একটা মেয়ে যখন জন্ম নেয় তখনই তার জীবনের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তার যুদ্ধ হচ্ছে পুরো সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার মাকে কথা শুনতে হয় কন্যাশিশু জন্ম দেওয়ার জন্য। নিজের পরিবার এমনকি তার স্বামীও মাঝেমধ্যে কথা শোনায় তাকে। অন্যদিকে গ্রামেগঞ্জের মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। এখনো আমাদের দেশে বহু জায়গায় বাল্যবিবাহের প্রথা রয়েছে। মেয়েরা শুধু শুধুই ঘরের অন্ন ধ্বংস করে বলে মনে করে গ্রামীণ সমাজ। মেয়েদের পড়ালেখা শেখানো পাপের কাজ মনে করে তারা। পড়ালেখা শিখলে মেয়েরা অবাধ্য হয়ে যাবে এমন ধারণা এখনো বিদ্যমান।
গ্রামীণ ধনবানরা নিজেদের কুসন্তান কিংবা প্রতিবন্ধী সন্তানকে বিয়ে দেওয়ার জন্য খুঁজে বের করে গরিব ঘরের কোনো সুন্দরি মেয়েকে। অনেক ক্ষেত্রেই চাপিয়ে দেওয়া হয় তাদের ওপরে।
আমাদের সমাজে কোনো একটা দুর্ঘটনার জন্য কাউকে দায়ী করা বা কারো জন্মকে দায়ী করা খুবই সহজ ব্যাপার। কারো জন্মের সময় যদি তার মা মারা যায় তখন তার জন্য দায়ী করা হয় সেই মেয়েকেই। অনেকে বলে থাকে, এই মেয়ে তার মাকে খেয়েছে। এই ধরনের হীনমানসিকতার মানুষ আমাদের সমাজে অহরহ বাস করছে। আবার অনেক সময় কোনো পুরুষ যদি স্ত্রী মারা যাবার পর দ্বিতীয় বিয়ে করে তখন তার দ্বিতীয় স্ত্রী আগের ঘরের সন্তানের ওপর বিরূপ আচরণ করে। কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। কারণ নারীরা মায়ের অনুভূতিকে খুবই সম্মান করে, তাই হয়তো অনেকেই নিজের সন্তানের মতো করেই মেনে নেয়। কিন্তু ঐ মহিলার আত্মীয়স্বজনেরা তাকে বিভিন্ন ধরনের প্ররোচনায় ফেলার চেষ্টায় থাকে সবসময়। সব ক্ষেত্রেই যে এমন ঘটে তা নয় তবে এমন ঘটনাও কম নয়। অ্যাসিড নিক্ষেপ বেশ কিছু বছর আগে অনেক ভয়াবহ একটি রোগ ছিল। কোনো মেয়েকে প্রেম বা বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আশাহত হলেই তার ওপর ঈর্ষা করে অ্যাসিড নিক্ষেপ করা হয়। এই সমস্যা একদম মহামারি আকার ধারণ করেছিল। বহু মেয়ের জীবন নষ্ট হয়েছে এই অ্যাসিড নিক্ষেপের ভয়াল আঘাতে। তবে যথাযথ শাস্তি তথা চূড়ান্ত শাস্তি ফাঁসি ধার্য্য করার ফলে অ্যাসিড নিক্ষেপের মতো গর্হিত কাজ থেকে সরে আসে অপরাধীরা। তবে অপরাধ কমে গেলেও শেষ তো আর হয়নি। শকুনেরা এখনো ঘুরে বেড়ায়। মাঝেমধ্যে হানা দেয়। মেয়েদের প্রতি আশালীন আলোচনা থেকে দূরে থাকতে পারে না শিক্ষকেরাও। হোম টিউটর থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এমনকি মাদ্রাসার শিক্ষকেরাও মেয়েদের প্রতি আশালীন আচরণ করে। অনেক সময় মেয়েরা ভয়ে কিছু বলতে পারে না। অনেক সময় আবার মেয়েদের ফাঁদে ফেলে দীর্ঘদিন নির্যাতন চালায় তারা। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ভালো নম্বর দেওবার প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক গড়ার প্রস্তাব দেয় শিক্ষকেরা। অনেক সময় শিক্ষকেরা আর্থিক দুর্বলতার সুযোগ নিতে চায় তারা। কিছু মানুষ এই সমাজে পাওয়া যায় যারা মেয়েদের সামান্য একটু সাহায্য করেই তার প্রতিদান নিতে চায়। এই প্রতিদান হিসেবে তারা নিতেই চায় মেয়েদের সমভ্রম। সবার নজরই ঘুরেফিরে ঐ শরীর ঘিরে। মেয়েদের কে অন্য চোখে দেখা মানুষদের আলাদা একটা প্রজাতিই আছে। তারা সবসময় ঘুরে বেড়ায় কাউকে একটু সাহায্য করার। সাহায্য করে কাছে যেতে পারলেই হয়ে গেল।
কাছে গিয়ে চেষ্টা থাকে তার সংস্পর্শে যাওয়ার। গণপরিবহন মেয়েদের জন্য বিশাল একটা সমস্যার জায়গা। এতে উঠতে গেলেই হেলপারের কুস্পর্শের শিকার হতে হয়। বাস থেকে কেউ নামতে গেলে বা কেউ বাসে উঠতে গেলে কোনো মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে বাজে স্পর্শ করে। কোনো মেয়ে সিটে বসে থাকলে বা দাঁড়িয়ে থাকলে তার পাশে গা ঘেষে দাঁড়িয়ে যায় মানুষ। সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা যায় কোনো মেয়ে যদি বাসে গাড়িতে একা থাকে তখন নির্জন জায়গায় একা থাকলে তাকে ধর্ষণের শিকার হতে হয় এমন ঘটনা আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায়। গণপরিবহন আমাদের দেশে অনেক ভয়ানক একটি জায়গা।
রাস্তায় একা একটা মেয়ে দেখলে অনেকে তাকে সুযোগ মনে করে। কিন্তু উচিত তো তাকে আমাদের দায়িত্ব মনে করা। গভীর রাতে কোনো মেয়েকে দেখলেই আমরা ভাবি যে হয়তো খারাপ কাজ করতে বের হয়েছে। তাই তাকে ভিন্ন ধরনের ইঙ্গিত করা হয়। কিন্তু উচিত তো মেয়েটা কোনো বিপদে পড়েছে কি না সেটা জেনে তাকে সাহায্য করা। সেটা না করে তার ওপর হামলে পড়ে বা তার ক্ষতি করার চেষ্টা করা হীনমন্যতার পরিচয়। এই পরিচয় দেখানো মানুষের সমাজে অভাব হয় না। এত সব কিছুর পরও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করতে হবে সর্বত্র।