বাংলাদেশে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ২০১৪ সালে। বর্তমানে সেই এজেন্ট ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দেড় কোটির বেশি। ইসলামী ব্যাংকের মতো বড় ও বিশ্বস্ত বেসরকারি ব্যাংকের সেবা মিলছে এখন প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জে। এছাড়া রাস্তার ধারে, ফুটপাতে ও অলিতে-গলিতে মিলছে ব্যাংক এশিয়া ও ডাচ বাংলা ব্যাংকের সেবা। এর মধ্যে ইউনিয়ন পর্যায়েও বেশকিছু ব্যাংকের শাখা রয়েছে। মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে এজেন্ট শাখায় আমানত জমা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। শুধু তাই নয়, গত এক বছরে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৩৪২ শতাংশ। আর আমানত বেড়েছে ১০০ শতাংশ। এছাড়া এক বছরে প্রবাসী-আয় বেড়েছে ১৫৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকগুলো এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আমানত রাখা, ঋণ বিতরণ ও প্রবাসী আয় আনার পাশাপাশি তারা স্কুল ব্যাংকিং চালু করেছে। গ্রামগঞ্জে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতাও বিতরণ করছে এজেন্টরা। সব মিলিয়ে এজেন্ট ব্যাংকিং চাঙা হওয়ার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ গ্রামীণ অর্থনীতিও চাঙা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গ্রাহকরা মোট আমানতের ৩৩.৬৭ শতাংশই রেখেছে ইসলামী ব্যাংকে। এই ব্যাংকটির এজেন্টদের সংগৃহীত আমানতের পরিমাণ ৬ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত এক বছরে নতুন করে ৫টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় এসেছে। এর ফলে মোট ২৮টি ব্যাংক এই সেবা দিচ্ছে। সারা দেশের ১৭ হাজার ১৪৫টি এজেন্ট আউটলেটের মাধ্যমে অশিক্ষিত ও কম শিক্ষিত গ্রাম পর্যায়ের মানুষরাও এখন ব্যাংকের সেবা নিচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, শুধু এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই প্রায় সোয়া কোটি গ্রাহক লেনদেন করছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা যেহেতু মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে, সে কারণে এজেন্ট শাখাগুলো মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘অন্যান্য ব্যাংকের মতো অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্টরাও ভালো করছে। আমরা সেখান থেকে ভালো আমানত পাচ্ছি। অচিরেই ঋণ দেওয়া শুরু করবো।’ জানা গেছে, বিকাশ, রকেট, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকের এজেন্টরা, এমনকি কোথাও কোথাও চাল ও ডাল ব্যবসায়ীরাও ব্যাংকগুলোর এজেন্ট নিয়ে ব্যাংকিং করছেন। অর্থাৎ, মুদি দোকানিদের হাতেও তুলে দেওয়া হয়েছে ব্যাংকের শত শত আউটলেট। এক্ষেত্রে বেশকিছু স্থানে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের মতো ঘটনা ঘটেছে।
তবে ব্যতিক্রম ইসলামী ব্যাংকের আউটলেটগুলো। এই ব্যাংকটির এজেন্ট শাখা থেকে পরিপূর্ণ ও আদর্শ ব্যাংকের আদলে গ্রাহকদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। এক কথায় গ্রাহকের অর্থের সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিচ্ছে এই ব্যাংকের এজেন্টরা। গোপন পিন ও গ্রাহকের ফিঙ্গার না মেলা পর্যন্ত অ্যাকাউন্টের টাকা তোলা যায় না। ফলে এজেন্ট বা ব্যাংকের কোনও কর্মকর্তা ইচ্ছে করলেও গ্রাহকের অ্যাকাউন্টের টাকা তুলতে পারেন না। অন্য ব্যাংকগুলোর চেয়ে ইসলামী ব্যাংকের আরেকটি বিষয়ে ব্যতিক্রম আছে। তা হলো, অন্য ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেট চলে একজনের তত্ত্বাবধানে। সেখানে ইসলামী ব্যাংকের আউটলেটগুলোতে গড়ে ৫ থেকে ৬ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। কোথাও কোথাও সাত জন বা আট জন মিলে আউটলেট পরিচালনা করছেন। এর ফলে অন্তত সারা দেশে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ১৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা বলেন, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজন যাতে ব্যাংকিং সেবা পেতে পারেন, সেজন্য বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট শাখা বিস্তৃত হয়েছে। এজেন্ট আউটলেট থেকে চেক ও কার্ড ছাড়াই লেনদেন করা যাচ্ছে।’ তিনি জানান, গ্রাহকরা ইসলামী ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে স্বস্তিবোধ করেন। এছাড়া দীর্ঘদিনের আস্থা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় ডিপোজিট সংগ্রহের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সর্বস্তরের মানুষকে ব্যাংকিং সেবায় টানতে ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি দেশে চালু হয়েছিল নতুন ধাঁচের এই ব্যাংকিং সেবা, যার নাম এজেন্ট ব্যাংকিং। মাত্র সাড়ে সাত বছরে এই সেবার গ্রাহক বেড়ে বর্তমানে এক কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার ৩৫৮ জনে পৌঁছেছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, কেউ বাড়ির পাশে সেবা পাওয়ায়, আবার কেউ সঞ্চয়ের জন্য এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে হিসাব খুলেছেন। পাশাপাশি প্রবাসী আয় তথা রেমিট্যান্স আনার পরিমাণও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন মাসের শেষে এজেন্টদের মাধ্যমে প্রবাসী আয় এসেছিল ২৬ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, চলতি বছরের জুনে তা বেড়ে হয়েছে ৬৭ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ, গত এক বছরে প্রবাসী আয় বেড়েছে ১৫৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জুন মাসের শেষে দেশব্যাপী পাড়া-মহল্লা ও হাটবাজারে ১৭ হাজার ১৪৫টির বেশি এজেন্ট রয়েছে। অর্থাৎ, এক বছরে আউটলেটের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩৭ শতাংশ। গত বছরের জুনে আউটলেট ছিল ১২ হাজার ৪৪৯টি। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত নতুন এই ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে সোয়া কোটি গ্রাহক হিসাব খুলেছেন। সেপ্টেম্বরের শেষে এই সংখ্যা দেড় কোটির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বলে জানান ব্যাংক কর্মকর্তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে নারীদের হিসাবের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫৬ লাখ ৭৫ হাজার ৩২৯, গত বছরের জুনে যা ছিল ৩৪ লাখ ১০ হাজার ২৭০টি। আবার চলতি বছরের জুন মাসের তথ্যানুযায়ী, মোট সোয়া কোটি হিসাবের মধ্যে গ্রামীণ হিসাবই এক কোটি ৫ লাখ ৩৯ হাজার ১৬৩টি। গত বছরের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ৬৩ লাখ ৭৭ হাজার ৪৫৭। অর্থাৎ, এক বছরে গ্রামীণ মানুষের হিসাব বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত এক বছরে আমানত বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অর্থাৎ, গত বছরের জুনে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে আমানত ছিল ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা। এ বছরের জুনের শেষে এটি বেড়ে হয়েছে ২০ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। এছাড়া জুন পর্যন্ত ঋণ বিতরণ হয়েছে ৩ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা, গত বছরের জুনে যা ছিল ৭২০ কোটি টাকা।