দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের সহায়তার জন্য দুটি তহবিল রয়েছে। এগুলো হলো শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিল এবং বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন। এখন পর্যন্ত এ দুটি তহবিলে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ৮০০ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু নিয়মের বেড়াজালে আটকে এসব তহবিল থেকে কোনো সহায়তা পান না সাধারণ শ্রমিকরা। এমনকি করোনা ভাইরাসজনিত মহামারী চলাকালেও কর্মহীন সাধারণ শ্রমিকদের কোনো কাজে আসেনি এসব তহবিল। স¤প্রতি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটিতে দেয়া এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সংসদীয় কমিটি করোনাকালে কেন্দ্রীয় তহবিল ও বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সাধারণ শ্রমিকদের কল্যাণে কী কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা জানতে চেয়ে সুপারিশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংসদীয় কমিটিতে একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কেন্দ্রীয় তহবিল ও বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের বিধিতে করোনাকালে সাধারণ শ্রমিকদের অর্থ সহায়তা দেয়ার কোনো বিধান নেই। তবে এ সময় ফাউন্ডেশনের অর্থে পরিচালিত শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসারের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবাসহ স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়েছে। এছাড়া শ্রমিকদের কল্যাণে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে নিয়মিত আর্থিক সহায়তা দেয়া হয় বলেও উল্লেখ করা হয়। করোনাকালে কোনো শ্রমিক মারা গেলে তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাবে কেন্দ্রীয় তহবিলে অর্থ পাঠানোর কথাও জানায় মন্ত্রণালয়।
আইন অনুযায়ী দেশে সক্রিয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কর্মকা-ের মাধ্যমে অর্জিত মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করতে হয়। আর লভ্যাংশের একটি নির্দিষ্ট অংশ সরকারের বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে জমা দিতে হয়। এ প্রক্রিয়ার ২১৫ কোম্পানির তহবিলে জমা অর্থের পরিমাণ ৫৯১ কোটি টাকারও বেশি। শ্রমিকদের কল্যাণে এ অর্থ সংগ্রহ করা হলেও বিধিবিধানের কারণে কভিড-১৯ মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কল্যাণে এ তহবিল ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় তহবিলের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার কবলে পড়লে বা পেশাগত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে বা পেশাগত কারণে কাজ করতে অক্ষম হয়ে গেলে সুবিধাভোগী কল্যাণ তহবিল থেকে তার পরিবারকে ২ লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়। একই পরিমাণ অর্থ পান কেউ চাকরিরত অবস্থায় অসুস্থ হয়ে বা দুর্ঘটনায় মারা গেলে বা অক্ষম হলে। এছাড়া অসুস্থ শ্রমিকদের চিকিৎসায়, পরিবারের মেধাবী সন্তানদের শিক্ষার জন্য বৃত্তি দিতেও এ তহবিলের অর্থ ব্যবহার করা হয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন, ২০০৬ অনুযায়ী এ তহবিল থেকে শিক্ষাবৃত্তি, যৌথ বীমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, চিকিৎসায় সহায়তা, কোনো শ্রমিক মারা গেলে দাফন বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য সহায়তা, অক্ষম শ্রমিককে সহায়তা, দুর্ঘটনায় মৃত শ্রমিকের পরিবারকে সাহায্য করা ও মাতৃত্ব কল্যাণ খাতে সহায়তা করা হয়। দুটি তহবিলের কোনোটিতেই বেকার বা কাজ হারানো সাধারণ শ্রমিকদের সহায়তার ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করা নেই। ফলে মহামারীকালে তীব্র অর্থকষ্টে ভোগা শ্রমিকদের কোনো কাজে আসেনি এসব তহবিল।
বাংলাদেশের শ্রম আইন-২০০৬-এ শ্রমিক কল্যাণে প্রতিষ্ঠানের মুনাফার ৫ শতাংশ অর্থ ব্যয়ের নির্দেশনা ছিল। তবে তা বাস্তবায়নে সরকারি নজরদারির সুনির্দিষ্ট কোনো ধারা ছিল না। এছাড়া আইন বাস্তবায়নে বিধিমালা না থাকায় তা কার্যকরের বিষয়ে কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি। ২০১৩ সালে আইন সংশোধনের পর সরকারি তহবিলে অর্থ জমা দেয়াসহ আইন প্রতিপালনে বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। আর বিধিমালা হওয়ার পর এ তৎপরতা আরো বেড়ে যায়। সরকারের তৎপরতা ও আইন সম্পর্কে সচেতন হওয়ায় এ তহবিলের আকার ক্রমেই বাড়তে থাকে। এছাড়া বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আইন সম্পর্কে সচেতন হওয়ায় এ তহবিলে নিয়মিত অর্থ জমা পড়ছে। পাশাপাশি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও আইন অনুসরণ করে নিয়মিত না হলেও তহবিলে অর্থ জমা দিচ্ছে। এ ধারাবাহিকতায় তহবিলটির বর্তমান স্থিতি ৬১১ কোটি টাকা। আর কেন্দ্রীয় তহবিলের বর্তমান স্থিতি ১০৬ কোটি টাকা। এসব তহবিলের অর্থ আবেদনের ভিত্তিতে শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করা হচ্ছে, দেয়া হচ্ছে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণও। এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৮২৩ জন শ্রমিককে ১৩ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়ার উদ্যোগের কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কিন্তু কেবল নিয়ম না থাকায় কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য তহবিলের অর্থ ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ১০০ টাকা মুনাফার বিপরীতে ৫ টাকা শ্রমিক কল্যাণে ব্যয়ের বাধ্যবাধকতা ছিল। অর্থাৎ শ্রম কল্যাণে প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ তহবিলে ৫ টাকার ৮০ শতাংশ (৪ টাকা) শ্রমিকদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়ার পর বাকি ২০ শতাংশ (১ টাকা) শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে জমা রাখার কথা। তবে সংশোধিত ২০১৩ সালের আইন অনুযায়ী ৫ টাকার ৮০ শতাংশ অংশগ্রহণ তহবিলে দেয়ার পাশাপাশি ১০ শতাংশ (দশমিক ৫০ টাকা) সরকারের বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে ও বাকি ১০ শতাংশ (দশমিক ৫০ টাকা) কল্যাণ তহবিলে রাখতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে সংশোধিত আইনে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের যে আইন ও বিধি আছে, তা অনুসরণ করে বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সহায়তা করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ তহবিল থেকে সরাসরি শ্রমিকের হাতে অর্থ পৌঁছে দিতে গেলে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সে কারণেই মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে পারেনি এ তহবিল দুটি। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বেকার ও কাজ হারানো শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে তহবিলের নিয়মে কোনো পরিবর্তন আনা যায় কিনা, সেটি খতিয়ে দেখতে বলছেন শ্রমিক কল্যাণে কর্মরত সংগঠনগুলোর সদস্যরা।