মহাসড়ক আইন ২০২১
১৯২৫ সালের হাইওয়ে অ্যাক্ট রহিত করে মহাসড়ক নির্মাণ, উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা এবং অবাধ, সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ যান চলাচলের জন্য নতুন আইনটি বিল আকারে ৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ আইনের অধীনে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার বলে দেবে, কোন সড়ক বা মহাসড়কে কে প্রবেশ করবে বা কে প্রবেশ করবে না। কোনটা এক্সপ্রেসওয়ে হিসেবে ঘোষণা করা হবে। সেগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে। কোন মহাসড়কগুলোয় টোল নেয়া হবে। যেখানে সেখানে পথচারী পারাপার বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোয় স্বাভাবিক ঘটনা। দ্রুতগতির গাড়ির সঙ্গে মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়ায় ধীরগতির গাড়ি। ফসল শুকানোসহ গৃহস্থালি নানা কাজেও সংলগ্ন মহাসড়ক ব্যবহার করে মানুষ। মহাসড়কের ওপর হাটবাজার গড়ে তোলা, পার্শ্ববর্তী জায়গায় অবৈধ অবকাঠামো নির্মাণেরও উদাহরণ রয়েছে। এতে একদিকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও যানজট যেমন বাড়ে, তেমনি মহাসড়কের আয়ুও ফুরিয়ে যায় দ্রুত। এসব ঠেকাতে মহাসড়ক আইন, ২০২১-এ পথচারী ও যানবাহনের প্রবেশাধিকার সীমিত করতে যাচ্ছে সরকার। আইন অমান্যের জন্য রাখা হয়েছে জরিমানা ও কারাদ-ের বিধান। স¤প্রতি এ আইনের বিল প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
আইনটি প্রয়োগের আগে এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, আইনটিতে মহাসড়কে পথচারী ও যানবাহনের ওপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য জায়গা দিয়ে পথচারীরা চলতে বা পারাপার হতে পারবে না। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মহাসড়কে কিন্তু এ নির্দিষ্ট স্থানটি করে দেয়া নেই। ধীরগতির যানবাহন মহাসড়কে চলতে পারবে না বলা হয়েছে। কিন্তু সব মহাসড়কে তো এখনো ধীরগতির যানবাহনের জন্য আলাদা লেন নেই। পথচারী ও যানবাহনের ক্ষেত্রে এ ধরনের যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, সে অনুযায়ী মহাসড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন করার আগেই যদি আইনটি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তার সুফল পাওয়া যাবে না। তিনি আরো বলেন, মহাসড়কের ওপর বা ১০ মিটারের মধ্যে হাটবাজার না করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দেশের অনেক মহাসড়কে তো সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরই দীর্ঘমেয়াদে হাটবাজার ইজারা দিয়ে রেখেছে। তাই আইনটি প্রয়োগের আগে আনুষঙ্গিক সব বিষয় প্রতিপালন করতে হবে। তা না হলে এটি কেবল কাগুজে আইন হয়েই থাকবে।
মহাসড়ক আইন, ২০২১-এর উত্থাপিত বিলে বলা হয়েছে, ফসল, খড় বা অন্য কোনো পণ্য শুকানো বা অনুরূপ কোনো কাজে মহাসড়ক ব্যবহার করা যাবে না। মহাসড়কের নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোনো স্থান দিয়ে পদযাত্রা করা যাবে না। এ দুই ধারার অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ হাজার থেকে সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা অর্থদ-। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া কোনো বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, তোরণ বা অনুরূপ কিছু মহাসড়কে স্থাপন করা যাবে না। ধীরগতির যানবাহন নির্ধারিত লেন ছাড়া অন্য কোনো লেনে চলতে পারবে না। সরকারি প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত গতির যানবাহন ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চালানো যাবে না। নির্ধারিত স্থান ছাড়া কোথাও ইউটার্ন নির্মাণ করা যাবে না। মহাসড়ক বা মহাসড়ক-সংশ্লিষ্ট কোনো স্থানে নির্মাণসামগ্রী রাখা যাবে না। গাড়ি চলাচলের জন্য প্রতিবন্ধক হতে পারে এমন কোনো বস্তু রাখা যাবে না। কোনো ব্যক্তি এসব বিধান অমান্য করলে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। একইভাবে নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য কোনো স্থান দিয়ে গবাদিপশু প্রবেশ করানো, পারাপার, চরানো, হাঁটানো বা অবস্থান করানো যাবে না। ক্ষতিকর পদার্থ নির্গত হয় এমন যানবাহন চালানো যাবে না। এ দুই অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ২৫ হাজার থেকে সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড।
মহাসড়কের সীমানার পাশে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করলে তার বেদির উচ্চতা কোনোভাবে মহাসড়কের উপরিতলের বেশি রাখা যাবে না। মহাসড়ক, প্রান্তসীমা বা মহাসড়ক-সংশ্লিষ্ট কোনো অংশে ময়লা, আবর্জনা বা অন্য কোনো বস্তু নিক্ষেপ করা কিংবা স্তূপ করে রাখা যাবে না। ট্রাফিক সাইন, সাইন পোস্ট, সড়ক মার্কিং, সড়কবাতি, সড়ক নিরাপত্তাসামগ্রী, সড়ক নিরাপত্তা বেষ্টনী, সড়কের সীমানা নির্ধারণী পোস্ট, কিলোমিটার পোস্ট ইত্যাদি অপসারণ, ক্ষতিসাধন, ধ্বংস, পরিবর্তন বা কোনো বস্তু দ্বারা আচ্ছাদিত করা যাবে না। এসব অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ ১ লাখ থেকে সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকা জরিমানা। অন্যদিকে মহাসড়কের সংরক্ষণ রেখার মধ্যে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করলে, কোনো অংশ থেকে বালি, মাটি, পাথর বা সংশ্লিষ্ট কিছু উত্তোলন করলে সর্বোচ্চ ৫ লাখ থেকে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা অর্থদ- বা অনূর্ধ্ব দুই বছরের কারাদ- কিংবা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে।
আইনটি সম্পর্কে জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সবুর বলেন, ১৯২৫ সালের যে হাইওয়ে অ্যাক্ট, তাতে মহাসড়ক উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের আইনি কাঠামো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাই আগের আইনটি রহিত করে নতুন আইন করা হচ্ছে। আইনটি এরই মধ্যে বিল আকারে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে। পরে বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। আইনটি পাস হওয়ার পর মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনার মতো কাজগুলো অনেক সহজ হয়ে যাবে।
নির্ধারিত মাশুল প্রদান সাপেক্ষে নাগরিক সেবা প্রদানকারী সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন পরিষেবার সংযোগগুলো মহাসড়কের প্রান্তসীমা বরাবর স্থাপন করতে পারবে। তবে শর্ত থাকে যে মহাসড়কের উন্নয়ন, মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণের সময় প্রয়োজন হলে ওই পরিষেবা সংযোগগুলো সেবা প্রদানকারী-সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিজ খরচে নির্দিষ্ট সময়ে অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে স্থানান্তর করবে। আইন অনুযায়ী অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাষিত বা বেসরকারি সংস্থা মহাসড়কের ভূমি ব্যবহার করে কোনো অবকাঠামো স্থাপন করতে পারবে না। কোনো প্রতিষ্ঠান এ বিধান লঙ্ঘন করলে তা হবে একটি অপরাধ। এ অপরাধের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী ব্যক্তিরা বা তাদের সহায়তাকারী কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
সরকার বা সরকারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি মহাসড়ক উন্নয়ন, মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণ, মহাসড়ক-সংশ্লিষ্ট সুয়ারেজ সিস্টেম, ড্রেন, কালভার্ট, সেতু নির্মাণ ও সংস্কার করবেন। বিলে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব থেকে মহাসড়কের সম্ভাব্য ক্ষতি হ্রাসের জন্য মহাসড়ক নেটওয়ার্কের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব সহনশীল টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। মহাসড়ক নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের সময় এ কাজের জন্য নিয়োজিতদের ব্যক্তি ও মহাসড়ক ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করতে হবে তা বলে বলা হয়েছে। বিলে মহাসড়ক বা সড়কের স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি, অবৈধ দখল কিংবা প্রবেশমুক্ত রাখার জন্য কী করণীয় হবে এবং সার্ভে করার জন্য কতদূর মানুষের বাড়ি পর্যন্ত ঢুকতে পারবে সেসব বিষয়ে বলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী, শিশু ও বায়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের মহাসড়কে নির্দিষ্ট স্থান ও নিরাপদে ব্যবহারের জন্য পদক্ষেপ নেয়ার বিধানও রাখা হয়েছে।