চার বছর আগে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (আমেরিকান) জ্বালানি প্রতিষ্ঠান শেভরন। এজন্য চীনা একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছিল শেভরনের। তবে শেষ পর্যন্ত ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ ছাড়া হয়নি শেভরনের। অন্যদিকে কয়েকটি ব্লকে গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি রয়েছে ২০৩৩-৩৪ পর্যন্ত। শেভরন এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।
২০১৩ সালে রানা প্লাজার ঘটনার পর দেশী-বিদেশী অনেক মহলই আশঙ্কা করেছিল, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র পোশাক কেনা কমিয়ে দেবে। তবে এ-সংক্রান্ত সব আশঙ্কাই ভুল প্রমাণ হয়েছে। কমপ্লায়েন্সে জোর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পোশাক ক্রয় প্রায় দ্বিগুণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত এক দশকে এখান থেকে দেশটির পোশাক ক্রয় বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। এমনকি কভিডকালেও গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানি বেড়েছে ১৮ শতাংশের বেশি। শুধু পোশাক রফতানি নয়, এফডিআই, গ্যাস, বীমাসহ আরো বেশকিছু খাতের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি মার্কিন আগ্রহেই দেশের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে জাপান। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নথিপত্রেও দেখা যাচ্ছে, সামনের দিনগুলোয় মার্কিন-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো গাঢ় হওয়ার সুযোগ রয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের এক সা¤প্রতিক নথিতেও বাংলাদেশকে উল্লেখ করা হয়েছে মার্কিন বিনিয়োগের অন্যতম সম্ভাবনাময় গন্তব্য হিসেবে। দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে এতে বলা হয়েছে, গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ শ্রমশক্তিও এখন ক্রমেই বড় হচ্ছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ বাজারগুলোর ঠিক সন্ধিস্থলে অবস্থান হওয়ায় এখানকার কৌশলগত সুবিধাও অনেক বেশি। পাশাপাশি এখানকার বেসরকারি খাতও অনেক বেশি প্রাণবন্ত ও শক্তিশালী। এফডিআই আকর্ষণে সরকারও এখন অনেক সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। এর বিপরীতে বিনিয়োগের বাধাগুলোও একটু একটু করে দূর হচ্ছে। এমনকি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কভিডের জোরালো আঘাত সত্ত্বেও সামনের দিনগুলোয় বিনিয়োগকারীদের জন্য আরো আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
দেশের গ্যাস উত্তোলন খাতে একমাত্র মার্কিন কোম্পানি শেভরন। তবে এই একটি কোম্পানিই হয়ে উঠেছে এখানকার গ্যাস উত্তোলনের প্রধান চালিকাশক্তি। দেশে বর্তমানে দৈনিক গড়ে ২ হাজার ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলিত হচ্ছে। এর মধ্যে ৬৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ করছে জ্বালানি খাতের শেভরন। কোম্পানিটি বাংলাদেশে কাজ করছে ২৫ বছর ধরে। ২০১৭ সালের দিকে কোম্পানিটি বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা উঠলেও পরে তা আর এগোয়নি। উল্টো প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ আরো বেড়েছে। সামনের দিনগুলোয় তা আরো বাড়তে পারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৬৯৭ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছিল বাংলাদেশ। এর অধিকাংশই ছিল বস্ত্র ও তৈরি পোশাক। অন্যদিকে ওই বছরেই বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বাড়ে ব্যাপক হারে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ৫ শতাংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ওই বছর দেশে ২১২ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থমূল্যের মার্কিন পণ্য আমদানি হয়।
আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য শীর্ষ দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের বিনিয়োগেও যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দিচ্ছে। দেশের রেমিট্যান্সেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এক্ষেত্রে তাদের অবস্থান দ্বিতীয়। সব দিক বিবেচনায় দুই দেশের সম্পর্কটা অনেক শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের অ্যামচেম থেকেও দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীর করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আগামী দিনগুলোতেও দুই দেশের সম্পর্কে আরো ইতিবাচক গভীরতা দেখা যাবে বলে প্রত্যাশা করছি। এভারকেয়ারে যে বিনিয়োগ, তা এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এভিয়েশন খাতে ড্রিমলাইনারগুলোর সবই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আবার বেল হেলিকপ্টারগুলোও তাই। পেমেন্ট খাতেও মার্কিন বিনিয়োগ আছে। সব মিলিয়ে মার্কিন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগে অনেক মনোযোগ বাড়িয়েছে, যা সামনে আরো বাড়বে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
বর্তমানে দেশে এফডিআইয়ের সবচেয়ে বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর শেষেও দেশের মোট এফডিআইতে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। ওই সময়ে দেশে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা পুঞ্জীভূত এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ৩৯২ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগগুলো এসেছে জ্বালানি তেল ও গ্যাস, ব্যাংকিং ও বীমা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে। বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগ আগ্রহ সম্পর্কে জানতে চাইলে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি রূপালী চৌধুরী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রফতানি অনেক আগে থেকেই ভালো ছিল। আমদানিও বাড়ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে মার্কিন বিনিয়োগ আছে। বাংলাদেশও দেশটিতে বাজার প্রবেশাধিকার বাড়াতে চাইছে। আমাদের অপ্রচলিত পণ্যের রফতানি বৃদ্ধির চেষ্টাও করা হচ্ছে। দেশটির প্রত্যাহার করা বাণিজ্য সুবিধা পুনরুদ্ধার করা গেলে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে। এখনো হচ্ছে। কিন্তু দেশটিতে আমাদের বিনিয়োগ প্রচারণামূলক কর্মসূচিগুলোর কার্যকারিতা আরো বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ সুবিধাগুলো আরো যথাযথভাবে উপস্থাপন করা গেলে দুই দেশের সম্পর্কের আরো সুফল পাওয়া সম্ভব।
২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থমূল্যের পণ্য বিশ্ববাজারে রফতানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়েছে ৬৯৭ কোটি ডলারেও বেশি পণ্য। এ হিসেবে দেশের মোট রফতানির প্রায় ১৮ শতাংশই যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। এদিকে আমদানিও বাড়ছে দেশটি থেকে। দেশের রফতানিমুখী পোশাকপণ্যের সুতা তৈরিতে বছরে ৭৫ লাখ বেল তুলা আমদানি হয়। একসময় সিংহভাগ আমদানি হতো প্রতিবেশী ভারত থেকে। বর্তমানে ১৪ শতাংশ আমদানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, দেশটিতে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি প্রতি বছরই বাড়ছে। কিন্তু দেশটির পোশাকপণ্যের বাজারে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে, যেগুলো এখন পর্যন্ত কাজে লাগানো যায়নি। দেশটির অনেক ক্রেতা আছেন যারা চীন, ব্রাজিল ও ভিয়েতনাম থেকে বিপুল পরিমাণ পোশাক কেনেন। এ ক্রেতাদের খুঁজে বের করে তাদের বাংলাদেশের সক্ষমতা সম্পর্কে আরো স্বচ্ছ ধারণা দিতে হবে। এভাবে বর্তমান সম্পর্ক আরো গভীর করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে ভিয়েতনামে অনেক মার্কিন ক্রেতা আছেন, যারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনতে পারেন। কিন্তু তাদের ধরা সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্রেতাদের ধরতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এখনই যদি এ সুযোগ কাজে লাগানো যায়, তাহলে দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্রমেই আরো দৃঢ় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
১৯৫২ সালে অ্যালিকো নামে যাত্রা করেছিল মার্কিন বীমা কোম্পানি মেটলাইফ। বর্তমানে বাংলাদেশে কোম্পানিটির ১৬ হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করছেন। বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটির (আইডিআরএ) বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, দেশের বীমা খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে খাতটির একমাত্র মার্কিন কোম্পানি মেটলাইফের হিস্যা এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। এছাড়া দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক চিকিৎসা উপকরণ ও যন্ত্রেরও উৎস যুক্তরাষ্ট্র। এর বাইরে দেশের এভিয়েশন খাতেও যুক্তরাষ্ট্রের অবদান রয়েছে।
কূটনীতিকরা বলছেন, দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীর হচ্ছে, এ কথা ঠিক। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কে যে অপারসম্ভাবনা, তার খুব কমই এখন পর্যন্ত কাজে লাগানো গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক বাজার। দেশটিতে জিএসপির আওতায় যে বাণিজ্য সুবিধা পাওয়া যেত, সেটা আপাতত স্থগিত রয়েছে। এ বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এদিকে প্রতিযোগী দেশগুলো জিএসপির আওতায় মার্কিন বাজারে বিভিন্ন পণ্যের রফতানি বাড়াচ্ছে। পোশাকপণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবৃদ্ধিও ভালো, তবে তা যথেষ্ট নয়। এদিক থেকে প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম ও ভারতও এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি আকারের আমদানিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ খুবই সামান্য। বর্তমানে যে কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ব্যবসা করছে, তারা যে খুব শান্তিতে ব্যবসা করতে পারছে তা নয়। সমস্যা হলো দেশের আইন-কানুনগুলো অনেক অস্বচ্ছ। শেভরনের মতো ফ্ল্যাগশিপ বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলোকে আরো বেশি আকৃষ্ট করতে গেলে যে সমন্বিত উদ্যোগ বা মনোযোগ প্রয়োজন তা নীতিনির্ধারকদের নেই। মার্কিন বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মুনাফা। সমগ্র এশিয়ায় মার্কিন কোম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণে ব্যবসা করে। সে তুলনায় বাংলাদেশে দেশটির ব্যবসা খুবই অপ্রতুল। বলা যায়, ক্ষুদ্র একটা অংশ।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, বড় মার্কিন কোম্পানিগুলোকে ধরে রাখার পাশাপাশি নতুনগুলোকে আকৃষ্ট করতে যে পরিমাণ পদ্ধতিগত উন্নয়ন দরকার, এ বিষয়ে আমাদের আরো মনোযোগ দিতে হবে। কর জটিলতার মতো বিষয়গুলো দূর করা নিয়ে ভাবতে হবে। আর ভাবনার ক্ষেত্রগুলো আরো আগ্রাসী হতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের পদ্ধতিগুলো আরো সহজ করা দরকার। বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রগুলো আরো স্বচ্ছ হতে হবে। সব মিলিয়ে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে দেশটিকে আরো বুঝতে পারার প্রয়োজন। তাদের কৌশলগত অগ্রাধিকারগুলোকে আরো ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে। দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বা যোগাযোগের একটা বহুমাত্রিকতা আছে। এ বিষয়গুলো আমাদের অনুধাবন করতে হবে। সব মিলিয়ে আমরা সমন্বিত ব্যবস্থা তৈরি করতে পারি। তাহলে বিদ্যমান সম্পর্কের চেয়েও বহুগুণ বড় অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্ভব।