আগস্ট মাস শোকের মাস। এই মাসের ১৫ তারিখ ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞের ভয়ঙ্কর দিন। বেদনাবিধুর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় ইতিহাসের এক ভয়াল দিন। যেদিন ঘাতকের নখর দেখে থমকে যায় বাতাস। নীলাভ আকাশ হয়ে ওঠে বর্ণহীন ফ্যাকাশে। বন্ধ হয়ে যায় বৃক্ষপত্রের নড়াচড়া। পাখি ভুলে যায় গান। ১৫ আগস্ট সেই শোকের দিন। কান্নার দিন। রক্তের অক্ষরে লেখা পঁচাত্তরের ভয়াল ১৫ আগস্ট। কাঁদো, বাঙালি কাঁদো। সেদিনের সেই শোক হয়ে গেছে চিরদিনের। সেই শোক জেগে আছে রক্তরাঙ্গা ওই পতাকায়, সেই শোক অনির্বাণ এখনও বাংলায়। নদীর স্রোতের মতো চির বহমান এই শোকপ্রবাহ। বাংলাদেশ ও বাঙালীর জন্য গভীর মর্মস্পর্শী শোকের দিন। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম সেই পুরুষ তিনি, একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে (১৯২০-১৯৭৫) স্বদেশের মাটি আর মানুষকে এমন গভীর ভালবাসার বন্ধনে বেঁধেছিলেন, যে বন্ধন কোনদিনও ছিন্ন হওয়ার নয় ।
আজীবন ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, দরিদ্র-নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন, যার তুলনা বিরল। একজন প্রকৃত নেতার যেসব গুণাবলী থাকা প্রয়োজন, তার সব গুণ নিয়েই জন্মেছিলেন ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ। যাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল বহুবর্ণিল, যাঁর কণ্ঠে ছিল জাদু। যিনি রচনা করেছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিজয় ইতিহাস। এতকিছুর পরও শেষ পর্যন্ত তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে ঘাতকের হাতে। পরিবারের নারী-শিশুরাও সেদিন রেহাই পায়নি ঘৃণ্য ঘাতকচক্রের হাত থেকে। বিদেশে থাকার জন্য প্রাণে বেঁচে যান কেবল বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত দিন। বাংলাদেশের ইতিহাসের অত্যন্ত মর্মস্পর্শী করুণ এক অধ্যায়।
সেদিন নিষ্ঠুরভাবে একে একে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, তিন ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল, বঙ্গবন্ধুর অনুজ পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা শেখ নাসের, ভগ্নিপতি পানি সম্পদমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর ছেলে আরিফ ও শিশুপৌত্র সুকান্ত বাবু, ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, সেরনিয়াবাতের কন্যা বেবি সেরনিয়াবাত, আবদুর নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলসহ কয়েক নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও কর্মচারী। লুঙ্গিতে জড়ানো শিশু রাসেলের রক্তভেজা লাশ দেখে খুনীদের প্রতি চরম ঘৃণা-ধিক্কার জানানোর ভাষা পায়নি মানবতাবাদী বিশ্বের কোন মানুষ।
দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি গড়েছেন বঙ্গবন্ধু: দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি গড়ে দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সংক্ষিপ্ত শাসনকালে অর্থনীতির প্রতি খাতের জন্যই সুস্পষ্ট এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন তিনি।
বিদেশি পর্যবেক্ষকরা যখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে সংশয়ের বাণী আউড়াচ্ছিলেন, সেই তখনই, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মাটি আর মানুষের শক্তিতে ভর করে ঘুরে দাঁড়ানোর এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গত বুধবার বঙ্গবন্ধুর ৪৬তম শাহাদাৎ বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস সামনে রেখে এ আলোচনার আয়োজন করে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই)।
ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু যখন দেশ পুনর্গঠনে মনোযোগ দিয়েছিলেন, যখন তার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই এ দেশীয় অপশক্তির ঘাতকের বুলেট কেড়ে নেয় বাঙালির মুক্তির কা-ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে।’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আজকের বাংলাদেশ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার মূল ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কৃষি, ব্যাংক-বীমা, বিদ্যুৎ- যোগাযোগ, সব বিষয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে গেছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি।’
সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, ‘এখনও সরকারি যেসব পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়, সেগুলো জাতির পিতার দিয়ে যাওয়া নির্দেশনার আলোকেই বাস্তবায়িত হচ্ছে। উন্নয়ন দর্শন, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু এখনও বেঁচে আছেন বাংলাদেশের প্রতিটা অগ্রযাত্রায়।’ সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন এবং সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরেন। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত জাতীয় অগ্রগতি হিসেবে মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, দারিদ্যের হারসহ বিভিন্ন সূচকের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ বঞ্চনার কারণে ১৯৪৭ সাল থেকেই স্বাধীনতার বীজ বুনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। নানা ঘাত প্রতিঘাত পার হয়ে দেশকে স্বাধীন করার পর জাতির পিতা একটি শোষণ বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর অর্থনৈতিক দর্শনের মূল কথা ছিল সাধারণ মানুষের মুক্তি।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এডিপির সংশোধিত বরাদ্দের মাত্র ৬০ ভাগ খরচ হয়; আর বাকি দুই মাসে খরচ হয় শতকরা ৪০ ভাগ। মে-জুনে যেসব উন্নয়নকাজ করা হয় তার বড় অংশ বৃষ্টি, বন্যার পানি, নদীভাঙন ও বাঁধের ফাটলে তলিয়ে যায়। দেশের খুব একটা উপকার হয় না। এই ধরনের অপচয় বন্ধে জানুয়ারি-ডিসেম্বর অর্থবছর করার জোর সুপারিশ করছি।’
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেস্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ‘স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে বেসরকারি খাতের বিকাশ এবং রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের শুরু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই। পাটকল ও বস্ত্র কারখানা বেসরকারি খাতে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন। এত দিন পরে এসে আমরা রপ্তানি বহুমুখীকরণের কথা বলছি। অথচ বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে বেক্সিমকোকে পাট রপ্তানির অনুমোদনের সময় মোট রপ্তানির ৪০ ভাগ অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির শর্ত বেঁধে দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতি গড়তে। আজকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, এর নীলনকশা করে গেছেন বঙ্গবন্ধু।’
গত বক্তব্যে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, ভঙ্গুর অর্থনীতি, বিপর্যস্ত যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেই মাথাপিছু আয় ৯৩ ডলার থেকে ২৭১ মার্কিন ডলারে উন্নীত করেছিলেন।
এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন ব্যবসায়ী নেতা ও সাংসদ শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ ও কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবির এবং এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু।