শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৪:২৪ পূর্বাহ্ন

দারিদ্র্য দূরীকরণে ইসলামের মূলনীতি

আমিরুল ইসলাম লুকমান:
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

মহান রাব্বুল আলামিন মানবজাতির সদস্যদেরকে বিভিন্ন স্তর দান করেছেন। কাউকে করেছেন সম্পদশালী আবার কাউকে করেছেন সম্পদহীন, দরিদ্র। ধনী-গরিবের এমন শ্রেণী ভাগ একান্তই আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাধীন। এখানে অন্য কারোর ইচ্ছাধিকার প্রকাশের সুযোগ নেই। ধনী-গরিবের এই তারতম্যের পেছনে আল্লাহ তায়ালার একমাত্র উদ্দেশ্য, শরিয়তের হুকুম-আহকাম সঠিকভাবে পালন করছে কি না, এ ব্যাপারে বান্দাদেরকে পরীক্ষা করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘জেনে রেখো, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা। আর মহা পুরস্কার রয়েছে আল্লাহরই কাছে’ (সূরা আনফাল-২৮)।
সম্পদ ও সন্তানের মহব্বত মানুষের মজ্জাগত বিষয়। কিন্তু পরীক্ষা এভাবে যে, এ ভালোবাসা আল্লাহ তায়ালার নাফরমানি করতে উৎসাহ জোগায় কি না সেটা লক্ষ করা হবে। সম্পদ ও সন্তানের প্রতি ভালোবাসা যদি গুনাহ ও নাফরমানির দিকে নিয়ে যায়, তবে এটি মহা মুসিবতের কারণ (তাওজিহুল কুরআন)। আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক ধনী-গরিব শ্রেণীর প্রভেদের অর্থ এই নয় যে, মানুষ অকর্মণ্য হয়ে ইচ্ছাকৃত দরিদ্রতা গ্রহণ করবে! বরং উচিত হবে, বৈধ সীমারেখার ভেতরে জীবনের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য অর্জনের চেষ্টা করা। কারণ, হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘দারিদ্র্য কখনো কখনো কুফরিতে নিমজ্জিত করে’ (শুআবুল ঈমান)।
দারিদ্র্য দূরীকরণে ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। নানাবিধ মাধ্যম প্রয়োগ করে দারিদ্র্য নির্মূলের চেষ্টা করেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের আর্থিক বৈষম্য মুছে ফেলতে একদিকে যেমন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি ও নিজ হাতে উপার্জন করার প্রতি ব্যাপক গুরুত্বারোপ করেছে, তেমনি ধনী শ্রেণীর ওপর আর্থিক ইবাদতের বিধান আরোপ করেছে। উভয়ের সামষ্টিক বাস্তবায়নেই সমাজ-রাষ্ট্র থেকে দরিদ্র্যতা দূর হতে পারে। সমাজ ও রাষ্ট্রের অবস্থা বিবেচনায় ইসলাম দারিদ্র্য দূর করার জন্য বিশেষ মূলনীতি গ্রহণ করেছে। কয়েকটি নি¤œরূপÑ
ক. শ্রম বিনিময়ের প্রতি উৎসাহ প্রদান : পবিত্র কুরআন ও হাদিসে শ্রম বিনিময়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জনজীবনে শ্রমের প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নামাজ শেষ হয়ে গেলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকার) সন্ধান করো। যাতে তোমরা সফলকাম হও’ (সূরা জুমা-১০)। এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জাতিকে নামাজ আদায়ের পরই নিজের ও পরিবারের প্রয়োজন পূর্ণ করার লক্ষ্যে রিজিক তালাশের আদেশ করেছেন। ক্রয়-বিক্রয়, ক্ষেত-খামারসহ উপার্জনের যত মাধ্যম আছে, সব ব্যবহার করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ‘তিনিই তোমাদের জন্য ভূমিকে বশ করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তার কাঁধে চলাফেরা করো ও তাঁর রিজিক খাও। তাঁরই কাছে তোমাদেরকে পুনর্জীবিত হয়ে যেতে হবে’ (সূরা মুলক-১৫)। সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের উচিত, আর্থিক উন্নতির জন্য জমিনে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহ প্রদত্ত রিজিক অনুসন্ধান করা। শারীরিক সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে দারিদ্র্যমুক্ত জীবন অর্জনের চেষ্টা করা।
অপর আয়াতে ঘোষিত হয়েছে, ‘হে মানুষ! তুমি নিজ প্রতিপালকের কাছে না পৌঁছা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিশ্রম করে যাবে, পরিশেষে তুমি তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করবে’ (সূরা ইনশিকাক-৬)। মানুষকে আল্লাহ তায়ালা জন্মগতভাবেই উপকরণ অবলম্বন করে রিজিক অন্বেষণের সামর্থ্য সমৃদ্ধ করে সৃষ্টি করেছেন। এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন, প্রতিটি মুসলিমের জীবিকার নিরাপত্তার জন্য উপার্জনে যুক্ত হওয়া আবশ্যক।
তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর সব কিছুকেই মানুষের নিরাপত্তা ও শক্তি অর্জনের সহজ মাধ্যম বানিয়ে দিয়েছেন। এমনকি সমুদ্রের মাঝে চলমান বিশাল জাহাজকে পণ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে মানুষের রিজিক উপার্জনের বড় মাধ্যম বানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনিই তোমাদের প্রতিপালক, যিনি সাগরে তোমাদের জন্য নৌযান চালান, যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ সন্ধান করো’ (সূরা ইসরা-৬৬)।
পবিত্র কুরআনের মতো হাদিস শরিফের দিকে দৃষ্টিপাত করলেও আমরা দেখতে পাই, নবী করিম সা: দারিদ্র্য দূর করার ওপর সীমাহীন গুরুত্বারোপ করেছেন। মুসলমানদেরকে উপার্জনের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন। বলেছেন, ‘নিজ হাতে উপার্জন করে খাদ্য গ্রহণের চেয়ে উত্তম খাবার মানুষের আর হতে পারে না। দাউদ আ: স্বহস্তে উপার্জন করে জীবন ধারণ করতেন’ (বুখারি-২০৭২)। এই হাদিসে স্বহস্তে উপার্জনের গুরুত্ব ও দারিদ্র্য সমস্যার সরাসরি সমাধান রয়েছে। নবীগণ পৃথিবীর বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও বেকার অবস্থায় জীবন ধারণ করেননি, বরং নিজ হাতে উপার্জন করে জীবন অতিবাহিত করেছেন। অন্য একটি হাদিসে সাহাবায়ে কেরামের প্রশ্নের জবাবে নবী করিম সা: বলেছেন, ‘সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আমিও মক্কার লোকদের ছাগল চরাতাম’ (বুখারি-২২৬২)। আরেক হাদিসে আছে, ‘যারা মানুষের কাছে চেয়ে-চেয়ে জীবন ধারণ করে, কিয়ামতের দিন তারা মুখম-লে গোশতহীন অবস্থায় উত্থিত হবে’ (বুখারি-১৪৭৪)। যারা নিজ হাতে কর্ম করে উপার্জন করতে অনীহা প্রকাশ করে, তাদের জন্য এই হাদিসটিতে বিরাট ধমকি রয়েছে। দান-সদকা খেয়ে জীবন ধারণ করা ইসলামী দৃষ্টিকোণে একটি নিকৃষ্ট পন্থা। এভাবে কখনোই কোনো ব্যক্তির দারিদ্র্য দূর হতে পারে না। পক্ষান্তরে নিজ হাতে উপার্জিত সম্পদই শ্রেষ্ঠ।
খ. জাকাত আদায় : ধনীদের সম্পদে আল্লাহ তায়ালা গরিবদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধনীদের সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ গরিবদের মালিকানায় দেয়ার মাধ্যমে ইসলাম দরিদ্রতা নির্মূল করার প্রয়াস চালিয়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণে জাকাত ইসলামের দ্বিতীয় পন্থা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে নবী!)। তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করো, যার মাধ্যমে তুমি তাদেরকে পবিত্র করবে এবং যা তাদের পক্ষে বরকতের কারণ হবে’ (সূরা তওবা-১০৩)।
গ. সাধারণ দান : আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করার লক্ষ্যে এবং বিপুল পরিমাণ সওয়াব অর্জন করার উদ্দেশ্যে গরিব-দুঃখীদের দান-সদকা করা। বিত্তশালী ব্যক্তিদেরকে নিজেদের অঢেল সম্পদ থেকে সামর্থ্য পরিমাণ সম্পদ দীনহীনদেরকে দানে উৎসাহ করার মাধ্যমে ইসলাম দারিদ্র্য দূর করার চেষ্টা করেছে। ধনীদের সামান্য সহযোগিতায় যেকোনো ধনহীন ব্যক্তি নিজের জীবন থেকে দরিদ্রতার আজাব দূর করতে সক্ষম হতে পারে। সাথে সাথে অভাবজনিত যেসব কারণে গরিব মানুষ সাহায্য চাইতে বাধ্য হয়, সাধারণ দানের মাধ্যমে সেসব পরিস্থিতি বন্ধ হয়ে যাবে স্বাভাবিকভাবেই।
মোদ্দাকথা, জীবন ও সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর করার জন্য ইসলাম নানারকম মূলনীতি গ্রহণ করেছে। মানুষের উচিত এসব মূলনীতি অনুসরণ করে সমাজ থেকে অসচ্ছলতা দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করা। খতিব, আল মক্কা জামে মসজিদ, হরপাড়া, শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com