শনিবার সকালে এই মাইক্রোবাসের যাত্রীরা আশুলিয়া থেকে সিলেটে মাজার জিয়ারত করতে গিয়েছিলেন। তারা সেখানে গিয়ে হযরত শাহজালাল ও হযরত শাহপরানের মাজার জিয়ারত করেন। মাজার জিয়ারত শেষে তারা বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে নরসিংদীর পাঁচদোনার ভাটপাড়ায় পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের সাথে মাইক্রোবাসটির মুখোমুখি সংর্ঘষ হয়। এতে মাইক্রোবাসটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই দুজন নারী নিহত হন। পরে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরও এক শিশুর মৃত্যু হয়। এই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত সাতজনকে নরসিংদী সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনা হয়।
নরসিংদী সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক মো. আসাদুজ্জামান জানান, এই ঘটনায় ঘটনাস্থলেই দুজন নিহত হন। এছাড়া নিহত এক শিশুকে মৃত অবস্থায় আমাদের হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। আরও ৭ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানী ঢাকায় পাঠানো হয়। নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) ইনামুল হক জানান, এই দুর্ঘটনায় নারী ও শিশুসহ পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে তিনজনের লাশ নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। এই ঘটনায় ঘাতক ট্রাকটি আটক করা হয়েছে তবে এর চালক পলাতক। হতাহতদের সবার বাড়ি ঢাকার সাভার উপজেলার আশুলিয়ার জিরাব এলাকায়।
প্রতিবেশী দেশগুলোতে কমলেও বাড়ছে বাংলাদেশে: প্রতিবেশী দেশ ভারত ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নতুন মোটরযান আইন কার্যকর করে। আইনে বাড়ানো হয় জরিমানা ও শাস্তির পরিমাণ। শুধু তা-ই নয়, আধুনিকায়ন করা হয় যানবাহন নজরদারি পদ্ধতিরও। এর সুফল হাতেনাতেই পেয়েছে দেশটি। ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯-এ সড়ক দুর্ঘটনা প্রায় ৪ শতাংশ কমে যায়। এর পরের বছর করোনা মহামারীর কারণে দেশটিতে দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা কমে প্রায় ২০ শতাংশ। ভারতের ঠিক কাছাকাছি সময়ে নতুন সড়ক আইন কার্যকর করে বাংলাদেশও। পাশাপাশি মহামারীর কারণে গত বছর দীর্ঘ সময় সীমিত ছিল যান চলাচল। তবে এসবের খুব একটা প্রভাব পড়েনি দুর্ঘটনার চিত্রে। কমে যাওয়ার বদলে উল্টো বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা।
বাংলাদেশের নতুন সড়ক পরিবহন আইনে বিভিন্ন অপরাধের জরিমানা ও শাস্তির পরিমাণ বাড়ানো হয়। দুর্ঘটনার সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ- নির্ধারণ করা হয়। তবে আইনটি কার্যকর হওয়ার আগেই এর বিরোধিতা শুরু করেছেন দেশের পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক আইন হলেও সেটির যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় দুর্ঘটনাসহ সড়কে বিশৃঙ্খলা কমছে না। আইনটি সংশোধন করে দুর্বল করা হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক ড. মিজানুর রহমান বলেন, আইনটি সংশোধন করা হলে তা পরিবহন চালক-শ্রমিকদের একটা ভুল বার্তা দেবে। বেপরোয়া চালকদের আরো বেপরোয়া করে তুলবে। বিশৃঙ্খলা-দুর্ঘটনার মতো বিষয়গুলোয় কঠোর থাকার কারণে তারা যতটা সচেতনভাবে গাড়ি চালাতেন, আইন শিথিল হলে তাদের মধ্যে আর সে সচেতনতা দেখা যাবে না। বাংলাদেশের মানুষ যে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের হাতে জিম্মি, সড়ক আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়ে সরকার আরেকবার তা প্রমাণ করল।
কেবল ভারত নয়, সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে কমছে পাকিস্তানেও। দেশটির পরিসংখ্যান ব্যুরোর (পিবিএস) তথ্যমতে, ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। প্রাণহানি কমেছে ৮ শতাংশের বেশি। মিয়ানমারেও সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা নি¤œমুখী। দেশটির পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ ২০১৯ সালের চেয়ে কমেছে ১৯ শতাংশের বেশি। আগের বছরের চেয়ে ২০২০ সালের প্রথম ১১ মাসে ৭৭৫ জনের কম মৃত্যু হয়েছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোয় সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহত কমলেও বাংলাদেশের চিত্রটি উল্টো। ২০১৪ সালের পর থেকে দেশে দুর্ঘটনার সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ পুলিশের হিসাবে, ২০১৪ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২৭। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ১৯৮ জনে। সাত বছরে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির হার ১০৭ শতাংশ। একই সময়ে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। যেখানে গত ১০ বছরে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ছিল সরকারের, সেখানে হতাহতের পরিমাণ উল্টো বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
নভেল করোনাভাইরাসের কারণে একটা দীর্ঘ সময় গণপরিবহন বন্ধ ছিল। অন্য যানবাহনও চলেছে সীমিত পরিসরে। তবে এসবের কোনো প্রভাব পড়েনি দুর্ঘটনার সংখ্যায়। বাংলাদেশ পুলিশের হিসাব বলছে, ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে অর্ধশত দুর্ঘটনা বেশি হয়েছে। দুর্ঘটনা বৃদ্ধির হার ১ শতাংশের বেশি। এক্ষেত্রে একমাত্র ইতিবাচক তথ্য হলোÍআগের বছরের চেয়ে প্রাণহানি সামান্য কমেছে।
লকডাউনে গাড়ি কম চললেও দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে এআরআইয়ের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, লকডাউনে বাস বন্ধ ছিল। এ কারণে ছোট ছোট গাড়িতে করে দূরের পথ পাড়ি দিতে দেখা গেছে মানুষকে। এমনকি মোটরসাইকেলে চেপেও অনেকে ২০০-৩০০ কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশি পথ পাড়ি দিয়েছে। মোটরসাইকেলের অদক্ষ চালক আর ঝুঁকিপূর্ণ হালকা যানবাহনগুলোর কারণে এ সময়ে দুর্ঘটনা বেশি ঘটেছে। একইভাবে ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে চলাচলের কারণেও বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। এসবের পাশাপাশি ‘সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্টর’-এর কথাও বলছেন ড. হাদিউজ্জামান। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, লকডাউনে কিন্তু সব ধরনের গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যখন কেউ রাস্তায় গাড়ি চালায়, তখন তার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করে। আতঙ্কটি মূলত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়ে। এ আতঙ্কের কারণে চালকদের অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া ও তা থেকে দুর্ঘটনা ঘটাও অস্বাভাবিক নয়।
অবশ্য সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক ও মুখপাত্র শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া দুর্ঘটনা রোধে বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডাররাও কাজ করছে। শিগগিরই এসবের সুফল পাওয়া যাবে বলেও আশাবাদ প্রকাশ করলেন তিনি।