দেশের অন্যতম দুধ উৎপাদনকারী এলাকা সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর। সেখানকার দেড়শ খামারি রেশমবাড়ি প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সদস্য। যারা প্রতিদিন চার হাজার লিটার দুধ উৎপাদন করেন। কিন্তু চলমান লকডাউনে এখন তারা দুধ বিক্রি করতে পারছে না। তাদের প্রতিদিন আড়াই থেকে সর্বোচ্চ তিন হাজার লিটার দুধ মিল্কভিটার কাছে বিক্রি হচ্ছে। বাকি দুধ অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। আগে তাদের সব দুধ বিক্রি হয়ে যেত। কোম্পানিগুলো আগের মতো দুধ নেয় না। যে দুধ অবিক্রীত থেকে যায়, সেটা নিয়ে খুব বিপদ হয়। বাজারে দুধ বিক্রি হচ্ছে না। মিষ্টির দোকান থেকে শুরু করে সব বন্ধ। বাইরের ক্রেতা নেই। রেশমবাড়ি এলাকায় এমন আরও দুটি সমিতি রয়েছে। এছাড়া ওই এলাকায় রয়েছে সমিতির বাইরে প্রচুর খামারি। সব মিলিয়ে সেখানে দুধ উৎপাদন হয় প্রায় ১০ হাজার লিটার। যারা মিল্কভিটার বাইরে অন্যান্য কোম্পানি ও নিজেদের ব্যবস্থাপনায় বাজারে দুধ বিক্রি করতেন, সমিতির খামারিদের থেকে তাদের অবস্থা আরও করুণ।
রেশমবাড়ি প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুস সামাদ ফকির বলেন, কোম্পানি আগের মতো দুধ নেয় না। যে দুধ অবিক্রীত থেকে যায়, সেটা নিয়ে খুব বিপদ হয়। বাজারে দুধ বিক্রি হচ্ছে না। মিষ্টির দোকান থেকে শুরু করে সব বন্ধ। বাইরের ক্রেতা নেই। তিনি বলেন, সমিতির সদস্যরা তবুও কিছুটা দুধ বিক্রি করছেন। কিন্তু যারা সমিতির মাধ্যমে দুধ বিক্রি করেননি, তারা অর্ধেক দুধও বিক্রি করতে পারছেন না। এখন বাজারে ২০-২৫ টাকায়ও এক লিটার দুধ কেনার ক্রেতা নেই। শাহজাদপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান বলেন, এ উপজেলায় চার লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক দুধ কেনে দেশীয় প্রতিষ্ঠান তরল দুধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানিগুলো। এখন লকডাউন পরিস্থিতির কারণে কোম্পানিগুলো দুধ কেনা কমিয়ে দিয়েছে। বিক্রি না করা গেলে তো দুধ উৎপাদন বন্ধ থাকছে না। খামারির খরচ কমছে না। এখন এই দুধ খামারিরা কী করবে? গরুর খাবারের দাম আসবে কোথা থেকে? সরকার এখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। এভাবে চলতে থাকলে পথে নামবে খামারিরা।
তিনি বলেন, বাকি যে অর্ধেক দুধ সেটা নিয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে। স্থানীয় ঘি, ছানা ও মিষ্টিজাত কারখানায়ও প্রচুর দুধ প্রয়োজন হতো। সেগুলোও বন্ধ। সেগুলো খুলে না দেয়া গেলে অর্ধেক দুধ নষ্ট হবে। এজন্য আমরা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলছি। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া উপজেলা এবং পাবনার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর দেশের প্রধান গরুর দুধ উৎপাদনকারী এলাকা। শাহজাদপুরের মতো একই অবস্থা অন্যান্য উপজেলার। পাবনা-সিরাজগঞ্জ জেলার প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এ এলাকায় ছোট-বড় প্রায় ২৫ হাজার দুগ্ধ খামার রয়েছে। সব মিলিয়ে এ এলাকায় ১০-১২ লাখ লিটার গরুর দুধ উৎপাদন করা হয়। সরকারি মিল্কভিটা এবং বেসরকারি প্রাণ ডেইরি, আড়ং দুধ, ফার্ম ফ্রেশ, অ্যামোমিল্ক, পিউরামিল্ক, আফতাব ডেইরি, রংপুর ডেইরিসহ বেশকিছু দুগ্ধ সংগ্রহকারী ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান এসব দুধের অর্ধেক কিনে নেয়। এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে। এ বিষয়ে মিল্কভিটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (যুগ্মসচিব) অমর চান বণিক বলেন, কোভিড পরিস্থিতির কারণে আমরা আমাদের অপারেশনাল কার্যক্রম সীমিত করেছি। যেহেতু সংগ্রহ কমেছে সেই কারণে আমরা আমাদের ভালো খামারিদের প্রাধান্য দিচ্ছি, যারা রেগুলার মিল্কভিটাকে দুধ সরবরাহ করে। এজন্য যারা বাইরে দুধ বিক্রি করত তারা সমস্যায় পড়েছে। কোম্পানিগুলো যে দুধ সংগ্রহ করে, তার মূল কেন্দ্র পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চল। প্রতি লিটার দুধের দাম হিসাবে তারা চাষিদের দেয় ৩৭ থেকে ৪৫ টাকা। এ দাম এখন কিছুটা কমেছে। বর্তমানে দুধ বিক্রি হচ্ছে ৩৭ থেকে ৪০ টাকা লিটার। দুধে ননির মাত্রার ওপর এ দাম নির্ভর করে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন বলেন, বিক্রি না করা গেলে তো দুধ উৎপাদন বন্ধ থাকছে না। খামারির খরচ কমছে না। এখন এই দুধ খামারিরা কি করবেন? গরুর খাবারের দাম আসবে কোথা থেকে? সরকার এখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। এভাবে চলতে থাকলে পথে নামবে খামারিরা। এদিকে দেশের বিভিন্ন এলাকার অনেক খামারিই এখন উৎপাদিত দুধ ভ্যানে তুলে ২৫ থেকে ৩০ টাকা লিটার দরে ফেরি করে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এ দামে দুধ বিক্রি করে তাদের লিটারে ২০ থেকে ৩০ টাকা লোকসান হচ্ছে। তারপরও খামারিরা চেষ্টা করছেন খামারের দৈনন্দিন খরচ জোগাতে। কিন্তু লকডাউনে গোখাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় খামারিদের লোকসান আরও বেড়ে গেছে। এছাড়া কোরবানির হাট না হওয়ায় এসব গরু বিক্রি নিয়েও পড়েছেন দুশ্চিন্তায়।
খামারিরা জানান, বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) কঠোর লকডাউন শুরু হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে থেকেই দুধের দাম পড়তে শুরু করে। ওই সময় থেকে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহ কমানো শুরু করে। কঠোর লকডাউন শুরু হতেই প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারেই দুধ কেনা কমিয়ে দেয়। মিল্কভিটা, প্রাণ, আকিজের মতো বড় কোম্পানি বাদে অনেক প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে। একই সঙ্গে ছানার কারখানা ও মিষ্টির দোকানগুলোও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খামারিদের দুধ বিক্রির আর কোনো জায়গা নেই বললেই চলে। বাধ্য হয়ে খামারিরা দুদিন ধরে উৎপাদিত দুধ খোলাবাজারে নিয়ে আসছেন। কিন্তু খোলাবাজারে এত দুধ চলে আসায় তার বেশিরভাগই অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে।-জাগোনিউজ২৪.কম