হিংসা-বিদ্বেষ জঘন্য অপরাধ। এই ব্যাধি রয়েছে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে সর্বত্রই। বাংলাদেশে যেন হিংসার চাষ হয়। রাজনীতির অঙ্গনে বাংলাদেশে হিংসা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে এবং রীতিমতো এর পরচর্চা চলছে। বংশপরম্পরায় হিংসা-বিদ্বেষ চলমান রয়েছে এবং এর থেকে বেরিয়ে আসা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। হিংসার ফলে গুম-হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। শুধু রাজনীতি নয় পরিবারের মধ্যেও রয়েছে এই রোগ, ফলে পারিবারিক জীবনে নেই শান্তি-নিরাপত্তা-স্বস্তি। অফিস-আদালতে একটি তৃপ্তি ও আনন্দময় পরিবেশ না থাকার পেছনে কারণও হিংসা-বিদ্বেষ।
হিংসুটে ব্যক্তি অপরের কল্যাণ চায় না। সে নিজের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই ক্ষান্ত হয় না, সাথে সাথে অপরে যাতে তার সমকক্ষ বা ছাড়িয়ে না যায় সে জন্য থাকে খুব পেরেশান। হিংসুটে ব্যক্তি দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত। সে দুনিয়ায় স্বস্তি পায় না, আশপাশে সবাইকে শত্রু বিবেচনা করে সর্বক্ষণ পেরেশান থাকে যে, তার শত্রু এগিয়ে যাচ্ছে। হিংসুটে মানুষ হয় কৃপণ ও সঙ্কীর্ণমনা। আর জান্নাতে কৃপণের কোনো স্থান নেই। জান্নাত তাদেরই জন্য যারা উদারমনা ও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী। যারা সর্বদা তার ভাই-বোনের কল্যাণ চায়। আল্লাহর বাণী, যে স্বীয় মনের সঙ্কীর্ণতা থেকে নিজেকে রক্ষা করল সেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করল (সূরা তাগাবুন ১৬)।
মুসলিম জাতি হিসেবে আমরা শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। হ্যাঁ, আল্লাহও বলেন, তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে সৃষ্টিই করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য, তোমরা ভালো কাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজে নিষেধ করবে (সূরা আলে ইমরান ১১০)। আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের মূলে রয়েছে মানবজাতির কল্যাণ সাধন। যারা মানুষের অকল্যাণ করে বা অকল্যাণ কামনা করে তারা মুসলিম জনগোষ্ঠীর অংশ নয়। শয়তানের অনুসারী নিকৃষ্ট সৃষ্টি। এই অধমরাই মানুষের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করে। এরা সবসময় পরস্পরের প্রতি ঝগড়া-বিবাদ লাগিয়ে রাখে এবং সমাজে অশান্তির হোতা এরাই। এরা ভাইয়ে-ভাইয়ে ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে দেয়, জোড়ালাগা বিয়ে ভেঙে দেয়। শয়তানের এসব অনুচর সমাজের বিষতুল্য। শয়তানের এসব শিষ্যরা কত সংসার, কত পরিবারে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দেয় তার ইয়ত্তা নেই।
মিথ্যা কবিরা গুনাহ। না, শুধু এতটুকু নয়, হাদিসের ভাষায় সব পাপের মা। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, আমার উম্মতরা সব পারে, পারে না মিথ্যা বলতে ও বিশ^াসঘাতকতা করতে। পরস্পর সম্পর্ক (সেটি হতে পারে ভাইয়ে-ভাইয়ে বা স্বামী-স্ত্রীতে) জুড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে মিথ্যা বলায় কোনো গুনাহ নেই, সেটি হয়ে যায় সওয়াবের। তাহলে বুঝতে হবে সম্পর্ক বিনষ্ট করা কতো বড় গুনাহ। এ সবই করে হিংসা ও বিদ্বেষ থেকে। হিংসুটে মানুষ প্রতিশ্রুতি পালনের বাধ্যবাধকতা অনুভব করে না। অথচ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও আমানতে খেয়ানত শুধু কবিরা গুনাহ নয়, মুনাফিকের অন্যতম লক্ষণ। পূর্ব ও পশ্চিমে মুখ ফেরাও তাতে কোনো পুণ্য নেই বরং পুণ্য রয়েছে প্রতিশ্রুতি পূরণের ওপর (অন্যান্য গুণাবলির সাথে) সুরা বাকারা ১৭৭। দুর্ভাগ্য, আজ আমরা এসব গুণাবলি থেকে বঞ্চিত।
হিংসুটে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে বড় ঘৃণিত, পরিবার ও সমাজের কাছেও ঘৃণিত। সে তার গ্রহণযোগ্যতা হারায়। আল্লাহপাক সূরা ফালাকে হিংসুকের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁরই কাছে সাহায্য চাইতে বলেছেন। ফলে একজন উদারমনা ও প্রশস্ত হৃদয়ের ব্যক্তি হিংসুকের পেছনে না ছুটে আল্লাহরই কাছে ধরনা দেয়। হিংসুকের হিংসা প্রায়ই অদৃশ্য থাকে, লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে। ফলে সেটি জানতে চাওয়া, প্রমাণ খুঁজে বেড়ানো অর্থহীন, প-শ্রম। বরং ক্ষমা করে দিলে অন্তরে প্রশান্তি আসে ও বিনিময়ে আল্লাহর ক্ষমা লাভ করা যায়। মসজিদে নববীতে জনৈক সাহাবির আগমনে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘লোকটি জান্নাতি।’ এরকম পরপর তিন দিন একই ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন, ‘লোকটি জান্নাতি।’ লোকটির মাঝে এমন কী গুণ রয়েছে তা জানার জন্য একজন সাহাবি তার বাড়িতে তিন দিনের জন্য মেহমান হন। তিনি লক্ষ করেন, এমন কিছু নয়, তিনি সাধারণ মানুষের মতোই জীবনযাপন করেন। শেষে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, রাসূলুল্লাহ সা: আপনাকে পরপর তিন দিন জান্নাতি বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আমি তো এমন কোনো আমল লক্ষ করলাম না। জবাবে বলেন, আমার এমন কোনো আমল নেই তবে ঘুমানোর আগে আমি সবাইকে ক্ষমা করে দেই এবং কারো প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ রাখি না। হিংসা-বিদ্বেষ শুধু কবিরা গুনাহ নয়, মানুষের সকল নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দেয় তেমনি হিংসা মানুষের সব নেক আমল নিঃশেষ করে দেয়। হিংসুটে মানুষ আল্লাহর দরবারে আমলশূন্য অবস্থায় হাজির হবে।
জান্নাতে যাওয়ার সহজ মাধ্যম হলো মানুষকে ক্ষমা করা। প্রতিশোধ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে তবে আল্লাহর পছন্দ মানুষকে ক্ষমা করে দেয়া। যারা ক্ষমা করে দেয় তাদেরকে পুরস্কৃত করা আল্লাহর দায়িত্ব। আমাদের সমাজে ক্ষমা করে দেয়াকে দুর্বলতা ভাবা হয়। কিন্তু আল্লাহর ভাষায়, এটি একটি সাহসিকতাপূর্ণ কাজ (সূরা আশ শূরা ৪৩)। একজন মুসলিম তার হন্তাকেও ক্ষমা করতে পারে। সূরা ইয়াসিনে আল্লাহ পাক সেটিই বলেছেন। তিনজন রাসূলের প্রচেষ্টায় একজন ব্যক্তি ঈমান আনেন। ঈমান আনার পর ছুটে আসেন তার জাতির কাছে এবং ইসলামের দাওয়াত কবুলের জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু তার জাতির লোকেরা তাদের কল্যাণকামী এই ব্যক্তিটিকে হত্যা করে। সে সময়ে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, হায়! আমার জাতির লোকেরা যদি বুঝত কিসের বদৌলতে আমার রব আমাকে ক্ষমা করলেন ও সম্মানিত লোকদের মধ্যে গণ্য করলেন। কত বড় উদার ও প্রশস্ততার অধিকারী এই সদ্য ঈমান গ্রহণকারী ব্যক্তি যিনি তার হন্তার জন্যও অকল্যাণ কামনা করেননি বা অভিশাপ দেননি। হ্যাঁ, যথার্থ ঈমান মানুষকে এমন গুণেরই অধিকারী করে। এরা দুনিয়া থেকে আখিরাতকে অগ্রাধিকার দেয়।
আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করতে চান। পাহাড়সম অপরাধ নিয়েও কেউ যদি ফিরে আসে তাহলে আকাশছোঁয়া ক্ষমা নিয়ে আল্লাহ তাঁর সেই বান্দার কাছে হাজির হন এবং ক্ষমা করে নতুন জীবনের সন্ধান দেন। আল্লাহ পাক বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ করে লাইলাতুল কদরে তাঁর অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন। কিন্তু সেই ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হয় চরম হতভাগা যে মুশরিক ও হিংসুটে। হিংসুটে ব্যক্তি শুধু আল্লাহর অবাধ্যই নয়, নরাধম আল্লাহর বান্দার শত্রু এবং আল্লাহরও শত্রু। আখিরাতে জান্নাতের যারা প্রত্যাশী তাদের অবশ্যই হিংসামুক্ত ও উদার হতে হবে। উদার ও দরাজদিল ব্যক্তিদের জন্যই শুধু জান্নাত, কৃপণ, অর্থলোলুপ ও সঙ্কীর্ণদের জন্য জান্নাতে কোনো অংশ নেই। সে হতে পারে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আলেম-উলামা ও সাধারণ মানুষ সবার জন্যই সত্য। আল্লাহ পাক আমাদের হিংসামুক্ত ও প্রশস্ততার অধিকারী করুন এবং আকাশ ও পৃথিবী সমান প্রশস্ত জান্নাতে যাওয়ার সৌভাগ্যবানদের দলভুক্ত করুন। আমীন। লেখক: উপাধ্যক্ষ (অব:), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ