রবিবার, ১৬ জুন ২০২৪, ০৪:৩৮ পূর্বাহ্ন

নবী করিম সা.’এর প্রতি ভালবাসা

সাঈদ বিন দুদু মিয়া:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২১

পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি এবং সমস্ত মানুষ অপেক্ষা আমি রাসূলকে বেশি না ভালোবাসলে তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ মুমীন হতে পারব না।(সহীহ বুখারী) প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ দাবি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ও খুবই অর্থবহ। মৌলিক একটি কথা সকলেরই জানা আছে;”কাউকে ভালবাসতে নিজের যোগ্যতার প্রয়োজন নেই, তবে কারো ভালোবাসা পেতে হলে অবশ্যই যোগ্যতার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য”। তো চলুন দেখে আসি, কোন যোগ্যতা-বলে এত বড় দাবি উত্থাপন করলেন আমাদের নবী তাঁর স্নেহের উম্মতের উপর। সাধারণত মৌলিক চারটি কারণে কেউ অন্যকে ভালোবেসে থাকে।
প্রথমতঃ -রুপ-সৌন্দর্য ,যেমন বিবি জুলেখার অন্তরে ইউসুফ আলাইহিস সালামের প্রতি সম্মোহন সৃষ্টি হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত:- উত্তম চরিত্র , যেমন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাথী সঙ্গীরা মাত্র অল্প ক’দিনেই সারা বিশ্বের বহু লোকের হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন। তা শুধু সম্ভব হয়েছিল তাদের উত্তম আখলাক ও মহৎ গুণাবলীর কারণে।
তৃতীয়তঃ আত্মীয়তা ও রক্তের বন্ধন। যেমন একজন কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে ও আরেকজন শ্বেতাঙ্গ ছেলের প্রতি মায়ের সমান এবং অকৃত্রিম ভালোবাসা।
চতুর্থতঃ ইহসান তথা সদাচার, যেমন ,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে কিছু পাওয়ার আশায় কেউ আসলে তাকে কখনোই তিনি ফিরিয়ে দিতেন না। নিজের সর্বস্ব দিয়ে অন্যকে সাহায্য করতেন এবং তা পরিপূর্ণ সন্তুষ্টচিত্তে, কোন ধরনের কৃত্রিমতা তাঁর স্বভাবেই ছিলো না।
সারকথা হলো, যে সমস্ত গুণ ও মহাগুণ কারো মাঝে থাকলে অন্যে তাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসে,তার প্রেমে জীবন উৎসর্গ করতে পারে সবই ছিল প্রিয় নবী হাবিবে-খোদার মাঝে ,যার সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমরা দেখি, তাঁর সংগ্রামী সাথী-সঙ্গী সাহাবায়ে কেরামের জীবনে। তারা প্রাণের চেয়েও বেশি তাকে ভালোবাসতেন । এমনই কিছু উজ্জ্বল উদাহরণ ও সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাঠকের সামনে পেশ করার ইচ্ছে করছি।
১–আপন জীবনের চেয়ে হাজার গুণ বেশি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ভালবাসার চিরোজ্জল দৃষ্টান্ত পেশ করলেন হযরত আলী ইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। তিনি প্রিয় নবীর প্রানের বিষয়ে শঙ্কা অনুভব করলেন। মক্কার কাফেররা “উজ্জ্বল প্রদীপ “চিরদিনের জন্যে নিভিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর ,দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলো। পৃথিবীময় তখন আঁধারের ঘনঘটা বিরাজমান । শুয়ে আছেন প্রিয় নবীজি । হঠাৎ নবী-গৃহের চারপাশে নিঃশব্দে কাফিররা উপস্থিত ।নিজেদের ব্যর্থ চেষ্টা বাস্তবায়ন না করে আর থামবে না ।ওহীর মাধ্যমে একথা নবীজী জানতে পেরে হযরত আলীকে বললেন ,চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকো আমার বিছানায় ।অমনি হযরত আলী জীবনের মায়া ভুলে গিয়ে রাসূলের ভালোবাসায় আদেশ পালনে পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গেলেন। জীবনের মায়া ত্যাগ করে নির্দেশ পালনের এমন দৃষ্টান্ত কি তুমি কল্পনা করতে পারো ! হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি তাঁর সাহাবাদের প্রেম ও ভালোবাসা এবং আত্মোৎসর্গের এই ছিল নমুনা ।
২–সোনালী ইতিহাসের স্বর্ণ-খচিত একটি নাম হল খুবায়েব ।হযরত খুবাইব রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এর হৃদয়বিদারক ঘটনা আমাদের কারোরই অজানা থাকার কথা নয় !এই মজলুম শহীদের স্মরণে যুগে যুগে কত হৃদয় থেকে রক্ত এবং কত চোখ থেকে অশ্রু ঝরেছে তা কে বলতে পারে !হতভাগা কুরাইশরা তাকে শূলে চড়িয়ে এরপর উপহাস ও আমোদ করে জিজ্ঞেস করল ,তুমি কি চাইবে যে ,মুহাম্মাদ তোমার স্থানে হবে ?
তিনি বললেন ,”না ,আল্লাহর কসম ,না ! আরো দীপ্ত কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করলেন, আমি তো এমন ও চাইবো না যে ,আমার মুক্তির বিপরীতে তাঁর পায়ে সামান্য কাটা বিঁধবে”। একথা শুনে চরম উপহাস করে লোকেরা তাকে ব্যঙ্গ করতে লাগলো ।আর (কাফের অবস্থায় )সেখানে উপস্থিত আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন -আল্লাহর কসম! পৃথিবীর কাউকে এত ভালোবাসতে দেখিনি যেমন মোহাম্মদের সঙ্গীরা তাকে ভালোবাসে।
৩–রাসূলের দেহ মোবারকে সামান্য কাটার অনুপ্রবেশ যেই সাহাবায়ে কেরামের কেউ সহ্য করতে পারত না তারা কি করে সহ্য করবে যে শত্রুর তীরের আচর লাগুক নবীর গায়ে। পরবর্তী উম্মতের জন্য এর বাস্তব নমুনা রেখে গিয়েছেন ধন্য সাহাবী আবু দুজানা ।
ওহুদের যুদ্ধে তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূলের জন্য ঢাল স্বরূপ ।তীর এসে বিঁধতো তার পিঠে ,আর তিনি ভাবতেন ,আমার পিঠ ঝাঁঝরা হয়ে যাক ,আল্লাহর রাসূল নিরাপদে থাকুন ।
রাসূলকে তারা কত ভালোবাসতেন! রাসূলের জন্য কিভাবে নিজের জীবনকে তলোয়ারের মুখে দাঁড় করাতেন।
৪–কুরাইশের প্রসিদ্ধ বীর-বাহাদুর আব্দুল্লাহ ইবনে কমি‘আ যুদ্ধের কাতার ডিঙিয়ে আল্লাহর রাসূলের আলোকিত ও নূরানী চেহারায় তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলো। ফলে রাসুলের চেহারা মোবারকে লোহার দুটি আংটা ঢুকে গেল এবং একটি দাঁত মোবারক শহীদ হয়ে গেল ।সিদ্দীকে আকবর হযরত আবু বকর সেই যখম থেকে আংটা বের করার জন্য অগ্রসর হলে হযরত আবু উবাইদা ইবনে জাররাহ আল্লাহর দোহাই দিয়ে বললেন ,এ খেদমতের সুযোগ আমাকে দিন ।এরপর নিজে অগ্রসর হয়ে হাতের পরিবর্তে মুখ দিয়ে আংটা টান দিলেন ।তখন প্রথমবারে একটি আংট বের হওয়ার সাথে সাথে শক্তির কারণে আবু উবাইদার একটি দাঁত পড়ে গেল ।
এই দৃশ্য দেখে দ্বিতীয়বার আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু অগ্রসর হলে পূর্বের ন্যায় আবু উবাইদা আল্লাহর দোহাই দিয়ে খেদমতের আশা করলেন এবং দ্বিতীয়বার মুখ দিয়ে আংটা বের করতে গিয়ে দ্বিতীয় আরেকটি দাঁত পড়ে গেল।
৫–শুধু কি পুরুষ সাহাবীগণই নবীজির জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন?না ,নারী সাহাবীদের দৃষ্টান্তও দেখুন কত উজ্জ্বল ! ওহুদের কথা আমরা কে না জানি?সেই বিপর্যয়ের মুহূর্তে এক আনসারী নারী ভীষণ অস্থির ও পেরেশন অবস্থায় বের হলেন ।আল্লাহর রাসূলের সাথে তার বাপ, ভাই ও স্বামী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং একে-একে সকলেই শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করে আজীবন তৃষ্ণাহীন ধন্য জীবন লাভ করেছেন।
সেই নারী পথে পথে ঘুরছেন ।কাউকে দেখামাত্র শুধু জিজ্ঞাসা করছেন;আল্লাহর রাসূল কেমন আছেন ?লোকেরা তাকে বলল ,আলহামদুলিল্লাহ ,তিনি তেমনি আছেন যেমন তুমি কামনা করো ।তিনি বললেন ,আমাকে দেখাও আমি নিজের চোখে তাকে দেখতে চাই ।তিনি দেখলেন আর বললেন -হে আল্লাহর রাসূল !আপনার পর সব বিপদই আমার কাছে তুচ্ছ(সহনীয়)।
নবীকে কী পরিমাণ ভালবাসলে পিতা,স্বামী ও ভাই হারানোর পরও নবীর সামনে এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করা সম্ভব।
শেষ কথা, ছেলে -মেয়ে, ভাই -বোন, স্ত্রী ও মা-বাবা সকল প্রিয়োজন থেকেও বেশি ভালোবাসার হক্বদার মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ।তাকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসা তো আমাদের ঈমানী দায়িত্ব এবং দ্বীনের পথে তাঁর যত আত্মত্যাগ ও বিসর্জন সেগুলোর সামান্য মূল্যায়ন ।
মুমিন ,মুসলিম বলে পরিচয় দেবো,অথচ মা-বাবা স্ত্রী-সন্তানকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেবো! তাহলে ঈমানের কীই বা বাকি থাকলো !?
তাকে নিয়ে কোথাও আপত্তিকর কিছু ঘটানো হলে মায়ের কথা মনে করে পৃথিবীবাসীর সামনে সাহাবীদের মত প্রেম ও জীবন উৎসর্গের কোন সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পেশ করতে পারিনা, নবীর হাতে গড়া সাহাবায়ে কেরামের সংগ্রামী কাফেলা রক্তের বিনিময়ে যে দ্বীনকে সমুন্নত করে গেছেন তার সামান্য ঋণও আমরা শোধ করতে পারিনা।
হায় দুর্ভোগ ! কেন এ জাতি পদে পদে অপমানিত হবে না ? পথে পথে লাঞ্ছনার শিকার হবে না ?তাদের প্রতি অন্যায় -অবিচার, জুলুম -নির্যাতন কেন হবে না? অথচ নবীর ভালোবাসা ছেড়ে, ঈমানী চেতনা হারিয়ে তারা অন্ধকার অতল গহবরে ডুবন্ত।
প্রিয় পাঠক! আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীর কেউ নমুনা ছাড়া কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। নমুনা ছাড়া কোন কিছু সৃষ্টি করলেও সেটা নিখুঁত হয় না। তাই রাসূল প্রেমের ও রাসূল-প্রেমে জীবন উৎসর্গের এই ঘটনাগুলো আমাদের জন্য বড়ই শিক্ষনীয়।
এই ঘটনাগুলো জীবনের সংকটময় মুহূর্তে আমাদের পথ দেখাবে, আমরা কিভাবে রাসূল-প্রেমে জীবন বিলিয়ে দিব? জীবনের সর্বস্ব দিয়ে কিভাবে রাসূলকে ভালোবাসবো? কোরআনে পাকে আল্লাহ তাআলা বলেছেন: আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। (সূরা আহযাব ,আয়াত নং ২১)। অতি অল্প সময়ে রাসূল ও সাহাবীদের জীবনে এত বিস্ময়কর জয় ও বিপ্লব কিভাবে সম্ভব হলো?
এর একটি মাত্র কারণ- রাসূলকে তারা সর্বোচ্চ ভালোবাসা দিয়ে সঙ্গে থেকেছেন ও বিনাবাক্যে তাঁর আনুগত্য করেছেন। এবং দ্বীনের জন্য সর্বাত্বক কুরবানী পেশ করেছেন। বিধায় সম্ভব হয়েছে পৃথিবীর চোখে গোলক ধাঁধার ন্যায় এই বিজয়। যে বিজয়ে বিশ্বের সকলেই হতবাক।
আমরা বিজয় চাই, মুক্তি চাই, স্বাধীনতা চাই, কিন্তু প্রস্তুত নই তাদের মত দ্বীনের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে রাসূল-প্রেম সর্বোচ্চ মাত্রায় দান করুন এবং এই মুহাব্বত ও প্রেম অবলম্বন করে দ্বীনের পরিপূর্ণ বিজয় দান করুন। আমীন। লেখক: শিক্ষার্থী মুহাম্মদপুর কওমী মাদরাসা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com