।। ড. মুহাম্মদ আবদুল বারী ।।
অনাকাঙ্ক্ষিত করোনাভাইরাসের লকডাউন আমাদের জীবনকে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে । এই কঠিন চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো,বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখা। পৃথিবী জুড়ে মা-বাবারা তাদের ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে ছেলে সহজলভ্য বিনোদন যেমন টিভি বা আইফোন থেকে দূরে রাখার উপায় খুঁজছেন। তারা চাচ্ছেন কোন প্রোডাক্টটিভ বা আত্মউন্নয়নমূলক উপায়ে সন্তানদের ব্যস্ত রাখতে। যেসব সুভাগ্যবান অভিভাবক ঘরে থেকে অফিসের কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন,তাদের কাজের চাপের পাশাপাশি সন্তানদের দিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে। যেসব পরিবার ছোট বাসায় স্বল্প সুযোগ-সুবিধায় নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যে বসবাস করেন তাদের জন্য বিষয়টি খুব সহজ নয়।
এই নিবন্ধটি সেই সব পিতা-মাতার জন্য, যারা এই পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে খুবই কষ্ট করছেন। কারণ লকডাউন সম্পর্কে কোন প্রস্তুতি ছিল না। এই মহামারি পৃথিবীতে এত বড় বিপর্যয় এনে দেবে, সেটা খুব কম মানুষই আগে থেকে বুঝতে পেরেছিল। অনেক মানুষই তার প্রিয়জনকে হারিয়েছে , অনেকেরই আবার আছে চাকরি হারানোর কিংবা আয় কমে যাওয়ার ভয়। এটা সত্যি সবার জন্য খুবই দুর্যোগপূর্ণ সময় , আর এমন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়াটা সত্যিই বেদনাদায়ক।
একজন নানা ও দাদা হিসেবে এখন আমাকে কোন বাচ্চা লালন-পালন করতে হয় না। আর সেই দুই দশক আগে বাবা হিসেবে বাচ্চা লালন-পালন করার বিষয়টির সাথে বর্তমান সময়ের তুলনা চলে না। কিন্তু আমি সমবেদনার সাথেই দেখছি, আমার মেয়ে ও বড় ছেলে এই সময় তাদের ২ থেকে ৬ বছরের সন্তানদের নিয়ে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে।বাচ্চাদের সার্বিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সহজ নয়।বিশেষ করে যাদেরকে ঠাসাঠাসি সীমিত পরিসরের বাসায় বসবাস করতে হয়,বাইরে কোন জায়গা নেই। আমি এখন কিছু আইডিয়া দিব, সেগুলা অভিভাবকদের জন্য উপকারী হতে পারে। যদিও বলা সহজ , কিন্তু করা কঠিন। তারপরও আমি অবগত যে, বেশিরভাগ অভিভাবকই এই টেকনিকগুলো তাদের নিজের অবস্থার সাথে মিলিয়ে কাজে লাগাতে পারবেন।
প্রত্যেকটি পরিবারই আলাদা। আর এজন্য এ আইডিয়াগুলো সাধারণ গাইডলাইনের মতো নিজেদের ভালোর জন্য কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু সবার প্রথমে আমাদের ধৈর্যধারণ, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা এবং তাকওয়া রাখতে হবে এই দুর্যোগে হাল ধরার জন্য।
১. পিতা-মাতা উভয়কে প্রত্যেক সপ্তাহের জন্য একটি বাস্তবসম্পন্ন পরিকল্পনা করতে হবে, প্রাত্যহিক জীবনের সব মা-বাবাকে ভাগ করে করতে হবে। আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে সব কাজ করতে হবে। “ আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ ঠিকই, কিন্তু আগে উটটাকে বাঁধো।‘(তিরমিজি)। পূর্ণবয়স্ক বাচ্চাদের সাথে নিয়ে পরিকল্পনাটি করতে হবে।
২. স্কুলে যাওয়া বাচ্চাদের জন্য কর্মদিবসে অভিভাবকদের একটা স্কুলের মতো করে রুটিন করতে হবে- যাতে থাকবে ক্লাস অথবা কার্পেট টাইম , ব্রেক , গেমস অনলাইন এক্টিভিটিস ইত্যাদি। ধৈর্য ধরে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে কাজটি করতে হবে। ছুটির দিনগুলোয় ছাড় দেওয়া যাবে, তবে সাধারণ নিয়মশৃঙ্খলার বাইরে যাওয়া যাবে না।
৩. পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে নিজের শরীর ও মনের সুস্থতার দিকেও নজর রাখতে হবে। প্রত্যেক দিনই শরীরচর্চা করতে হবে, হতে পারে সেটা ৫ মিনিট বাসায় কিংবা ৩০ মিনিট জগিং। আমাদের সবাইকেই রিলাক্স করার জন্য পড়ার সময় রাখতে হবে।
৪. পারিবারিক বন্ধনকে মজবুত করার জন্য একটি পারিবারিক অধিবেশন করতে হবে, হতে পারে সেটা বাসায় কিংবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে। অবশ্যই সে সময় উৎফুল্ল থাকতে হবে। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে প্রতিদিনই এমন আয়োজন করা যেতে পারে।
৫. বাচ্চাদের নিরাপত্তা ও সুস্থতাই প্রধান লক্ষ্য, তবে পিতা-মাতার নিজেদের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। দুঃখজনক যে, মানসিক স্বাস্থ্য এবং ঘরোয়া নির্যাতন এমন সময় আরো বেশি কষ্টদায়ক। পরিবারের সবাইকে শান্তভাবে সব কিছুর মুখোমুখি হতে হবে এবং যথাসম্ভব দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে হবে।
৬.দুনিয়া আমাদের জন্য আদর্শ জায়গা নয়, তাই বিপর্যয় আসতেই পারে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে,পৃথিবী এখানেই শেষ হয়ে যাবে না । প্রত্যেক রাতেই মা-বাবাকে এই অবস্থা পর্যালোচনা করতে হবে এবং একটি সৃজনশীল ও উন্নয়নমূলক উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ
এটাই বাস্তব যে, আমরা সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন অফিসের কাজ, শিক্ষাগত কাজ এবং বিনোদনের জন্য ব্যবহার করে থাকি। এসব টেকনোলজি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের একটি সুশৃঙ্খল নিয়ম তৈরি করতে হবে।
১. অভিভাবক এবং পূর্ণবয়স্ক শিশুরা একসাথে একটি সচেতন ফ্যামিলি পলিসি তৈরি করবে। ২. অভিভাবকগণকে সবার প্রথমেই পলিসি মানতে হবে। ৩. কখনোই কোন স্মার্টফোন ও ডিভাইস চাইল্ডমান্ডিং’র কাজে ব্যবহার করা যাবে না। ৪. নির্ধারিত সময়ে বাচ্চাদের বয়স উপযোগী এবং শিক্ষনীয় ভিডিও দেখান দেখানো যেতে পারে। ৫. মন হালকা করার জন্য পুরো পরিবার একসাথে বসে কোন পারিবারিক নির্মল মুভি দেখতে পারেন। এতে সবাই খুশি হবে।
বাড়ির কাজে শিশুদের জড়িত করা
অভিভাবকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, বাচ্চাদের বয়স উপযোগী জীবনে কাজে লাগানোর মতো দক্ষতা ও আচার-আচরণ শেখানো। ছোট শিশুরা খুব সূক্ষ্মভাবেতাদের করে দেখে , কীভাবে তাদের পিতা-মাতারা কথা বলে ও ব্যবহার প্রদর্শন করে। ছোট শিশুদের দিয়ে ছোটখাটো কাজ করালে পরিবারের বন্ধন দৃঢ় হয় এবং তা তাদের আত্মবিশ্বাস অর্জনে সাহায্য করে। বড় ভাই ও বোনেরা তাদের ছোট ভাই-বোনদের সাহায্য করতে পারে, যা কিনা তাদের মা-বাবাকে একটু স্বস্তির সুযোগ দেবে। ছোটদের জন্য ঘরের কাজ তিনটি পর্যায় ভাগ করা যায়.
স্কুলে যাওয়ার আগের বাচ্চারা (প্রি স্কুলের শিশুরা)
১. নিজের দাঁত ব্রাশ করা, ২. টেবিল এবং বিছানা গোছানো, ৩. পড়ে যাওয়া খাবারগুলো উঠানো, ৪. কাপড় পরা ও কাপড় ছাড়া (কারো সাহায্য সাথে), ৫. খেলনা সরিয়ে রাখা এবং ৬. ধুয়ার জন্য রাখা কাপড় সরিয়ে রাখা।
প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চারা
১. গ্লাসে পানি ভরা এবং বাসন পরিষ্কার করা, ২. জুতার ফিতা বাঁধা, ৩. সকালের হালকা নাশতা বানানো এবং টেবিলে খাবার সাজানো, ৪. ফোনে টেক্সট মেসেজ লেখা এবং ৫. বাইক কিংবা অন্যান্যর খেয়াল রাখা।
মাধ্যমিকের বাচ্চারা
১. কিছু সময়ের জন্য ছোট ভাইবোন খেয়াল রাখা ,যদি দরকার হয়, ২. খাবার তৈরি করা, ৩. রুম গোছানো ,যেমন বাথরুম রান্নাঘর, ৪. সাধারণ মেকানিক্যাল অথবা ইলেকট্রিক্যাল কাজ করা, যেমন ভ্যাকিউম ক্লিনার পরিষ্কার করা কিংবা বাল্ব বদলানো (যদি নিরাপদ হয়) এবং ৫. পার্টটাইম চাকরি কিংবা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ।
অভিভাবকদের সূক্ষ্মভাবে কঠিন সময়গুলোকে সচেতনভাবে পার করতে হবে- খুশিমনে এবং যত্নের সাথে, এতে বাচ্চা মা-বাবাকে সম্মান করবে। এতে তারা প্রাকৃতিকভাবেই নিজেদের পারিবারিক কাজে জড়াবে এবং খুশিমনে অভিভাবকদের সাহায্য করবে। অভিভাবকগণ তাদেরকে নিজেদের সাথে কাজ করতে দেখে খুশি হবে- এই ভেবে যে তাদের বাচ্চারা খুশিমনে এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে সুসন্তান হিসেবে গড়ে উঠছে। এরকম সুন্দর পরিবেশ বাসায় তৈরি করতে হবে। দক্ষ ও ইতিবাচক অভিভাবক একটি নতুন যুগে গড়ে তুলতে পারে- মানবিক গুণাবলীতে পরিপূর্ণ যেমন ধৈর্যশীলতা, সহনশীলতা এবং সম্মান করা,অন্যের সেবা করার মন-মানসিকতা নিয়ে। ঘরই হলো মানবসভ্যতার দুর্গ; এই মহামারি লকডাউনটাকে দুর্যোগের সময়ে আলো হিসেবে দেখতে হবে। আমরা ভবিষ্যৎকে বর্তমানের চেয়ে ভালো করে গড়ে তোলার চেষ্টাটুকু করতেই পারি/
লেখক: ড. মুহাম্মদ আবদুল বারী, ব্রিটিশ–বাংলাদেশি শিক্ষাবিদ, প্যারেন্টিং কন্সালট্যান্ট, ও লেখক। তার এই লেখাটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন হাসানাত ফারিহা নূন /