দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বর্তমানে নানামুখী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হচ্ছে। ঢাকায় যানজট নিরসনে মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে। স্থলপথের দূরত্ব কমাতে চট্টগ্রামে নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মপরিধি বাড়াতে নির্মাণ করা হচ্ছে পদ্মা বহুমুখী সেতু। এছাড়া আরো অনেক ছোট, বড় ও মেগা প্রকল্পের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। এর বিপরীতে জ্বালানি খাতের সংকট নিরসনে স্থায়ী সমাধান বা সুনির্দিষ্ট পথ খুঁজে বের করার উদ্যোগ সে তুলনায় কমই দেখা গিয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক কালে এ নিয়ে কিছু কর্মতৎপরতা দেখা যাচ্ছে। সিলেটের জকিগঞ্জে দেশের ২৮তম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের বড় একটি মজুদ রয়েছে। এছাড়া গ্যাস অনুসন্ধানে ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে বাপেক্স। তবে এ মুহূর্তে প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি হলেও এর সুফল পেতে সময় লাগবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের গ্যাস উত্তোলন পরিস্থিতি এরই মধ্যে বেশ নাজুক অবস্থায় চলে গিয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চার-পাঁচ বছর আগেও দেশে দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ছিল ২৭০ কোটি ঘনফুট। এখন তা কমে ২৪০ কোটি ঘনফুটে নেমে এসেছে। পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত দেশে গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার হয়েছে (জকিগঞ্জ-১ গ্যাসক্ষেত্র বাদে) ২৮ দশমিক ২৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। এর মধ্যে নিশ্চিতভাবে উত্তোলনযোগ্য সাড়ে ২১ টিসিএফ। সম্ভাব্য উত্তোলনযোগ্য ৬ দশমিক ৭৯ টিসিএফ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত উত্তোলন হয়েছে মধ্যে ১৮ দশমিক ২৪ টিসিএফ। সে হিসেবে বর্তমানে গ্যাসের নিশ্চিতকৃত ও সম্ভাব্য মিলিয়ে উত্তোলনযোগ্য মজুদ রয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৫ টিসিএফ, যা এক দশকের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। আমদানিনির্ভরতাই জ্বালানি খাতের এ সংকটকে প্রকট করে তুলেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, দেশে শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানি সংস্থানে স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলন গুরুত্ব পাচ্ছে কম। সহজ পথ হিসেবে আমদানির ওপরই নির্ভর করা হচ্ছে বেশি। এছাড়া গ্যাস উত্তোলনে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগও তেমন একটা টানা যায়নি। এরই ফলাফল হিসেবে বর্তমানে শিল্প, বিদ্যুৎ, পরিবহনসহ নানা খাতে গ্যাস সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামীতেও দেশে শিল্প-কারখানা আমদানীকৃত গ্যাস দিয়েই পরিচালনা করা হবে। কারখানা, বিদ্যুৎ, পরিবহনসহ জ্বালানিনির্ভর বিভিন্ন খাতে আমদানীকৃত এলএনজির ব্যবহার বাড়ানো হবে।
বিশ্ববাজারের বর্তমান অস্থিরতা জ্বালানি সংস্থানে আমদানিনির্ভরতার বিড়ম্বনাকেই প্রকট করে তুলেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, স্থানীয়ভাবে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেয়া না হলে তা অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দেবে। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, আমদানিনির্ভরতা কখনই একটি দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণের নির্ভরযোগ্য পথ হতে পারে না। কারণ এলএনজির মতো জ্বালানি পণ্যের দাম কখনই বিশ্ববাজারে স্থিতিশীল নয়। ফলে এ ধরনের জ্বালানি নিয়ে বৃহদায়তনের পরিকল্পনা গড়ে তোলাও ঝুঁকিপূর্ণ। বছরের পর বছর ধরে আমরা বলছি, আমাদের দেশে গ্যাস প্রাপ্তির বহু সম্ভাবনা রয়েছে। অফশোর-অনশোরে বিস্তৃত আকারে অনুসন্ধান প্রয়োজন। কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। গত ২০ বছরে শুধু গ্যাস ব্যবহারই করে গিয়েছি। নতুন করে গ্যাস সরবরাহের স্থায়ী কোনো পথ খুঁজে বের করতে পারিনি। জ্বালানি খাতের বর্তমান সমস্যাটি একদিনে হয়নি বলে অভিমত রয়েছে। এ বিষয়ে পর্যবেক্ষকদের মূল্যায়ন, দীর্ঘদিন খাতটিতে বিনিয়োগ বাড়াতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অবকাঠামোয় গ্যাস-বিদ্যুতের গুরুত্ব সমান। বর্তমানে দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের অর্ধেকেরও বেশি আসছে গ্যাস থেকে। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতকে এগিয়ে নেয়া হলেও অবহেলিত থেকে গিয়েছে জ্বালানি খাত। ক্রমবর্ধমান হারে গ্যাসের ব্যবহার ও চাহিদা বাড়লেও গত ২০ বছরে এ খাতে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন হয়নি।
দেশের গভীর-অগভীর সমুদ্র অঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধান ক্ষেত্রগুলোকে ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে গভীর সমুদ্রে ১৩টি ও অগভীর সমুদ্রে ১৩টি ব্লক রয়েছে। এসব ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে জরিপ প্রয়োজন। সাগরের খনিজ সম্পদ সম্পর্কে ধারণা পেতে জরিপের জন্য কয়েকবার আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হলেও তা শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়েছে। যদিও প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার তাদের অফশোর-অনশোরে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। দেশীয় গ্যাস কূপগুলোর উন্নয়নে তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে ওয়েলহেড কম্প্রেসার বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১৪ সালে। প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশনা থাকলেও গত সাত বছরে তা শেষ করা যায়নি। ২০১০ সালের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতে বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করা গেলেও জ্বালানি খাতে তা করা যায়নি। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে দেশে রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, পটুয়াখালীর পায়রায় একই সক্ষমতার আরো একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রসহ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে কর্মপরিধি বাড়বে এমন সম্ভাবনা থেকেই এসব বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু জ্বালানি খাতের অবকাঠামোয় এখনো বড় ধরনের কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। জ্বালানি খাতের অবকাঠামো উন্নয়নে ২০১৭ সালে এলএনজি আমদানির জন্য দুটি ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) নির্মাণ করা হয়। এর বাইরে মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে এলএনজি টার্মিনালের উদ্যোগ নেয়া হলেও আজ অবধি এর ঠিকাদার নির্বাচন করা যায়নি। গত পাঁচ-ছয় বছরে প্রকল্পটি নিয়ে অনেক কথাবার্তা হলেও তা খুব বেশি এগোয়নি।
বিদেশী কোম্পানিগুলো নানা সময়ে জ্বালানি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করলেও পেট্রোবাংলা সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। সাগরে জ্বালানি তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে নেয়া একাধিক উদ্যোগ বারবার টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আটকে গেছে। কয়েকটি প্রকল্প ঝুলে রয়েছে এক দশক ধরে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জ্বালানি খাতে। যদিও জ্বালানি বিভাগ দাবি করছে, সাগরের সম্পদ আহরণে বর্তমানে কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, জ্বালানি খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে নানামুখী সংকট ছিল। হয়তো থাকবেও। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বড় একটি সময় আমরা হারিয়ে ফেলেছি। গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনে স্থানীয় কোম্পানি বাপেক্সকে দীর্ঘ সময় ধরে বসিয়ে রেখেছি। কিন্তু বাপেক্সের যে সক্ষমতা রয়েছে, সম্প্রতি বেশকিছু কাজে তার প্রমাণ মিলেছে। তবে এতদিন জ্বালানি নিয়ে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়ন না হলেও এখন বাস্তবায়ন হচ্ছে। বাপেক্সের কর্মপরিধি বাড়াতে দেশব্যাপী অনুসন্ধানের কার্যক্রম বিস্তৃত করা হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে হয়তো গ্যাস সংকট কমে আসবে।
বিশ্বব্যাপী জ্বালানি পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল। সব ধরনের জ্বালানি পণ্যের ক্রমাগত দরবৃদ্ধিতে সংকটে পড়েছে বিভিন্ন দেশ। এ দুর্বিপাকের বাইরে নয় বাংলাদেশও। দেশে এখন জ্বালানি পণ্যের, বিশেষ করে গ্যাস সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। স্থানীয় পর্যায়ে উত্তোলিত গ্যাস সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ায় উচ্চমূল্যে আমদানির মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বিদ্যমান খনিগুলোর মজুদ নিয়েও রয়েছে উদ্বেগ। এখন পর্যন্ত যেটুকু মজুদ আবিষ্কার হয়েছে, সেটিও ফুরিয়ে আসবে শিগগিরই। যদিও দুই দশক আগেও বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর ভাসছে। সে সময় দেশের খনিজ তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের সম্ভাবনা থেকে এমন বক্তব্য উঠে এসেছিল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয় গ্যাসসম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশের শিল্প-কারখানা ও ব্যবসায়িক কর্মপরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। কিন্তু গত দুই দশকে এ বক্তব্যের বাস্তব কোনো প্রতিফলন কোথাও চোখে পড়েনি। এ সময় দেশের শিল্প ও বিদ্যুৎ খাত এগিয়েছে মূলত আমদানীকৃত গ্যাসের ওপর ভর করে।