শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:১০ অপরাহ্ন

রাসূল সা: প্রতি ভালোবাসা

ড. মো: আবদুল কাদের:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২২ অক্টোবর, ২০২১

রাসূলুল্লাহ সা:কে ভালোবাসা ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির ওপর তাঁকে ভালোবাসা ফরজ বা অত্যাবশ্যক। একজন মুসলিমের কর্তব্য হলো রাসূলুল্লাহ সা:কে নিজের জীবনের চেয়েও অধিক ভালোবাসা। তবে এ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ অবশ্যই রাসূলুল্লাহর অনুমোদিত ও সাহাবাগণের প্রদর্শিত পদ্ধতিতে হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি বা ছাড়াছাড়ির সুযোগ ইসলামে নেই।
ক. সর্বাধিক ভালোবাসা পাওয়ার অধিকারী : দুনিয়ার সব কিছুর ওপর রাসূলুল্লাহ সা:-এর ভালোবাসা অগ্রাধিকার পাবে। কুরআনে এসেছে, ‘বলো, তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর সে ব্যবসা যার মন্দা হওয়ার আশঙ্কা তোমরা করছ এবং সে বাসস্থান, যা তোমরা পছন্দ করছ, যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে, তবে তোমরা অপেক্ষা করো আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না’ (সূরা আত তাওবা : ২৪)। হাদিসে এসেছে, তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি রাসূলুল্লাহ তোমাদের নিকট তোমাদের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও দুনিয়ার সব মানুষের চেয়ে অধিকতর প্রিয় হবো’ (বোখারি : ১৫)।
খ. অনুকরণীয় আদর্শ : এই পৃথিবীতে অনুকরণ ও অনুসরণ এর জন্য প্রশ্নাতীতভাবে তিনি উম্মতের জন্য শ্রেষ্ঠ আদর্শ। কুরআনে এসেছে, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে’ (সূরা আল আহজাব : ২১)।
গ. কষ্ট না দেয়া : রাসূলুল্লাহ-এর জীবদ্দশা এবং ওফাতের পরে কোনো আচরণ অথবা তাঁর আদর্শ অমান্য করার মাধ্যমে তাকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। কুরআনে এসেছে, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা নবীর ঘরসমূহে প্রবেশ করো না; অবশ্য যদি তোমাদেরকে খাবারের অনুমতি দেয়া হয় তাহলে (প্রবেশ করো) খাবারের প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা না করে। আর যখন তোমাদেরকে ডাকা হবে তখন তোমরা প্রবেশ করো এবং খাবার শেষ হলে চলে যাও। আর কথাবার্তায় লিপ্ত হয়ো না; কারণ তা নবীকে কষ্ট দেয়, সে তোমাদের বিষয়ে সঙ্কোচ বোধ করে; কিন্তু আল্লাহ সত্য প্রকাশে সঙ্কোচ বোধ করেন না। আর যখন নবীপতœীদের কাছে তোমরা কোনো সামগ্রী চাইবে তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে; এটি তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্র। আর আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয়া এবং তারপর (মৃত্যুর) তাঁর স্ত্রীদের বিয়ে করা কখনো তোমাদের জন্য সঙ্গত নয়। নিশ্চয় এটি আল্লাহর কাছে গুরুতর পাপ’ (সূরা আল আহজাব : ৫৩)।
ঘ. সম্মানার্থে সালাত ও সালাম পেশ : রাসূলুল্লাহ সা:-এর জন্য দুনিয়া ঊর্ধ্ব জগতের সব প্রাণী সালাত ও সালাম পেশ করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ (ঊর্ধ্ব জগতে ফেরেশতাদের মধ্যে) নবীর প্রশংসা করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর জন্য দোয়া করে। হে মুমিনগণ, তোমরাও নবীর ওপর দরূদ পাঠ করো এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও’ (সূরা আহযাব : ৫৬)। অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায়, ইমাম বুখারি রহ: আবুল আলিয়া থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা:-এর ওপর আল্লাহর সালাত বলতে বোঝানো হয়েছে ফেরেশতাদের কাছে নবীর প্রশংসা এবং ফেরেশতাদের সালাত হলো দোয়া। আর ইমাম তিরমিজি সুফিয়ান সওরী থেকে বর্ণনা করেন যে, এখানে আল্লাহর সালাত বলতে রহমত এবং ফেরেশতাদের সালাত বলতে ইস্তেগফার বোঝানো হয়েছে (তাফসির ইবন কাসির)। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ওই ব্যক্তি ধ্বংস হোক যার কাছে আমার নাম উচ্চারিত হওয়ার পরে আমার প্রতি দরূদ পেশ করে না’ (তিরমিজি : ১৪০০)।
ঙ. আনুগত্য করা : রাসূলুল্লাহ সা:-এর ভালোবাসা প্রকাশ করতে হলে অবশ্যই তাঁর আনুগত্য করতে হবে। কোনো বিষয়ে মতবিরোধ হলে তা সমাধানের জন্য তাঁর আদর্শের শরণাপন্ন হতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর ও আনুগত্য করো রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোনো বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ করো তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ করাও- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখো। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর’ (সূরা আন নিসা : ৫৯)। অন্যত্র এসেছে, ‘আর আমি যেকোনো রাসূল প্রেরণ করেছি তা শুধু এ জন্য, যেন আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদের আনুগত্য করা হয়’ (সূরা আন নিসা : ৬৪)। শুধু তাই নয়, তাঁর আনুগত্য এর মধ্যেই রয়েছে জান্নাত লাভ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে তারা তাদের সাথে থাকবে, আল্লাহ যাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীলদের মধ্য থেকে। আর সাথী হিসেবে তারা হবে উত্তম’ (সূরা আন নিসা : ৮০)।
চ. আহ্বানে সাড়া দেয়া : ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দাও; যখন সে তোমাদের আহ্বান করে তার প্রতি, যা তোমাদেরকে জীবন দান করে। জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ মানুষ ও তার হৃদয়ের মাঝে অন্তরায় হন। আর নিশ্চয় তাঁর নিকট তোমাদের সমবেত করা হবে’ (সূরা আনফাল : ২৪)।
ছ. সুন্নাহর অনুসরণ : মানবজাতির পাথেয়রূপে তিনি সুন্নাহ বা কর্মপন্থা রেখে গিয়েছেন, যা অনুসরণের মাধ্যমে মানুষের জন্য সফলতা রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা অনুসরণ করে রাসূলের, যে উম্মী নবী; যার গুণাবলী তারা নিজদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায়, যে তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় ও বারণ করে অসৎ কাজ থেকে এবং তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে আর অপবিত্র বস্তু হারাম করে। আর তাদের থেকে বোঝা ও শৃঙ্খল- যা তাদের উপরে ছিল- অপসারণ করে। সুতরাং যারা তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং তার সাথে যে নূর নাজিল করা হয়েছে তা অনুসরণ করে তারাই সফলকাম’ (সূরা আল আরাফ : ১৫৭)। অন্য আয়াতে এসেছে, বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (সূরা আলে ইমরান : ৩১)।
রাসূলুল্লাহ সা:কে ভালোবাসার ক্ষেত্রে কোনো ঈমানদারের প্রশ্ন থাকার কথা নয়। তবে ভালোবাসার নামে সীমালঙ্ঘন করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাঁর জন্মোৎসব পালন, মানবত্ব, অদৃশ্য জ্ঞান, সর্বদা বিরাজমান, হায়াতুন্নবী (দুনিয়ার জীবনের মতো), ইত্যাদি বিষয়ে বাড়াবাড়ি করতে দেখা যায়। এই মর্মে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমরা আমার ব্যাপারে সেরূপ বাড়াবাড়ি করবে না যেমনটি খ্রিষ্টানরা মরিয়মপুত্র ঈসা সম্পর্কে করত। আচ্ছা আমি আল্লাহর বান্দা, অতএব, তোমরা বলো আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’ (বুখারি : ৩৪৪৫)। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : এক ব্যক্তি রাসূল সা:-এর সামনে এসে বলল, এ কাজটি সম্পন্ন হবে যদি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল চান। নবী সা: তাকে বললেন, তুমি কি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ বানাতে চাও? ‘মুহাম্মদ যা চান’ এ কথা বলবে না। বরং একমাত্র আল্লাহ চান এটা বলবে (নাসাঈ, সুনানুল কুবরা : ৯৪৭৩)। এরূপে তাঁর ক্ষেত্রে মহব্বত প্রকাশের জন্য নতুন কোনো আবিষ্কার অথবা অতিরঞ্জন করা ইসলামে পরিত্যাজ্য। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘ইসলামে নেই এমন কোনো আমল যদি কেউ আবিষ্কার করে, তবে তা পরিত্যাজ্য (বুখারি : ২৬৯৭)।
সর্বোপরি, তাঁর আনীত জীবনব্যবস্থা ইসলামকে সব মতাদর্শের উপরে শ্রেষ্ঠরূপে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তাঁর প্রতি পরিপূর্ণ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সম্ভব। লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com