বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:০০ অপরাহ্ন

সাহায্যপ্রার্থীর প্রতি আচরণ

জামান শামস:
  • আপডেট সময় শনিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র অমুখাপেক্ষী, এই দুনিয়ার সবাই প্রয়োজন পূরণে অন্যের মুখাপেক্ষী। কেউ-ই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এর মাঝে আবার অনেকে সাহায্যপ্রার্থীও হয়ে থাকেন। খারাপ অবস্থায় আমাদের কাছে কোনো আত্মীয়, প্রতিবেশী বা ভিখারি আসেন সাহায্য চাইতে। তখন আমাদের অবস্থান কেমন হওয়া উচিত?
কেউ আপনার কাছে সাহায্য চাইতে এলেন। ধরুন এই মুহূর্তে টাকা আপনার হাতে নেই। হয়তো ব্যবসায় লাগিয়েছেন, অথবা আপনার কাছে শুধু নিজের চলার মতো টাকা আছে। এমন অবস্থায় আপনি তাদের কিছু দিতে পারলেন না। অনেক সময়ই মানুষ চাইলেও আমরা দিতে পারি না বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে। কেউ আপনার কাছে হাত পাতল। আপনি তাকে কিছু দিতে পারলেন না। তাকে এড়িয়ে গেলেন। এটা হয় আপনার অসচ্ছল বা অপ্রস্তুত অবস্থার কারণে। আপনার অক্ষমতায় আপনি লজ্জিত থাকেন তখন। আল্লাহ পাক বলেন এবং তোমার পালনকর্তার করুণার প্রত্যাশায় অপেক্ষমাণ থাকাকালে যদি কোনো সময় তাদের বিমুখ করতে হয়, তখন তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বল (সূরা বনি ইসরা : ২৮)।
এই কথার অর্থ কী? কেউ এসে একজনের কাছে চাইলেন। যার কাছে চাইলেন তিনি বললেন, ‘আমার কাছে কিছু নেই।’ ধরুন, রাস্তায় জ্যামে বসে আছেন। এমন সময় কোনো এক ভিক্ষুক কাছে এলো। আপনি বললেন, ‘উফ! আমার কাছে কিছুই নেই। যা ভাগ, অন্য গাড়িতে গিয়ে চা।’ আপনি তাকে তাড়িয়ে দিলেন। অথবা তাকে প্রশ্ন করতেই থাকলেন। তার বাড়ি কোথায়, ছেলেমেয়েরা কি নেই? বাসাবাড়িতে কাজ করে খেতে পারে না? ইত্যাদি ইত্যাদি। কিংবা গোয়েন্দাদের মতো সন্দেহ করতে লাগলেন-ব্যাটা তো টাকা দিলেই ফেনসিডিল খাবে!
আল্লাহ বলছেন, যদি তারা তোমার কাছে আসে, যে কেউই যদি আপনার কাছে হাত পাতে, কিছু দিতে না পারলেও বরং তাদের কাছ থেকে সম্মানের সাথে এড়িয়ে যাও। আর যেই ভঙ্গিতে আল্লাহ আপনাকে জওয়াব শিখিয়ে দিলেন তা থেকে বোঝা যায় যে, আপনি নিজেই একজন ফকির, আল্লাহর কাছে প্রার্থী। আপনি আপনার রবের রহমতের বড়ই কাঙাল। আল্লাহ আপনাকে তখনো দেখতে পাচ্ছেন যখন আপনি কাউকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। মনে রাখবেন, আপনি আল্লাহর রহমত খুঁজছেন। হাত পাতা মানুষটা টাকার কাঙাল। কিন্তু আপনি আল্লাহর রহমতের কাঙাল। আল্লাহর রহমতের হিসাবের খাতায় আপনি দেউলিয়া। তাই কাউকে ফিরিয়ে দেবার সময় নিজের আচরণের দিকে খেয়াল রাখবেন।
আপনি আল্লাহর রহমত, তাঁর ভালোবাসা ও আশ্রয় খুঁজছেন, আশা করছেন। সুতরাং তাহলে তাদের সাথে নম্র কথা বলবেন। কিছু দিতে না পারলেও তাদের সুন্দরভাবে ফিরিয়ে দেবেন। অযথা প্রশ্ন করবেন না, অনুমান বা সন্দেহজনক মন্তব্য করবেন না, তার সাথে মন্দ আচরণ করবেন না। কারণ আপনি জানেন না, আপনার ধনসম্পদইবা আপনার কাছে থাকবে কতক্ষণ ?
মাওলানা ওয়াহিদ উদ্দিন খান লিখেছেন, একবার মাওলানা শফি রহ: গাড়িতে করে কোনো মাহফিলে যাচ্ছিলেন। সাথে একজন সফরসঙ্গী খাদেম হিসেবে আছেন। পথিমধ্যে গাড়ি জ্যামে পড়লে একজন হৃষ্টপুষ্ট ভিক্ষুক সাহায্য চাইলে তার খাদেম তাকে সাহায্য করতে বারণ করেন এই বলে যে, সে টাকা নিয়ে নেশা করবে। মাওলানা তার খাদেমকে ছোট আওয়াজে শুধু বললেন, বাবা! আল্লাহ তোমাকে কোনো প্রার্থীকে দিতে বলেছেন, তোমাকে গোয়েন্দাগিরি করতে বলেননি।
সক্ষমতা না থাকলে দয়া ও নম্র ভাষায় তাদের সাথে কথা বলতে হবে। কারণ, যখন তারা আমাদের কাছে এসে হাত পাতে, তখন তারা সাথে করে আল্লাহর রহমত ও আজমত নিয়ে আসে। আর তাদের দিতে না পারার কারণে আল্লাহর কাছে সেই রহমতের ভিক্ষা চাইতে হবে যা তাদের মাধ্যমে এসেছিল; অথচ আমরা সেই সুযোগটি হারালাম। শীতার্ত, অসহায়, পীড়িত, ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত ও বিপদাক্রান্ত মানুষকে সহযোগিতা করলে আল্লাহ উভয় জগতে প্রতিদান দেবেন।
আবু সাইদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘যে মুমিন কোনো মুমিনের ক্ষুধা নিবারণ করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে কেয়ামতের দিন জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। যে মুমিন কোনো মুমিনের তৃষ্ণা দূর করেছে, আল্লাহ তায়ালা তাকে কেয়ামতের দিন মোহরাঙ্কৃত জান্নাতি সুধা থেকে পান করাবেন। যে মুমিন কোনো মুমিনকে বস্ত্র দান করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের উন্নতমানের সবুজ কাপড় পরাবেন ’ (তিরমিজি, ২৩৮৬)। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা: বলেন, কেয়ামতের দিন নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা বলবেন, হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমার শুশ্রুষা করোনি। বান্দা বলবে, হে আমার রব। আপনি তো বিশ্বজাহানের প্রতিপালক, কিভাবে আমি আপনার শুশ্রুষা করব? তিনি বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, অথচ তুমি তার সেবা করোনি। তুমি কি জানো না, যদি তুমি তার শুশ্রুষা করতে তবে তার কাছেই আমাকে পেতে। হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাবার দাওনি। বান্দা বলবে, হে আমার রব, আপনি তো বিশ্বজাহানের প্রতিপালক, কিভাবে আপনাকে আহার করাব?’ তিনি বলবেন, তুমি কি জানো না, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, কিন্তু তুমি তাকে খাবার দাওনি। তুমি কি জানো না যে, তুমি যদি তাকে খাবার খাওয়াতে আজ তা পেতে? হে আদম সন্তান, তোমার কাছে আমি পানীয় চেয়েছিলাম, অথচ তুমি আমাকে পানীয় দাওনি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রভু, আপনি সমগ্র জগতের প্রতিপালক, কিভাবে আপনাকে পান করাব? তিনি বলবেন, তোমার কাছে আমার অমুক বান্দা পানি চেয়েছিল, কিন্তু তাকে তুমি পান করাওনি। তাকে যদি পান করাতে, তবে নিশ্চয়ই আজ তা পেতে (মুসলিম ৬৭২১)। আর সত্যিই যদি আপনার সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও ওই প্রার্থীকে আপনি না ফিরান তবে সেটা তো সেই দানের সমান যা সঙ্কটকালে মদিনার আনসাররা করেছিলেন। আল্লাহ বলেন, যারা মুহাজিরদের আগমনের আগে মদিনায় বসবাস করেছিল এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে, মুহাজিরদের যা দেয়া হয়েছে, তজ্জন্যে তারা অন্তরে ঈর্ষাপোষণ করে না এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদের অগ্রাধিকার দান করে। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম (সূরা আল হাশর : ৯)। আল্লাহ আমাদের কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা মোতাবেক আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন। লেখক: সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি:




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com