মা-ইলিশের প্রজনন নিরাপদ করার লক্ষ্যে প্রতি বছরের মতো এবারো আশ্বিনের অমাবস্যা ও পূর্ণিমা মাঝে রেখে ২২ দিনের জন্য ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। আজ সোমবার ( রোববার দিবাগত রাত ১২টা) থেকে শুরু হয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের জারি করা এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে ইলিশ ধরা, কেনা-বেচা, মজুদ ও পরিবহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক মো. আনিছুর রহমান তালুকদার বলেন, ৮০ ভাগ মা-ইলিশ ডিম দেয় আশ্বিনের অমাবস্যা ও পূর্ণিমায়। প্রজনন নিরাপদ করতে আজ রাত ১২টা থেকে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে। এছাড়া অন্য মাছ আহরণের অজুহাতে নদীতে নেমে কেউ যেন ইলিশ ধরতে না পারে, সেজন্য নদীতে জেলে নৌকা নামতে দেয়া হবে না। এজন্য কোস্টগার্ড, নৌপুলিশ ও জেলেদের সমন্বয়ে ফিশগার্ড গঠন করা হয়েছে। এর সদস্যরা ২২ দিন নদ-নদীগুলো পাহারা দেবেন। এ কার্যক্রমে অংশ নিতে বিভিন্ন জেলা থেকে ২১ জন মৎস্য কর্মকর্তাকে ২২ দিনের জন্য বরিশাল বিভাগে পদায়ন করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা কার্যক্রম তদারকিতে তিনটি মনিটরিং টিমও গঠন করেছে মৎস্য অধিদপ্তর। এদিকে নিষেধাজ্ঞা শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে দেশের ইলিশের প্রধান দুই বাজার বরিশাল ও চাঁদপুরে নেই পর্যাপ্ত জোগান। মাছের দামও বাড়তি। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে ইলিশের দাম চলে যাওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন ভারতে রফতানির কথা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের মৌসুমের শুরু থেকেই নদ-নদীতে ইলিশ সংকট ছিল প্রকট। সংকট নিয়েই ১ জুলাই ইলিশ মৌসুম শুরু হয়। বরিশালের ছয় জেলার নদ-নদী ও সংলগ্ন সাগরে এবার গত বছরের চেয়ে অনেক কম ইলিশ ধরা পড়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয় জানিয়েছে, ১ জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বরিশাল বিভাগের মোকামগুলোতে মোট ৩৭ হাজার ১৩৮ টন ইলিশ কেনা-বেচা হয়েছে। গত বছর একই সময়ে এ পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৯৪৭ টন।
দক্ষিণের নদ-নদীতে ইলিশ কম পাওয়া প্রসঙ্গে চাঁদপুর ইলিশ গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিছুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন, নদ-নদীর নাব্য কমে যাওয়া ও নদীদূষণের কারণে সাগর থেকে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে ইলিশ আসার পরিমাণ দুই বছর ধরে কমছে। এ বছর পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। জেলেদের নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারও এর জন্য দায়ী। ইলিশ সম্পদ বাঁচাতে এ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে নতুন পদক্ষেপ নেয়ার ওপর জোর দেন তিনি।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে গত বছর ভারতে রফতানি হয়েছে ৮০৫ টন ইলিশ। সেখানে এবার রফতানি হচ্ছে ২ হাজার ৮০ টন। ফলে স্বভাবতই স্থানীয় বাজারে মাছের জোগান কম। যেটুক আছে তারও দাম আকাশচুম্বী। সপ্তাহের শুরুতে বরিশালের মোকামে এলসি সাইজ ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রামের ইলিশের দাম ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা। ১ কেজি সাইজের ইলিশ ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০, ১ কেজির ওপরের ইলিশ ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
একই অবস্থা চাঁদপুরেও। আধা কেজি ওজনের ইলিশ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এক কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকায়। দাম বেশি হলেও ইলিশ কিনতে ঘাটে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় ছিল। তবে দাম নাগালের বাইরে থাকায় অনেককে খালি হাতেও ফিরতে হয়েছে। চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শবে বরাত সরকার জানান, ১ কেজি সাইজের পদ্মা-মেঘনার ইলিশের দাম ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এ ইলিশের দাম ছিল ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। সে হিসেবে এবার ইলিশের বাজারে আগুন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মা-ইলিশ রক্ষা অভিযান আরো ১০ দিন পর শুরু করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এবার প্রয়োজনের চেয়ে বেশিদিন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে বলে মনে করেন তারা।
গত বছর ১৪ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ ছিল। এ ব্যাপারে ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলেন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভায় দীর্ঘ আলোচনার পর এ বছর সময় এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তিনি জানান, ৬ অক্টোবর অমাবস্যা ও ২০ অক্টোবর পূর্ণিমাকে ঘিরে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। চাঁদপুর সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুদীপ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, অভিযান বাস্তবায়নে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে তাদের। এ ২২ দিন চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা নদীর মতলব উত্তরের ষাটনল থেকে হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী পর্যন্ত অভয়াশ্রম এলাকার মা-ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকবে।
বরগুনায় ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে আজ: বাসস জানায়, জেলায় আজ সোমবার থেকে মাছ ধরায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ইলিশ মাছ ধরা, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, বিতরণ, মজুদ নিষিদ্ধ থাকবে। এ কারণে বরগুনাসহ উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ইলিশের দাম বেড়ে গেছে। মাছ বাজারগুলোতে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটায় ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ। বাজারের মাছ বিক্রেতারা জানান, সাগরে মাছ ধরার ওপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণে বাজারে মাছ কেনার জন্য ভিড় করছেন ক্রেতারা। বর্তমানে দেড় কেজি ওজনের ইলিশের প্রতি কেজি ১৭ থেকে ১৮শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই সাইজের ইলিশ আগে বিক্রি হতো ১২শ টাকা দরে। ছোট ইলিশের দাম সব সময় ওঠা-নামা করে। তারা আরও জানান, বিগত দিনে মাছ ধরা নিষিদ্ধ সময়ে বাজারে মাছের সংকট থাকায় এ বছর পছন্দ অনুযায়ী মাছ কিনে মজুদ করছেন ক্রেতারা। মাছের চাহিদা বেশি থাকার কারণে দামটা আগের তুলনায় একটু বেশি।
মৎস্য বিভাগ জানায়, বঙ্গোপসাগরে ও নদীতে ইলিশের প্রজনন বাড়াতে প্রতি বছর আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে ও পরে মোট ২২ দিন দেশের নদী ও সাগরে মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়। এর পরও মার্চ-এপ্রিলে ৫টি, নভেম্বর-ডিসেম্বরে ১টি অভয়াশ্রমে ২ মাস করে এবং গভীর সাগরে ৬৫টি দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়।
বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব জানান, মা ইলিশের প্রজনন বাড়ানোর লক্ষ্যে আমরা সচেতনমূলক মাইকিং, ব্যানার, ফেস্টুন লাগানোর পর থেকেই সাধারণ মানুষ মাছ কিনতে শুরু করেছে নিষেধাজ্ঞার আগে। এতে করে মাছের দাম বেড়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর ইলিশের দাম ক্রেতার নাগালে রয়েছে।