শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ১০:৫৭ অপরাহ্ন

ফাইল ছাড়ের সম্মানী মূল বেতনের সমান 

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বুধবার, ৩০ জুন, ২০২১

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় অনুবিভাগ 

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিধিবিধান প্রণয়নের পর তাতে চ্যান্সেলরের অনুমোদন নেয়ার নিয়ম রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত এসব বিধিবিধান অনুমোদন করিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় অনুবিভাগ। চ্যান্সেলরের সাচিবিক দায়িত্ব পালনসহ অনুমোদন প্রক্রিয়ার গোটা বিষয়টি অনুবিভাগের দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই পড়ে। যদিও অভিযোগ উঠেছে, এজন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সম্মানী ও ভাতা দাবি করেন অনুবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্মানী ভাতা হিসেবে নিজেদের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থও চেয়ে বসছেন তারা।
২০১৯ সালের মাঝামাঝি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গোপালগঞ্জের শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) প্রস্তাবিত একটি সংবিধি জমা পড়ে। কয়েক মাস পর তা অনুমোদনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির কাছ থেকে নিজেদের এক মাসের মূল বেতনের সমান সম্মানী দাবি করেন অনুবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সংবিধি দ্রুত অনুমোদনের তাগিদে দাবিটি মেনে নেয় বশেমুরবিপ্রবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ড ও অর্থ কমিটির অনুমোদন ছাড়াই সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূতভাবে মন্ত্রণালয়ের আটজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য এ অর্থ ছাড় করা হয়। যদিও সংবিধি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ ধরনের সম্মানী নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বশেমুরবিপ্রবির ক্ষেত্রে এ ধরনের অনুমোদন প্রক্রিয়ার বিষয়টি দেখভাল করে বিশ্ববিদ্যালয় অনুবিভাগের অধীন বৃত্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। অনুসন্ধান বলছে, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে অবসর ভাতা ও আনুতোষিক সংবিধি প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছিল বশেমুরবিপ্রবি। সংবিধির খসড়া প্রণয়ন করে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে (ইউজিসি) পাঠায় কমিটি। ইউজিসি থেকে বশেমুরবিপ্রবির সংবিধিটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই বছরের ডিসেম্বরে বশেমুরবিপ্রবির সংবিধি কমিটির কাছে এ কাজের জন্য নিজেদের এক মাসের মূল বেতনের সমান সম্মানী দাবি করে অনুবিভাগের অধীন বৃত্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
বশেমুরবিপ্রবির সংবিধি প্রণয়ন কমিটির একটি সভার কার্যবিবরণীতেও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মানী দাবির বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। কমিটির ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে অনুষ্ঠিত একটি সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, সংবিধি প্রণয়ন ও অনুমোদনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এক মাসের মূল বেতনের সমান অর্থ সম্মানী হিসেবে দাবি করেছেন। অন্য যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সংবিধি প্রণীত হয়েছে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তারা এমন সম্মানী পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। সংবিধি কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এসএম গোলাম হায়দার। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছিলেন, এ ধরনের কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যেকের জন্য বেসিকের সমান সম্মানীর ব্যবস্থা করতে হবে। এ সময় বুটেক্স এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের জন্য এ ধরনের সম্মানীর ব্যবস্থা করেছে বলে আমাকে রেফারেন্স দেয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সংবিধি কমিটির একটি সভা ডাকা হয়। সে সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোর কমিটির তহবিল থেকে এ অর্থ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে আমি তালিকা চাইলে শাখার একজন কর্মকর্তা আমাকে কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম ও মূল বেতনের তথ্য পাঠান। এর ভিত্তিতে অর্থ ছাড় করা হয়।
অর্থ ছাড়ের সময় সংযুক্তি হিসেবে দেয়া মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওই তালিকার একটি কপি এসেছে বণিক বার্তার হাতে। ওই তালিকায় অফিস সহায়ক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় অনুবিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত বিভিন্ন পদমর্যাদার আটজনের নাম রয়েছে।
দেশে উচ্চশিক্ষার তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছ থেকে এ ধরনের অর্থ গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও এ বাবদ ব্যয়ের কোনো বিধান নেই। ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. আবু তাহের বণিক বার্তাকে বলেন, বিধি, সংবিধি বা জনবলকাঠামো প্রণয়নে গঠিত কমিটির সভায় সিটিং অ্যালাউন্সের ব্যবস্থা রয়েছে। এর বাইরে মূল বেতনের সমপরিমাণ সম্মানী তো নয়ই; কোনো সম্মানী গ্রহণের সুযোগ নেই। এটি সম্পূর্ণ অবৈধ, অস্বাভাবিক ও অদ্ভুত। তবে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা মূল বেতনের সমান সম্মানী গ্রহণের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অনুবিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) বণিক বার্তাকে বলেন, যতদূর মনে পড়ে আমরা সিটিং অ্যালাউন্স নিয়েছিলাম, যা ছিল সম্পূর্ণ বৈধ। মূল বেতনের সমপরিমাণ কোনো সম্মানীর অর্থ আমরা গ্রহণ করিনি। বৃত্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, আমি ও আমার তৎকালীন ঊর্ধ্বতন স্যার এ ধরনের কোনো সম্মানী গ্রহণ করিনি। স্টাফরা নিয়েছেন কিনা, সেটি বলতে পারছি না। তাদের এ কথার ভিত্তিতে যোগাযোগ করা হয় বশেমুরবিপ্রবির সংবিধি প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ও বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. শাহজাহানের সঙ্গে। অর্থ ছাড় ও সংবিধি অনুমোদনের সময় তিনি উপাচার্যের রুটিন দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বলেন, অর্থ ছাড়ের পর কমিটির একজন সদস্যের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে টাকাগুলো পাঠানো হয়। ওই সময় দুই-একজন স্বাক্ষর দিয়ে সম্মানী গ্রহণের অসম্মত হলে সে অর্থ ফেরত আনা হয়। তবে বেশির ভাগই স্বাক্ষর দিয়ে টাকা গ্রহণ করেন। সে তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। তবে যারা টাকা নেননি, তাদের সম্মানীর অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সম্মানী বাবদ মোট কত টাকা ব্যয় হয়েছে জানতে চাইলে এ অধ্যাপক বলেন, আসলে মন্ত্রণালয় থেকে সম্মানীর প্রস্তাব আসার পর আমাদের নিজস্ব কমিটির সদস্যরাও একই ধরনের দাবি তোলে। পরে মন্ত্রণালয়ের তালিকা ও আমাদের কমিটির সবার জন্য এক মাসের মূল বেতনের সমান সম্মানী বাবদ সর্বমোট সাড়ে ৭ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। তবে এ সময় শর্ত দেয়া হয়, যদি কখনো নিরীক্ষায় এ বিষয়ে আপত্তি আসে, তাহলে সবাই টাকা ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে। এখন যেহেতু এ বিষয়ে আপত্তি আসছে, তাহলে আমরা এ অর্থ ফেরতের ব্যবস্থা করব। এদিকে ঘটনার তদন্তে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করতে যাচ্ছে বশেমুরবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. একিউএম মাহবুব বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর আগের ব্যয়গুলোর খোঁজখবর নেয়ার জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছিলাম। সেখানে দেখা যায় অগ্রিম বাবদ নেয়া এ অর্থ সমন্বয় করা হয়নি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ বাবদ অর্থ উত্তোলনের সুযোগই নেই। বিষয়টিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। শিগগিরই এ বিষয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।
আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়েও এমন কাজের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়মবহির্ভূতভাবে ভাতা ও সম্মানী গ্রহণের তথ্য পাওয়া যায়। অন্তত পাঁচজন উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও হিসাব পরিচালক নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে জানিয়েছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন নথিপত্রের অনুমোদন করিয়ে নিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন ভাতা ও সম্মানী দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। এমনকি কিছু কিছু ভাতা রেওয়াজেও পরিণত হয়েছে বলে এ সময় অভিযোগ করেন তারা। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) একেএম আফতাব হোসেন প্রামানিক বণিক বার্তাকে বলেন, এটি একটি গুরুতর অভিযোগ। এ ধরনের নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যদি বিশেষ কোনো সভায় অংশ নিতে হয়, সেক্ষেত্রে সিটিং অ্যালাউন্স হিসেবে নির্ধারিত পরিমাণে অর্থ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে এ ধরনের কোনো সম্মানী নেয়ার সুযোগ নেই। বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। -উৎস: দৈনিক বণিকবার্তা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com