শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৮ পূর্বাহ্ন

আল্লাহ স্বমহিমায় প্রভাবশালী

জাফর আহমাদ:
  • আপডেট সময় বুধবার, ৬ অক্টোবর, ২০২১

অহঙ্কারী মনে করে তার ওপর জোর খাটানোর কেউ নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘সে মনে করে রেখেছে, তার ওপর জোর খাটাতে পারবে না’ (সূরা আল বালাদ-৫)। অর্থাৎ শুধু অহঙ্কারীরা মনে করে সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দুনিয়ায় সে যা ইচ্ছা করে যাবে, তাকে পাকড়াও করার ও তার মাথা নিচু করানোর মতো কোনো উচ্চতর কর্তৃপক্ষ নেই। অথচ আখিরাত আসার আগে এই দুনিয়াতেই সে প্রতি মুহূর্তে দেখছে, তার তাকদিরের ওপর অন্য একজনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। তার সিদ্ধান্তের সামনে তার নিজের সব জারিজুরি, কলাকৌশল পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। ভূমিকম্পের একটি ধাক্কা, ঘূর্ণিঝড়ের একটি আঘাত এবং নদী-সাগরের একটি জলোচ্ছ্বাস তাকে এ কথা বলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট যে, আল্লাহর শক্তির তুলনায় সে কতটুকু ক্ষমতা রাখে। একটি আকস্মিক দুর্ঘটনা একজন সুস্থ সবল সক্ষম মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে পঙ্গু করে দিয়ে যায়। ভাগ্যের একটি পরিবর্তন একটি প্রবল পরাক্রান্ত বিপুল ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী ব্যক্তিকে আকাশ থেকে পাতালে নিক্ষেপ করে। উন্নতির উচ্চতর শিখরে অবস্থানকারী জাতিদের ভাগ্য যখন পরিবর্তিত হয় তখন এই দুনিয়ায় যেখানে তাদের চোখে চোখ মেলানোর হিম্মত কারোর ছিল না সেখানে তারা লাঞ্ছিত ও পদদলিত হয়। সুতরাং অহঙ্কারীর মাথায় কেমন করে এ কথা স্থান পেলো যে, তার ওপর জোর খাটবে না।
অহঙ্কারী কি জানে না, প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী অপ্রতিদ্বন্দ্বী নমরুদ জুতার বাড়ি খেতে খেতে তার দুনিয়ার লীলা সাঙ্গ হয়েছিল। অহঙ্কারী কি এ-ও জানে না যে, সেই ল্যাংড়া মশা আছে এবং মশার মালিকও আছেন। এটা সময়ের কোনো না কোনো নমরুদের নাকের পথ ধরে কখন যে তাদের মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ে এবং তাদের অহমিকাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। ফিরাউনের সেই নীলনদ আছে, পৃথিবীর দেশে দেশে আরো কত শত নীলনদের মতোই নদ-নদী-সাগর রয়েছে আধুনিককালের ফিরাউনদের জন্য। কিভাবে কখন যে কার সলিল সমাধি ঘটে কেউ জানে না। করোনাভাইরাস আধুনিককালের নমরুদ ও ফিরাউনদের ভ্রষ্টনীতি ও বিভ্রান্তিমূলক সিদ্ধান্তের কুফল হতে পারে। আল্লাহই ভালো জানেন। তবে পৃথিবীর ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর ইতিহাস সাক্ষী যে, জুলুম ও ক্ষমতার গর্বই ছিল তাদের ধ্বংসের মূল কারণ।
এই অহঙ্কারীদের অনেকেই ধন-সম্পদের গর্বে মত্ত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সে বলে, আমি প্রচুর ধনসম্পদ উড়িয়ে দিয়েছি’(সূরা বালাদ-৬)। তারা ধনসম্পদের প্রাচুর্যে কী পরিমাণ গর্বিত। বিভিন্ন আজেবাজে কাজে সম্পদ ব্যয় করে একমাত্র নিজেদের ধনাঢ্যতার প্রদর্শনী এবং নিজের অহঙ্কার ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করার জন্য। দূর-দূরান্তে এ কথা ছড়িয়ে পড়বে যে, অমুক ধনীর দানশীলতার তুলনা নেই। এগুলো জাহেলিয়াতের সম্পদশালীদের কর্মনীতির সাথে হুবহু মিল রয়েছে।
গর্ব-অহঙ্কার মূলত শয়তানের বৈশিষ্ট্য। সূরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি ফেরেশতাদেরকে বলেছিলাম, আদমকে সেজদা করো। সবাই সেজদা করল। কেবল ইবলিশ করল না। সে অস্বীকার ও অহঙ্কার করল। সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ সূরা আরাফে বলা হয়েছে, ‘ইবলিশ বলল, আমি তার চেয়ে উত্তম, আপনি আমাকে আগুন থেকে এবং তাকে (আদমকে) মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন।’ অর্থাৎ তার মধ্যে বর্ণবাদের অহঙ্কার ও বিদ্বেষ দানা বেঁধে উঠেছিল। ফলে সে-ই পৃথিবীর প্রথম নিকৃষ্ট কীট, যে আল্লাহর আদেশকে অমান্য করল এবং তাঁর লানত নিয়ে কিয়ামততক তাকে বেঁচে থাকতে হবে। যুগে যুগে এ তাগুতের অনুসারীরাই অহঙ্কারী ছিল। এদের কেউ কেউ ক্ষমতার দাপটে, কেউ বা আবার ধন-দৌলতের আধিক্যে অহঙ্কারী ছিল। এদের মধ্যে ফিরাউন ও কারুন অন্যতম। আল্লাহ তায়ালা এসব অহঙ্কারীকে ধ্বংস করে দেন। এ ছাড়া আল কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী ধ্বংসের কারণগুলোর মধ্যে অহঙ্কার একটি অন্যতম কারণ ছিল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের ওপর আমার আজাব অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাতের বেলায় অথবা দিনের বেলা যখন তারা বিশ্রামরত ছিল। আর যখন আমার আজাব তাদের ওপর আপতিত হয়েছিল তখন তাদের মুখে এ ছাড়া আর কোনো কথাই ছিল না যে, ‘সত্যিই আমরা জালেম ছিলাম’ (সূরা আল আরাফ : ৪-৫)।
কুরআন ও হাদিসের অসংখ্য আয়াতে গর্ব-অহঙ্কারের ভয়াবহ পরিণাম ও পরিণতির কথা বিবৃত হয়েছে এবং অত্যন্ত কঠিন ভাষায় হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। ইমাম আযযাহাবি রহ: তার ‘কিতাবুল কাবায়ির’-এ এটিকে কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অহঙ্কার শুধু একটি কবিরা গুনাহই নয় বরং এটি আরো অনেক কবিরা গুনাহের জন্মদাতা। কারণ এটি মানুষকে সত্য উপলব্ধিতে বাধা দেয় এবং তাদেরকে অন্ধকারের যাত্রী বানায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এক ইলাহই তোমাদের আল্লাহ। কিন্তু যারা আখিরাত মানে না তাদের অন্তর সত্যবিমুখ এবং তারা অহঙ্কারে ডুবে গেছে’ (সূরা নাহল-২২)। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘কোনো প্রকার অধিকার ছাড়াই যারা পৃথিবীতে অহঙ্কার করে বেড়ায়, শিগগিরই আমার নিদর্শনসমূহ থেকে আমি তাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেবো। তারা আমার কোনো নিদর্শন দেখলেও তার প্রতি ঈমান আনবে না। তাদের সামনে যদি সোজা পথ এসে যায় তাহলেও তারা তা গ্রহণ করবে না। আর যদি বাঁকা পথ দেখতে পায় তাহলে তার ওপর চলতে আরম্ভ করবে’ (সূরা আরাফ-১৪৬)।
অহঙ্কার মানে নিজেকে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা, অন্যদেরকে নিজের তুলনা ক্ষুদ্র ও অধম জ্ঞান করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে তাঁর অবাধ্য হওয়া ও আদেশ অমান্য করাÑ এ সবই অহঙ্কারের লক্ষণ ও তার আওতাভুক্ত (কবিরা গুনাহ-ইমাম আযযাহাবি রহ:) । অহঙ্কারীর শাস্তি সম্পর্কে উল্লিখিত আয়াত ছাড়াও আরো একাধিক আয়াতে কঠিন বর্ণনা রয়েছে। অহঙ্কারী সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা:-এর অসংখ্য হাদিসও রয়েছে। রাসূল সা: বলেছেন, ‘অহঙ্কারী স্বৈরাচারীদেরকে কিয়ামতের দিন ক্ষুদ্র কণার আকৃতিতে উঠানো হবে। লোকেরা তাদেরকে পায়ের তলায় পিষ্ট করবে এবং চারদিক থেকে তাদের ওপর শুধু লাঞ্ছনা ও অপমানই আসতে থাকবে। তাদেরকে জাহান্নামের বোলাস নামক কারাগারে নিয়ে যাওয়া হবে। তাদের মাথার ওপর আগুন জ্বলতে থাকবে এবং তাদেরকে জাহান্নামবাসীর মলমূত্র, ঘাম, কাশি ইত্যাদি খেতে দেয়া হবে’ (সুনানে নাসায়ি, জামে আত তিরমিজি)। রাসূল সা: আরো বলেন, ‘যার অন্তরে কণা পরিমাণও অহঙ্কার আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (সহিহ মুসলিম)।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com